পর্ব ২
চোখের জল আটকাবার চেষ্টা করেন না মোহনা। জগতের একটামাত্র নির্জন স্থানে চোখের জল ঝরার কার্যকারণ কেউ খুঁজতে আসে না, সেটা হলো মোহনা চক্রবর্তীর ঠাকুরঘর। মোহনার শোবার ঘরের পাশের ছোট্ট ঘরটিতেই ঠাকুরঘর। কাঠ দিয়ে তৈরি পূজার ঘরটিতে মূল মন্দিরের মাঝখানে একটু উঁচুতে নানা দেবতার ছবি। আর মন্দিরের শিখরের উপর লাল কালিতে ওঁ লেখা। মন্দিরের গায়ে বিভিন্ন রকম ফুল, ফল, লতার সঙ্গে সংস্কৃত শ্লোক আর দেবতাদের প্রতীক দিয়ে নকশা করা।
অনির বাবা শংকর চক্রবর্তী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই ঠাকুরঘর নির্মাণের তদারকি করেছেন। শঙ্খ, থালা, গ্লাস, ঘণ্টা, পঞ্চপ্রদীপ, পিতলের প্রদীপে কাপড়ের সলতে সব পূজার উপকরণে মোহনার হাতের নিপুণ ছোঁয়া। আজ সকালেও অশুভ দূরীকরণের বাসনায় অনির মাথায় মাঙ্গলিক আলো ছুঁইয়েছেন মোহনা অথচ আজ প্রভাতী আলোতেই কি এক অশুভ আশংকায় তার বুকের ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছে। যার অনিবার্য পরিণতিতে চোখের জলে শাড়ির আঁচল ভিজে যাচ্ছে।
মোহনা বার বার ঠাকুরকে ডাকছেন, ‘ও ঠাকুর, আমার দোষ নিও না! ও ঠাকুর আমার বাবাইকে ফিরিয়ে আনো!’ মোহনার জলজ আকুতিতে ঠাকুরঘরের পরিবেশ আরও ভারি হয়ে উঠছে।
এই বাড়িটা শহরের বাজার এলাকায়। শ্যাওলায় প্রায় সবুজবর্ণ ধারণ করা লাল ইটের দোতলা বাড়িটিকে হই-হট্টগোলের বাজারের পাশে বেখাপ্পা দেখায়। তবু বহুকাল হলো শংকর আর তার পূর্বপুরুষেরা পৈতৃকভিটার মায়া ধরে রেখেছে। এখন তো পৈতৃকভিটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায় বংশানুক্রমিকভাবে শংকরের উপরই বর্তায়। যদিও এই বাড়ি এখন আর চক্রবর্তী পরিবারের জন্য আর দায় না, প্রয়োজন।
কিন্তু আজ যেন সেই প্রয়োজনকেও আঁকড়ে ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শোনা যাচ্ছে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকার নাকি হিন্দুদের পুরানো ঘরবাড়ি নিয়ে নিচ্ছে। মামলা-মোকদ্দমা করে সেই তালিকা থেকে যারা এতদিনেও নাম কাটাতে পারেনি তাদের ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে। নিত্যানন্দ দাদা সকালে খবরটা দেয়ার পর থেকে অনির বাবার মাথার ঠিক নেই। মোহনারও কি মাথার ঠিক আছে? তাই তখন কী থেকে কী করে ফেলেছিলেন তা তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি।
মোহনা আর শংকরের দুই সন্তান। তনিমা চক্রবর্তী তোড়া আর অনিমেষ চক্রবর্তী অনি। মেয়েটা বড় হচ্ছে আর কেমন করে যেন মোহনার আরও আপন হয়ে যাচ্ছে। আর ছেলে অনির সঙ্গে বাড়ছে দূরত্ব।
রোজ স্কুল বা কোচিং থেকে ফিরেই তোড়া ক্লাসে ঘটে যাওয়া ঘটনার সাতকাহন শুরু করবে। এমনকি কোন ছেলে কি চোখে তাকিয়েছে আর দস্যি মেয়ের কাঁটাচামচ দিয়ে চোখ তুলে নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছে, এসবও শুনাবে মাকে নির্দ্বিধায়। শুনে মোহনা ঠাকুরকে ডাকে দেখে মেয়ের সে কী হাসি! ঐ হাসি দেখে মোহনার প্রাণ জুড়োয়। মেয়েটা কখনো কখনো বন্ধুর মতো গলা জড়িয়ে আবদার করে, ‘এই বৈশাখে তোমার লাল সাদা গরদের শাড়িখানা কিন্তু পরতে দিবে মা!’ মোহনা মেয়েকে আশ্বস্ত করেন আর ভাবেন ছেলেটা এভাবে কেনো আর গলা জড়িয়ে ধরে না?
ছেলেটার শরীর এক এক ইঞ্চি করে বাড়ে আর মোহনার সাথে ছেলের মনের দূরত্ব ফুটখানেক বাড়ে। ঘরটা আলাদা করার পর থেকেই যেন আরও ছেলের নিজের জগত হলো। আর মায়ের সঙ্গে দূরত্বও বাড়লো।
অনির বাবার জোরাজুরিতে অনি ক্লাস সিক্সে ওঠার পর অনির জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
ওদের বাড়িটা বেশি বড় না। ঠাকুরঘর বাদে আর তিনখানা ঘর আছে এই বাড়িতে। একটা মোহনা শংকরের শোবার ঘর, একটা তোড়ার, আরেকটা খাবার ঘর। অনির দিদা এলে তোড়ার সাথেই ঘুমায়।
ক্লাস ফাইভে উঠতেই ছেলে হাতে পায়ে লম্বা হতে লাগলো। অনির বাবা ছেলেকে নিয়ে খাটে ঘুমোলে মোহনাকে মেঝেতে তোশক পেতে ঘুমাতে হতো। আবার কখনো মোহনা খাটে ঘুমালে বাবা-ছেলে মেঝেতে বিছানা পাততো। পরে একদিন অনি নিজে থেকেই বললো, তার আলাদা ঘর চাই।
মোহনা প্রথমে রাজি ছিলেন না। তবু শংকরের ইচ্ছেতেই খাবার ঘরের পূব পাশে অনির জন্য ছোট একটা রট আয়রনের খাট পাতা হলো। মাস তিনেক পরে সামনের বারান্দার গ্রিল সরিয়ে ইট গেঁথে অনিকে ছোট একটা রুমের বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল।
ঘর আলাদা হওয়ায় রাতে ঘুমোবার আগে ছেলের শরীরের গন্ধ পেতেন না বলে বুক ভেঙে কান্না পেত মোহনার। এই একই অনুভূতি তার হয়েছিল যখন অনি দুধ খাওয়া ছাড়ে। অথচ ছেলেকে বুকের দুধ খাওয়ানো ছাড়াতে তিনি নিজেই বুকে করলার রস দিতেন। মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ছোট্ট অনি সেই তিতা মুখে নিয়ে বলতো, ‘মা বুকিতে তিতা কেন?’ ছেলের বেকায়দা অবস্থায় মোহনা হাসতেন। হঠাৎ একদিন অনি দুধ খাওয়া ছেড়ে দিলো। মোহনা ঘুমোতে ডাকলে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলতো, ‘আমি তিতা খাই না।’ সেই কথা শুনে বুক হু হু করে উঠতো মোহনার।
আজও সেই একই অনুভূতি হয়! তাই রোজ রাতে ঘুমোবার আগে মোহনা ছেলের ঘরে ঢোকেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বলে দেন, ‘দরজা আটকে ঘুমোসনে বাবা, রাতবিরাতে কী হয় না হয়, আমার ভয় করে।’ মাকে নিশ্চিন্ত করতে বাবাই হাসে।
ছেলের সরল হাসিতে মোহনা নিশ্চিন্ত হন না। আজকাল অনির দিকে তাকালে অচেনা এক অনুভূতিতে বুকটা কেমন করে। বড় অদ্ভুত এই জীবন! ছেলেটা মটরদানার মত মোহনার শরীরের ভেতরে ছিল। সেই শরীর ভেদ করে কেমন গাছ হয়ে জন্ম নিল। এখন সেই গাছ ডালপালা ছড়াচ্ছে। তোড়ার জন্মসময়টা মনে পড়ে না মোহনার। মায়ের বাড়ির আমোদ আহলাদে বছরখানেক কাটিয়ে নিজ সংসারে ফিরেছিলেন তিনি। আর অনির জন্ম হয়েছিল ঘোর দুঃসময়ে। অনির বাবা তখন ব্যাংক অডিটের কী এক ঝামেলায় বরখাস্ত হয়েছিলেন। অভাব আর অপমান যেন তখন ঘরের শ্যাঁওলা ধরা সবুজাভ দেয়ালের গায়েও লেপটে ছিল। তবু কী করে যেন ঐ কঠিন দিনগুলো একটা সময়ে ফুরিয়ে গিয়েছিল।
বহু আরাধনায় তাদের পেটপুরাণের গল্প আড়ালে রেখে অনি আর তোড়াকে নিয়ে সেই দুঃসময় পার করেছিলেন তারা।
কষ্টের লুকোচুরি দেখতে দেখতে বড় হয়েছিল বলেই কি অনির মানসিক বৃদ্ধিও দ্রুত হয়েছে? এখন সেই বৃদ্ধি ছুঁয়ে দেখবার সাধ্যি কি মোহনার নেই? কবে যে ছেলেটা কোল ছাড়া হলো দিনক্ষণ বলতে পারেন না মোহনা। মায়ের গায়ের সাথে লেপটে থাকা অনি একটু একটু করে তার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে কি? নাকি বৃথাই তার দুশ্চিন্তা?
এই এত্তটুকুন বয়স থেকে বাবাইকে খুব কমদিনই পোষাকি নামে ডেকেছেন মোহনা। সারাদিন ছেলেটা মা মা ডাকতো। এমনকি মোহনা স্নানঘর থেকে বেরিয়ে দেখতেন ছেলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ক্লাস থ্রি-ফোরে থাকতেও থাকতেও কোলে ওঠার বায়না ছিল বাবাই এর। তা দেখে অনির বাবা বলতেন, ‘এবার পিছু ছাড়ো, ছেলেটাকে বড় হতে দাও।’
বাবার কথা শুনে অনি ওর ছোট্ট শরীরটা গুঁজে দিতো মায়ের আঁচলের নিচে।
‘আমি বড় হবো না বাবা, বড় হলে মানুষ বুড়ো হয়। আমি বুড়ো হবো না!’
এতদিন পর ছেলের সে কথা মনে পড়ে মোহনা কান্নার মধ্যেও হেসে ফেলেন। ‘আমার বাবাই সোনা! ’বাবাই এখন সত্যিই বড় হচ্ছে! তবু ছেলের সব কাজ তাকেই করতে হয়। নোংরা কাপড় ধুয়ে দেওয়া, টেবিল গোছানো, বাসি বিছানা ঝাড়া, ঘর গোছানো। দিদির সাথে ওর চিরকালের শত্রুতা। মোহনা শত ব্যস্ত থাকলেও এসব কাজ নিজেই সারেন, তোড়াকে করতে বলেন না। ছোটবেলা থেকে তোড়া অবশ্য নিজের কাজ নিজেই করে। তবে মেয়েটাও খুব পাজী। দিনরাত ছোট ভাইটার সাথে খুনসুটি। তুই আমার শেলফে হাত দিয়েছিস কেন? দেরি করে ফিরলি কেন? হাতমুখ না ধুয়ে ঠাকুরঘরে ঢুকলি কেন? মাকে বলে দিবো! বছরখানেক আগে অবধি দুটোতে মারামারি করতো। এখন অনিটাই কেমন গুটিয়ে গেছে। দিদি কিছু বললে মুখ ভার করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বড় জোর বাবার কাছে নালিশ দেয়, ‘দিদি কিন্তু বেশি বেশি করছে, কিছু বলবে বাবা?’
সেই ছোট্ট বাবাই এর বুকজোড়া এখন মেঘের বাসা। একটু বাতাস লাগলেই মেঘেরা ছত্রভঙ্গ হয়। আবার কি এক অভিমানের তীব্রতায় মেঘ ঘনীভূত হয়ে গায়ে গায়ে ধাক্কা লেগে বিজলি হয়ে চমকায়। বিষয়টা বোঝার মতো জ্ঞানের পরিধি মোহনার আছে। তবু কী করে যেন ভুল হয়ে যায়। মোহনা জানেন, সবার ভুল তিনি ক্ষমা করলেও সংসারে তার ভুল ক্ষমার অযোগ্য। চোখের কার্ণিশে জমে থাকা জল তাই বাঁধ মানে না। মোহনা ডুকরে কেঁদে ওঠেন, ‘ও ঠাকুর, আমার বাবাইকে ফিরিয়ে দাও।’
‘মা, ও মা, রন্টুদা অনিকে ধরে এনেছে। ও নাকি আরেকটু হলেই ঢাকার বাসে উঠে পড়ছিল।’
তোড়ার কথা শুনে মোহনা ছুটে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে যান।
(চলবে)