সুপ্রিয় অনি

পর্ব-১

অনি হাঁটছে। দ্রুত পায়ে। দূর থেকে যে কেউ দেখে ভাববে কোনো স্থির লক্ষ্যের দিকে জোর পায়ে ছুটে চলছে ছেলেটি। কিন্তু অনি যখন বাড়ি থেকে বের হয় তখন কোনো উদ্দেশ্য ছিল না বরং তীব্র এক অভিমান নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। এখন অভিমান আর দুঃখের ফারাক নেই কোনো। বুকের ভেতর অভিমান জমে জমে দুঃখের বোঝা হয়ে গেছে। নিজের প্রিয় জিনিসগুলো ফেলে আসার কথা ভেবেও তাই ওর পিছু ঘুরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রিয় কয়েন এ্যালবামটা, পঁচিশটা রঙিন মার্বেল, ফুটবল, সাকিবের অটোগ্রাফ পাওয়া ক্রিকেট ব্যাট, নাইনথ বার্থডেতে তোড়াদির গিফট করা লক দেয়া ডায়েরি, পড়ার টেবিলের বইখাতাগুলো আর মায়ের শরীরের গন্ধ।

শুধু গন্ধ! মায়ের শাড়ির আঁচল, সিঁদুররাঙা মুখ, ঠাকুরঘর। পুরো মা! উহু, তবু অনি ফিরবে না। মা কি ওর পথ চেয়ে বসে আছে? মা এখন বাবাইকে ভুলে প্রাণের তোড়াকে নিয়ে মশগুল। নিশ্চয়ই মা এই মুহূর্তে বড়দিকে কোচিং থেকে ফেরার পর ওর কপালের ঘাম মুছে দিচ্ছে আর বলছে, ‘দু’টো নাড়ুমুড়ি মুখে দিয়ে একটু রেস্ট নে মা, দু’দিন পর এত বড় একটা পরীক্ষা!’ আর তা শুনে নিশ্চয়ই তোড়াদি আহলাদে আটখানা হয়ে একসাথে দু’টো করে নাড়ু মুখে পুরছে।

নাড়ু মুড়ির কথা মনে হতে ক্ষুধাবোধ ফিরে এলো অনির। সকালে নাস্তাটাই তো ঠিক মতো করা হয়নি। করবে কী! সেখান থেকেই তো গণ্ডগোলের শুরু। অনির পাশ ঘেঁষে একটা রিকশা চলে গেল। রিকশা থেকে এক যাত্রীর বিরক্ত গলা শোনা গেল, ‘এ্যাই ছেলে মারা পড়বা তো, মাঝরাস্তায় উইঠা আসছো কেনো? আজকালকার পোলাপানের কোনো সেন্স নাই।’

অনি নিজেকে সামলে নেয়। শহরের এই রাস্তটা খুব ব্যস্ত। বাসও যাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। বাড়ি থেকে অনেক দূর চলে এসেছে অনি। কিন্তু আরো দূরে যাবে সে, বহুদূর।

চলতে চলতে অনি অনেক কিছু ভাবছে। পায়ের গতির সাথে সাথে ভাবনার গতিময়তায় ওর অভিমানের পারদ ওঠানামা করছে। অনি ঠিক করেছে, আর বাড়ি ফিরবে না। কিছুতেই না। দরকার হলে এখনই কিছু একটা কাজ জুটিয়ে নিবে। যেকোনো একটা কাজ। অনির এখন বড় হওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেছে। ছোটবেলায় কত কী হতে ইচ্ছে করেছে! স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, মেঘ, বৃষ্টি থেকে রঙিন ঘুড়ি! এরপর একটা সময়ে অনির খুব বাদামওয়ালা হতে ইচ্ছে করতো। দিদার বাড়ি যাবার সময় সদানন্দপুর থেকে সিল্কসিটি ট্রেন ছাড়তে না ছাড়তেই বাদামওয়ালা সুর করে করে বলতো, ‘হেইইই, বা-দা-ম লিবেন, হেইইই বা-দা-ম।’ অনির ভীষণ ভাল লাগতো সেই সুরেলা ডাক। গলায় গামছা দিয়ে বাদামের গামলা ঝুলিয়ে কী অদ্ভুত কায়দা করে যে বাদামওয়ালা বাদাম বিক্রি করতো! অনি তো মাঝে মাঝে রাতে স্বপ্ন দেখতো-ও রেলস্টেশনে বাদাম ফেরি করছে!

এখন আর অনির এসব উদ্ভট এইম ইন লাইফ নেই। বাবার খুব ইচ্ছে, অনি নিজের ইচ্ছেমতো সায়েন্স বা আর্টস নিয়ে পড়বে। কিন্তু অনেক অনেক ডিগ্রি নিবে। মায়ের ইচ্ছেটা অদ্ভুত, সাত সকালে পুজোর ফুল কপালে ছুঁইয়ে বলবে, ‘বাবাই, তুই শুদ্ধ থাক বাবা। তোর কিচ্ছুটি হবার দরকার নেই।’ অনি তো শুদ্ধই থাকে। সময়মতো স্কুল থেকে ফিরে স্নান করে পরিপাটি পোশাকে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকে। বরাবর গুড বয় টাইপ অনিকে তবু রোজ মায়ের একই প্রার্থনা শুনতে হয়। তবে মায়ের প্রাথর্নার সাথে সাথে অনি মনে মনে ভগবানের কাছে দু’একটা দাবী দাওয়াও রেখে বসে, ভগবান সামনের বার্থডেতে আমাকে রন্টু ভাইয়ের মতো চমৎকার একটা গিটার পাইয়ে দিও। বড় হলে আমাকে বড় একজন গিটারিস্ট বানিয়ে দিও।

মা অবশ্য এই বার্থডেতে কথা দিয়েছে, স্কুল ফাইনাল হয়ে গেলেই অনি একটা গিটার পাবে। মা আগে এত শর্তবাজ ছিল না। যত দিন যাচ্ছে, মায়ের শর্ত সংখ্যাও বাড়ছে। যখন তখন ঘরের দরজা আটকাবি না, বেশি রাত অবধি ঘরের লাইট জ্বালিয়ে রাখবি না, পড়ার বইয়ের সাথে গল্পের বই রাখবি না, স্কুল ফিরতি যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিবি না, রন্টু আর ধীমানের সাথে বেশি মিশবি না।
মায়ের বেশিরভাগ ‘না’ অনি মেনে নিলেও রন্টু ভাই আর ধীমানের সাথে না মেশার শর্তটা ও মানবে না বলে ঠিক করেছে। এটা অবশ্য ওর ভেতরের একান্ত গোপন কথা। বাবা কী করে যেনো অনির গোপন কথাগুলো টের পেয়ে যায়। তাই মায়ের ফিরিস্তি দেয়া শেষে বাবা বলে, ‘এসব বলো না মোহনা, অনি সবার সাথেই মিশবে। খারাপের সাথে না মিশলে ভালোটাকে আলাদা করবে কি করে? অত রাশ টেনো না। শুধু বলে দাও কার কাছ থেকে ও কতটুকু নিবে।’

মা বাবার কথা শুনে ক্ষেপে ওঠে, ‘অতো তত্ত্বকথা বলো না, কলেজের ওই ধাড়ি ছেলের সাথে এই বাচ্চা ছেলেগুলোর অত কিসের মেলামেশা? দুষ্টের হাঁড়ি একেকজন।’

অনি জানে না অত কে কেমন। সুপারম্যানের পরে যদি কোনো চরিত্রকে আকর্ষণীয় হিসেবে অনিকে বেছে নিতে বলা হয় তবে অনি রন্টু ভাইকেই নেবে। তাই এই একটা ব্যাপারে অনি মায়ের চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার গণ্ডিকে ডিঙিয়ে চলে। আর আজ তো অনি সব গণ্ডি পেছনেই ফেলে এসেছে। তবে রন্টু ভাইয়ের কাছে একবার গেলে মন্দ হতো না। নাহ, না গিয়ে ভালোই করেছে। মা-বাবা প্রথমে রন্টু ভাইয়ের বাড়িতেই ওর খোঁজ করবে।

অনি এত সহজে ধরা দিতে চায় না। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। আজ ভয়ংকরভাবে ওকে অপমানে বিদ্ধ হতে হয়েছে। কারো ভালবাসা আজ ওর গতিরোধ করতে পারবে না।
তবে মা যদি সত্যিই এবছর ওকে গিটার কিনে দেয়? বাড়ি না ফিরলে গিটারটা পাওয়া হবে না আর।

অনির বোধহয় আর গিটারিস্ট হওয়া হলো না। এখনই ওকে কাজ জোটাতে হবে। ক্ষুধার বিকল্প যে নেই তা তো অনি বোঝে। ও যতটুকু বড় তাতে কোনো না কোনো কাজ ঠিকই পেয়ে যাবে। সবাই বলে বয়সের তুলনায় অনির শরীরের গড়ন বেয়াড়া রকমের ভাল। অনির বয়স চৌদ্দ, ক্লাস সেভেনে পড়ে। কিন্তু লম্বায় অনি এখনই পাঁচ ফুট ছাড়িয়েছে। কারো পাশে দাঁড়ালে অস্বস্তি থেকেই ওর ঘাড় নুয়ে আসে। বাড়িতে কোনো নতুন অতিথি এলেই বাবাকে বলে, ‘শংকরদা, আপনার ছেলে কোন সাবজেক্টে পড়ছে। বাবা ঘর কাঁপিয়ে হাসে আর বলে, ‘আমার অনিমেষ অল সাবজেক্ট পড়ছে।’
বাবার কথা মনে হতেই বুকের ভেতর কেমন একটা মোচড় দেয়। কেমন একটু ব্যথাও করতে থাকে। অনি বোঝে না, ও যে বড় হয়েছে তা সকলেরই চোখে পড়ে, মায়ের চোখে পড়ে না?

আর মা তো জানে, অনি কেমন ছেলে। তবে কেন সকালে তোড়াদির কথা শুনে মা অনির দিকে স্টিলের মগ ছুঁড়ে মারলো? মগটা অনির গায়ে লাগেনি কিন্তু অপমানটা বিধেঁছে বুকের একেবারে গভীরে । ওকে মগ ছুঁড়ে মেরেও মায়ের রাগ পড়েনি। রাগে কাঁপছিল মা, ‘গায়ে গতরেই বড় হয়েছে, বুদ্ধি বাড়েনি।’ বদমাশ ছেলে! মায়ের কথা শুনে পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো তোড়াদি ফিক ফিক করে হাসছিল, যেন বেশ হয়েছে, আর লাগতে আসবি আমার সাথে?

কিন্তু মাও তো জানে অনি ইচ্ছে করে লাগতে যায় না। কারো সাথেই না। অনিতো শুধু শরীরেই বড় হচ্ছে না, বুদ্ধিও তো বাড়ছে ওর! তবু কথায় কথায় ওকে কেনো শুনতে হয়, শরীরেই বড় হচ্ছে, বুদ্ধিতে না! মায়ের কথা শুনে মনে হয় বড় হওয়াটা বিপত্তির অথচ রন্টু ভাই বলে, বড় হওয়াটা অনেক মজার বিষয়। গিটার কোলে নিয়ে দু’আঙুলের ফাঁকে কায়দা করে সিগারেট ধরে রন্টু ভাই যখন কথাটা বলে, তখন অনির বড় অদ্ভুত লাগে। বড় হওয়ার রহস্যময়তার অধীরতায় অনি যখন বলে, ‘আমি তো বড় হচ্ছিই রন্টু ভাই!’ রন্টু ভাই অনির কথা শুনে হাসে। সেই হাসির রহস্য অনিকে বুঝিয়ে দেয়, সে পথ আরো দূরে।

অনির ক্লাসমেট সন্তু বলে, ‘তুই এখনই তো দামড়া।’ দামড়া শব্দটা একটু কুৎসিত শুনালেও সন্তুর বলার ভঙিতে বেশ একটা সমীহভাব থাকে বলে অনি কিছু মনে করে না। আয়নার সামনে খালি গায়ে অনি দাঁড়িয়ে দেখেছে, দু’হাতের পেশিতে বেশ দৃঢ়তা এসেছে ওর। অনির পিসতুতো ভাইয়ের পাঁচ বছরের শ্যামল সেদিন ওর কোলে উঠে বলছিল, ‘কাকু, তোমার তো ভিমের মত মাসল হচ্ছে! আমার মাসল নাই।’

শ্যামলের মাথায় খুব বুদ্ধি আর এখনই খুব ফিঁচকে দুষ্টু। শ্যামলের কথা মনে পড়ে হাসি পায় অনির। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয় ও। কোনোভাবেই মন নরম করা চলবে না।

অনি এখন প্রায় ছুটছে। ছুটতে ছুটতে ও শহর ছাড়িয়ে শহর রক্ষা বাঁধের উপর উঠে এসেছে। হাঁটায় অনির ক্লান্তি আসেনি। শরীরের ভেতরের অদৃশ্য এক শক্তি বরং ওকে তাড়িয়ে নিচ্ছে। আর মাইল খানেক হাঁটতে পারলেই কড্ডা চলে যাবে। কড্ডা মোড় থেকে যে কোনো বাস পেয়ে যাবে। অনি প্যান্টের পকেটে হাত দেয়। ওর মানিব্যাগ নেই। বাবার দেয়া কিছু খুচরো টাকা আছে পকেটে। পথে খেয়ে নিবে কিছু একটা। তারপর কী হবে, অনির সেটা ভাববার অবকাশ নেই।
(চলবে)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত