কেউ জানতে চায়নি ( দ্বাদশ, ত্রয়োদশ, চতুর্দশ পর্ব )

১২
রাকিব মোবাইলের শব্দে সম্বিত ফিরে পায়। মনসুর।
হ্যালো।
কিরে দাওয়াত দিয়ে চুপচাপ বসে আছিস।
না, না চুপচাপ কেন, যাবো তো।
আশ্চর্য খাওয়ার সময় গিয়ে হাজির হবো। একটু আইস-ব্রেকের বিষয় আছে না।
কখন যেতে চাস?
এখন সাড়ে এগারোটা বাজে। সাড়ে বারোটায় রওনা দিলেও সেই দুপুরই হলো। তুই একটা উবার ঠিক কর মিরপুরের,আমি খেজুর বাগানে চলে আসছি।
ওকে, তাড়াতাড়ি আসিস।ও হ্যাঁ ব্ল্যাক লেবেলের কী খবর?
ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তবে যা বৃষ্টি হয়েছে রাস্তায় পানি জমে আছে নাকি কে জানে। সোহিনীর বাসা মিরপুর ছয়ে?
হ্যাঁ।
আসছি তাহলে।
মনসুর একটি টাইট জিন্সের সাথে লাল রঙের ফতুয়া পরেছে। গা থেকে খুব সুন্দর গন্ধ আসছে পারফিউমের।
কিরে তুই তো একেবারে মাঞ্জা মেরে যাচ্ছিস।
হা… হা… শালা তোর তাতে কি? মেয়েদের সাথে প্রথম পরিচয়ে একটু ভিন্নতা থাকলে ভালো হয়। আকর্ষণীয় কিছু।
হুম।
রাকিব কালো টি শার্টের সাথে জিন্স পড়েছে কিন্তু মনসুরের পাশে ওকে একটু ম্লান লাগছে।
তো মাস্টার সাহেব আপনার শান্তা ভূত বিদায় হয়েছে।
হা… হা… না। শাকচুন্নিরা এতো সহজে বিদায় হয় না।
হা… হা… ভালো বলেছিস, শাকচুন্নি। শান্তাকে ভুলে যাওয়া এতো সহজ হবে না।
ভুলে যেতে হবে কেন? মনে রেখে দে কিন্তু শুধুই একটা সুন্দর স্মৃতি হিসাবে।
হুম, সুন্দরের সাথে অসহ্য যন্ত্রণাও বয়ে বেড়াতে হবে।
তা তুই বয়ে বেড়াতে চাইলে কে তোকে থামাতে পারবে বল। তবে বন্ধু হিসাবে আমি বলবো ওকে ভুলে যেতে। যদি কারো সাথে কিছুদিন সম্পর্কিত হতে পারিস। সেটা ফিজিক্যালও হতে পারে।
মানসিক সম্পর্ক ছাড়া কারো সাথে আমার শারীরিক সম্পর্ক হবে না।
চুপ কর। তোর এইসব আঠারো শতকীয় প্লেটোনিক প্রেমের ধারণা থেকে বেরিয়ে আয়। চিয়ার্স ম্যান।
হুম। রাকিব সিগারেটের প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ষাট ফিট পেড়িয়ে গাড়ি ড.এম আর খানের হাসপাতাল বামে রেখে বড় রাস্তায় ওঠে।
শুক্রবার বলে রাস্তা খালি,বেশ দ্রুতই চলে এসেছে ওরা। মিরপুর ছয় নম্বরে বাজারের কাছে এসে ওরা উবার ছেড়ে দেয়। বাজারে নেমে রাকিব পেয়ারা, আমলকি, জামবুরা, আঙুর এসব কেনে।
মনসুর মিটিমিটি হাসছে। তুই এসব ফল দিয়ে সোহিনী দেবীকে নৈবেদ্য দিচ্ছিস নাকি?
আরে ধুর। খালি হাতে যাবো? দই মিষ্টি এসব নিতে আমার ভাল লাগে না।
বাজার থেকে একটু সামনে আগালেই বামে সোহিনীদের বাসা। ক্রিম-কালারের বাড়ি, ছাদে অনেক গাছপালা দেখা যাচ্ছে। গাছে কলা ধরে আছে।
সোহিনীর ফোন।
কী ব্যাপার আপনারা কোথায়? এত দেরি।
বাসার সামনে। গেট খোলেন।
আঠারো উনিশ বছরের বেশ ভারী গড়নের একটা মেয়ে এসে কলাপসিবল গেট খুলে দেয়। বসার ঘরে সোহিনীর বর মোস্তফা বেতের সোফায় বসে ছিল। ওদের দরজায় দেখে এগিয়ে আসে। সোহিনী উচ্ছ্বসিত হয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়।
রাকিব হাত মেলায়। রাকিব বলে আমার বন্ধু মহসিন। সবাই মিলে বসার ঘরে বেতের চেয়ারে বসে। মোস্তফা সম্পর্কে রাকিবের একটু অস্বস্তি ছিল। ওদের দেখে কেমন আচরণ করে। সহজভাবে নেয় কিনা কিন্তু মোস্তফা বেশ হাসিখুশি ছেলে, সহজ ভঙ্গিতে ওদের সাথে কথা বলে।
সোহিনী ভেতরে গিয়ে ট্রেতে করে আনারসের জুস এনে দেয়।
এখন আর কিছু দিলাম না, একটু পরেই তো দুপুরের খাবার দেবো।
মহসিন একটা গ্লাস তুলে নিয়ে বলে, শুনলাম আপনি বেশ ভালো ভাস্কর্যের কাজ করেন।
সোহিনী হেসে বলে তেমন কিছু না। এটা আমাদের বংশীয়। সবাই কিছু না কিছু কাজ জানে। দেখতে দেখতে শিখে গেছি।
আপনাদের দেশের বাড়ি কোথায়?
মানিকগঞ্জ।
ওহ্ আচ্ছা।
আর আপনার?
ফরিদপুর।
ফরিদপুরের কোথায়?
নগরকান্দা, তবে ঝিলটুলিতে দাদা বাড়ি করেছিলেন।
ও আচ্ছা। আমার মায়ের বাড়ি ফরিদপুর।
মোস্তফা বলে আমি কিন্তু আপনাদের গোত্রভুক্ত নই, আমার ময়মনসিংহে বেড়ে ওঠা।
মহসিন বলে ময়মনসিংহ তো সব গ্রেটম্যানদের জন্ম। উপেন্দ্রকিশোর থেকে সত্যজিৎ, কবি চন্দ্রবতী।
রাকিব এতোক্ষণ ওদের কথা শুনছিল, এবার বলে ময়মনসিংহে আমার যাওয়া হয়নি। অফিসের কাজে মধুপুর পর্যন্ত গিয়েছি, অপূর্ব সুন্দর। আমাদের সমতল ভূমি থেকে মাটি, বাতাস সবকিছু আলাদা। মান্দিদের জীবন-সংস্কৃতি এতোটাই আলাদা, তুলনা করা যায় না। বছরের পর বছর পাশাপাশি বসবাস করেও ভিন্ন সংস্কৃতি বয়ে নিয়ে চলে একেকটা জাতি।
মোস্তফা বলে শুনেছি আপনার তো ইংরেজি সাহিত্য, এখনকি নৃবিজ্ঞানে ঝুঁকেছেন নাকি?
আমার যে কিসে আগ্রহ নেই, সেটা বলা মুস্কিল।
সোহিনী বলে, রাকিব তো লেখালেখিও করে। একটা উপন্যাস প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।
মহসিন লাফিয়ে ওঠে।
খুবই ভাল খবর। তাহলে আজ রাকিবের বই বের হওয়া উপলক্ষ্যে আমরা ব্ল্যাক লেবেলটার সদ্ব্যবহার করতে পারি। মহসিন পিঠে ঝোলানো ব্যাগ থেকে ব্ল্যাক লেবেলটা বের করে কাচের টেবিলে রাখে। একটু ঝন করে শব্দ হয়।
সোহিনী বলে বাসায় পার্টি এটাই ভাল। মোস্তফা ব্ল্যাক-লেবেলের বোতলটা একটু হাতে নিয়ে দেখে বলে জাহাঙ্গীরনগরে পড়ার সময় কত কী যে খেয়েছি তার হিসাব নাই।একবার শুনলাম লাইব্রেরির উল্টোপাশে মহুয়া গাছে মহুয়া এসেছে। সেই মহুয়া এনে সিদ্ধ করে জ্বাল করে খাওয়া হলো।
রাকিব বলে আপনাদের ইউনিভার্সিটিটা ইউনিক। আমার খুব ভাল লাগে। চলেন একবার সবাই মিলে যাই।
সোহিনী হৈ হৈ করে ওঠে। আমারও অনেকদিন যাওয়া হয় না। আপনিও চলেন মহসিন।
মহসিন বলে গেলে তো ভালোই হয় কিন্তু আমার সময় খুব কম। আপনাদের সাথে মিললে অবশ্যই যাবো।
সোহিনী খাওয়া-দাওয়ার বিশাল আয়োজন করেছে। খিচুড়ি, পোলাও, মুরগির ঝালভুনা, হাঁসের মাংস, চিংড়ি ভাজা, বেগুন ভাজা, সবজি, সালাদ।
এ তো এলাহি কাণ্ড। আপনি সব করলেন আজ ?
মোস্তফা বলে সোহিনী তো রান্না-বান্নায় পাকা ওস্তাদ। হলে বসে সারাদিন রান্না করতো।
সোহিনী বলে এই কখন?
কেন হলে খাবার নিয়ে আসতে না?
সে তো হঠাৎ দু-একদিন।
মহসিন বলে আমাদের সে ভাগ্য হয়নি।
রাকিব চোখ বড় বড় করে তাকায় মহসিনের দিকে। তোর ভাগ্য হয়নি নাকি তুই তাদেরকে পাত্তা দিস নাই।
সোহিনী বলে কেন কতজন?
রাকিব বলে সিক্রেট ফাঁস করে দিতে চাই না।
সোহিনী বলে কেন সিক্রেট ফাঁস করে দিলে পরে মহসিন ভাই আপনাকে ধোলাই দিবে।
সবাই মিলে হৈ হৈ করে খেয়ে রান্নার প্রশংসা করতে থাকে।
সত্যি খিচুড়িটা দারুন হয়েছে। রাকিব বলে।
মহসিন বলে আমি সব খাবার খেয়েছি, প্রতিটাই প্রথম শ্রেণীর। কোনোটায় সেকেন্ড গ্রেড দিতে পারছিনা আর মাসির আচার আমি নিয়ে যেতে চাই। মোস্তফা মহসিনের চাপল্যে হাসতে থাকে। সবাই মিলে শোয়ার ঘরের মেঝেতে বিছানো কার্পেটে বসে।
সোহিনী ট্রেতে করে গ্লাস,বরফ আর কিছু বাদাম নিয়ে আসে।
খেতে খেতে মোস্তফা গিটার বের করে বাজাতে থাকে। সোহিনীর অনুরোধে রাকিব কয়েকটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়, সোহিনীও গলা মেলায়।
মহসিন বলে তবলা বাজানো ছাড়া আমি আর কিছু পারিনা।
সন্ধ্যায় মোস্তফা বলে ওর একটা কাজ আছে সেখানে যেতে হবে।
রাকিবরাও উঠতে চায়। মোস্তফা বলে না না আপনারা থাকেন। জরুরি বলে আমি যাচ্ছি। রাকিবের একটু অস্বস্তি হয়। সোহিনী বলে আপনারা এখন কোথায় যাবেন? শিউলি বিহারীদের বানানো কাবাব আনতে গেছে। মিরপুরে এসে কাবাব না খেয়ে যাওয়া যাবে না। মোস্তফা বেরিয়ে গেলে ওরা তিনজনে সন্ধ্যায় ছাদে যায়। কাবাব-টাবাব খেয়ে রাত আটটার দিকে বেরিয়ে পড়ে। মহসিন বলে, তোর সোহিনী বেশ ইন্টারেস্টিং মেয়ে।
কেন তুই আবার প্রেমে পড়ে গেলি নাকি?
আরে ধুর। প্রেম আবার কী? অনেক করেছি। বস্তাপচা বাংলা সিনেমা। দুজনে দুজনার, হ্যান-ত্যান, বিয়ে করো, সংসার, বাচ্চা বানাও, ফ্ল্যাট কেনো।
হা… হা… তুই এসব করেছিস?
করবো না বলেই তো চম্পট দিচ্ছি।
ভাল। তুই যা ভাবছিস ওখানে গিয়ে আমেরিকান মেয়ের সাথে লিভিং টুগেদার করবি। ওরাও অনেক কিছু ডিমান্ড করবে।
তা করবে, কিন্তু নিজের জীবনটাকে আলাদাভাবে দেখতে শিখেছে ওরা। যা এখানে আমরা শিখিনি। সেজন্যই যত সমস্যা। আমরা ব্যক্তি হয়ে উঠতে শিখিনি। সবকিছুই পরিবারকে ঘিরে, না হলে সমাজকে ঘিরে। আমার সবকিছুতে এতো যৌথ বিষয়টা ভালো লাগে না।
একেক সংস্কৃতি একেক রকম। তুই যেটা পছন্দ করছিস, চাইছিস,তা পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যাবাদী অস্তিত্ববাদ। ওরা বহু বছর ধরে নিজেরা স্বাধীন হতে শিখেছে যা আমাদের এশিয়ান ভ্যালুজ বা বলা যায় ভারতবর্ষের পারিবারিক মূল্যবোধ থেকে আলাদা।
পশ্চিমে আগে রক্ষণশীল পারিবারিক মূল্যবোধ ছিল এবং এখনও আছে। দূর থেকে ঠিক বোঝা যাবে না। তবে তারপরেও ওদের ওই ব্যক্তি হয়ে ওঠাটা আমাকে টানে। বারবার নিজেকে তৈরি করতে ইচ্ছে করে, ভাঙতে ইচ্ছে করে।
রাকিব বলে কর। দেখ গিয়ে কী অবস্থা, কেমন লাগে।
তুইও চল। তোর এখানে থাকার দরকার কি? শান্তা তো ভেগেছে।
আমি কারো জন্য এখানে থাকছি না, নিজের জন্যই আছি। তবে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছা আছে।
আমিও তো সেটাই বলছি।
দেখি আগে ইউনিভার্সিটিতে কী হয়।
তোর ইন্টারভিউর তারিখ পড়েছে?
হুম।
গুড। উইশ ইউ গুড লাক মাই ফ্রেন্ড।
রাকিব বুড়া আঙুল দেখায়।
অফিসের কাজে রাকিবকে মধুপুর যেতে সোহিনীকে জানায়।
হ্যালো সোহিনী পরশু মধুপুর যাচ্ছি,মান্দিদের গ্রামে কিছু সাক্ষাৎকার আর সার্ভে আছে। আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন।
ওহ্ তাই খুবই ভাল হয়। আমিও যেতে চাই। স্কুলে কাল জানিয়ে দেব।
সমস্যা হবে না তো ?
না না আমার ছুটি পাওনা আছে।
আচ্ছা তাহলে পরশু আমি আপনাকে তুলে নিচ্ছি।
অফিসের ট্রান্সপোর্ট?
হ্যাঁ।
ফোন রেখে রাকিব কাকলি আপার রুমে ঢোকে, গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু লিখছেন, একবার ভাবে চলে যাবে কিন্তু কাকলি আপা রাকিবকে দেখতে পেয়ে বলে আসো আমি তোমাকে ডাকবো ভাবছিলাম। গিদিমার কেসটা নিয়ে আরও কিছু তথ্য পেলাম কিছু লিঙ্কে।
রাকিব বলে আমি সেনসাস পেপার তৈরি করছি। পরশু সব পূরণ করতে দিয়ে দেব। ওখানকার একজন নেতাগোছের একটা তরুণ ছেলের কাছে। আর আমি প্রয়োজনীয় কিছু সাক্ষাৎকার রেকর্ড করবো। সব ঠিক করা আছে, বৃষ্টি না এলেই হয়।
হুম বৃষ্টি হলে একদম কাদা হয়ে যাবে, কাজ করতে পারবে না, ওরাও সহযোগিতা করবে না। আমি তোমাকে প্রিন্ট দিয়ে দিচ্ছি এগুলো একটু দেখো।
ওকে। আপনার ভূটান ভ্রমণ কেমন হলো?
ওহ্ দারুন। অদ্ভূত সুন্দর জায়গা। শান্ত পাহাড়, প্রকৃতির সান্নিধ্য যাকে বলে, তোমরা একবার সবাই মিলে ঘুরে আসো।
হুম দেখি। ওহ কাকলি আপা ইউনিভার্সিটিতে আমার ইন্টারভিউর তারিখ পড়েছে।
বলো কি? কবে?
এই তো সামনের মাসে।
হুম, এখন আমাদের কাজের যে অবস্থা তুমি চলে গেলে অথৈ সাগরে পড়বো।
না না তা কেন? সবুজকে আমি সব ট্রেনিং দিয়ে দিয়েছি, আর আমি তো আছিই। আর ইন্টারভিউ দিলেই চাকরি হয়ে যাবে এমন নয়।
তোমার হয়ে যাবে।
রাকিব মৃদু হেসে টেবিলের উপর থেকে প্রিন্ট আউটগুলো নিয়ে নিজের ডেস্কে এসে বসে।
ফেসবুকে চোখ যেতেই শান্তাকে অনলাইনে দেখতে পায়। প্রবল কথা বলার ইচ্ছে হয় কিন্তু নিজেকে দমন করে ফেসবুক থেকে বের হয়ে যায়।
সোহিনীর নতুন নাটকটা প্রথম মঞ্চে প্রদর্শিত হবে, সেজন্য দিনরাত খাটতে হচ্ছে। স্কুল থেকে এসে খেয়েই শিল্পকলা একাডেমির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়তে হয়। আজ মোস্তফার কাজ নেই তাই সারাদিন বাসায়। স্কুল থেকে এসে কাপড় বদলাতে গেলে মোস্তফা সোহিনীকে বলে তোমার দোস্ত দুটি ভালোই জুটিয়েছো। কোত্থেকে পেলে?
ওই যে এনজিওতে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে রাকিবের সাথে পরিচয় হলো। মহসিন তো রাকিবের বন্ধু।
মহসিনকে দেখেছো খুব স্মার্ট ছেলে, তোমাকে দেখছিলো বারবার।
আরে না, উনি অনেক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন।
ব্যক্তিত্বসম্পন্নরা কি মেয়েদের পছন্দ করে না?
আমার সাথে ওদের বিষয়টা ঠিক ওরকম নয়, নির্মল বন্ধুত্ব।
হুম বন্ধুত্ব ভালো, স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, মন ও দেহকে প্রফুল্ল রাখে। তবে সব বিষয়ে একটু সতর্ক থাকা ভাল।
বুঝি নাই।
মোস্তফা সোহিনীর চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, সব ব্যাচেলর ছেলে, ওদের আকর্ষণ তোমার প্রতি। দেখলে না প্রথম দিনই হুইস্কি নিয়ে হাজির।
তুমি বিষয়টাকে এভাবে দেখছো কেন? রাকিব তো আমার ভাল বন্ধু। অনেক মেধাবী আর ভদ্র। খুব পোয়েটিক ধরনের ছেলে।
মোস্তফা সোহিনীকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে একটা চুমু খায়।
এই জন্যই তো আমার ভয়। তুমি তো আবার আঁতেলদের প্রেমে পড়ে যাও।
তাই! বলে সোহিনী মোস্তফার সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ঠোঁটে গভীর চুমু খায়।
কেন আমি কতজনের প্রেমে পড়েছি?
মোস্তফা বলে সেটা হিসাব করে বলতে পারবো না, অসংখ্য।
তাই? বলে সোহিনী মোস্তফার বুকে শুয়ে থাকে।
তোমাকে নিয়ে আমার সবসময় দুশ্চিন্তা হয়। আমি প্রোডাকশনের কাজে বাইরে থাকি। তোমাকে একা থাকতে হয়। কখনো কোনো সমস্যায় পড়ো কিনা!
আশ্চর্য আমি একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে,কী সমস্যায় পড়বো?
তুমিতো একটু বেশি আবেগপ্রবণ। সবাইকে বিশ্বাস করো,সেই বিশ্বাসের মূল্য সবাই দিতে জানে না। আমাদের সমাজটা এখনও অনেক রক্ষণশীল। মেয়েদের সবাই সম্মান দিতে জানে না।
সোহিনী বলে তা জানে না, কিন্তু অনেকেই সম্মান দিতে জানে, সবাইকে এক কাতারে দেখলে চলবে না। মানুষকে যদি বিশ্বাস না করি তাহলে কাজ করবো কিভাবে? একত্রে বসবাস করবো কিভাবে?
হ্যাঁ মানুষকে বিশ্বাস করবে কিন্তু বুঝে-শুনে, কিছুটা দূরত্ব রেখে।
তুমি কি রাকিবরা আসাতে বিরক্ত হয়েছো?
না না ওরা ভালো ছেলে, ওদের নিয়ে বলছি না। নাটকের রিহার্সেলে যাও, স্টেজে কাজ করো কতো লোকের সাথে পরিচয় হয়। সবাইকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করো না। আর শিউলিকে বাসায় পার্মানেন্ট রেখে দাও, তোমার সুবিধা হবে, একা থাকতে হবে না। ঘরের কাজ করে সময় নষ্ট হবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে। সোহিনী মোস্তফাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। স্বপ্নে সোহিনী দেখে অসংখ্য পদ্ম ফুল ভাসছে সোহিনীদের বাড়ির পুকুরে। ঘাট-বাঁধানো পুকুর। সোহিনী পুকুরের স্বচ্ছ জলে সাঁতার কাটছে, একটু একটু করে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে, প্রচণ্ড মেঘ ডাকতে থাকে, শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি, ঝড়ো বাতাস, ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে। সোহিনী চোখে কিছু দেখতে পায় না, বৃষ্টির বড় বড় ফোটা তীরের ফলার মতো ওর চোখে -মুখে বিঁধতে থাকে। মাঝ-পুকুরে হাবু-ডুবু খেতে থাকে, সাঁতরে ঘাটে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই ঘাট দেখতে পায়না।
একটা কালীমূর্তি ভেসে বেড়াচ্ছে জলে। ঢাকের শব্দ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, সোহিনীর নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। হাতে একটা মরা ডাল আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করে। একটা চিৎকার দিয়ে জেগে ওঠে।
কী হয়েছে? মোস্তফা ঘুম ভেঙে দেখে সোহিনী বিছানায় বসে আছে। সারা শরীর ঘামে ভেজা।
না কিছু না,একটা দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম জলে ডুবে যাচ্ছি। এক গ্লাস পানি দাও।
খাটের পাশের ছোট টেবিলে রাখা বোতল থেকে পানি ঢেলে দেয় মোস্তফা।সোহিনী ঢকঢক করে পানি খেয়ে উঠে বাথরুমে যায়, চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দেয়, সালোয়ার তুলে হাঁটু পর্যন্ত পানি দিয়ে ভিজিয়ে নেয়। গায়ের টি-শার্টটা খুলে তোয়ালে ভিজিয়ে সারা শরীর মুছে নেয়।
গরম একদম সহ্য করতে পারে না সোহিনী। গ্রামের বাড়িতে থাকতে ওদের সকালে বাসি কাপড় ছেড়ে স্নান করতে হয়। তারপরও দুপুরে,সন্ধ্যায় স্নান করতো সোহিনী। ওর মা শিলারানী বলতো তুই যে এতোবার চান করিস, একেবারে বুকে ঠাণ্ডা বসে যাবে। তখন তোর বাবার ঐ হোমিওপ্যাথি আর তুলসীর রস খেয়ে কাজ হবে না।
সোহিনী হেসে মাকে বলতো ছোটবেলা থেকে এতো পুকুরে ডুব দিয়েছি আর রোদে ঘুরেছি যমেও আমাকে ধরবে না।
হুম যেদিন ধরবে সেদিন বুঝবি, মার কথা মনে হবে। সোহিনীরা তিন বোন। ঈশাণী, শিবানী তারপর সোহিনী ছোট। ওদের একটা ভাই ছিল শিবানীর পরে সে নিউমোনিয়া হয়ে পনেরো বছর বয়সে মারা যায়। শিলারানী ছেলের শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। সারাদিন ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকলেও সন্ধ্যায় যখন একটু অবসর হয় শিলারানী ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। দুই মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়,সোহিনী জাহাঙ্গীরনগরে পড়তে গিয়ে মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করে ফেলে। এতে বাড়ির লোকেরা সবাই ওকে ত্যাজ্য করতে চায়। একমাত্র শিলারানী মেয়ের পক্ষ হয়ে সব সময় লড়তে থাকেন। অনেক কষ্টে সোহিনীর বাবা নবীন পালকে বুঝিয়ে মেয়ে-জামাইকে বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করেন। বাড়ির অন্য আত্মীয়-স্বজনরা, সোহিনীর জ্যাঠা-জ্যাঠি, জ্যাঠাতো ভাইরা, তাদের পরিবার কেউ এ বিয়ে মেনে নেয়নি। সবাই ওদের ঘরে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকী সোহিনীর বড় দুই বোনের শ্বশুর বাড়ি থেকেও নানা অভিযোগ আসে। তারা ছেলের বউদের বাবার বাড়ি আসা বন্ধ করে দেয়। সোহিনী মাকে বলে, মা আমার জন্য সবার সাথে তোমাদের সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে, এটা আমার ভালো লাগে না, আমি বাড়িতে আসবো না। তুমি ওদের বলে দাও আমার সাথে তোমরা সম্পর্ক ছেদ করেছো। শিলারানী হেসে বলে, শোন এই মর্ত্যে বহু জাতি-ধর্মের মানুষ আছে। তারা মিলে-মিশে থাকে, কেউ যদি অন্য ধর্মের কাউকে স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে তাকে গোত্র-চ্যুত করার নিয়ম আছে, কিন্তু সে নিয়মের ব্যতিক্রমও আছে, আমি সে নিয়ম মানি না। ভালোবাসার কাছে সব নিয়ম তুচ্ছ। আমার নিজের জীবন দিয়ে তা বুঝেছি।
শিলারানীরা পাল বংশের কিন্তু কৈশোরে এক ব্রাহ্মণ ছেলের সাথে তার সম্পর্ক হয়, সেটা পরিবারের কেউ মেনে নেয়নি। এমনকী ছেলেটি শিলাকে বিয়ে করার কথা পরিবারকে বলতে সাহস পর্যন্ত পায়নি। শিলারানীকে বাবা-চাচাদের পছন্দে বিয়ে করতে হয়। সারাজীবন সে মনে মনে কষ্ট পেয়েছে। স্বামীকে দেবতার আসনে বসিয়েও চোখের জল ফেলেছে। সংসার বড় হলে ছেলে-মেয়েরা বড় হলে নানা ঝামেলা, কাজের চাপে কখনো তাকে ভুলে থেকেছে কিন্তু তরুণ বয়সের সেই প্রেম আজও তাকে বিষণ্ণ করে তোলে। শুনেছে ওরা পরিবারসহ কোলকাতায় চলে গেছে। একবারের জন্য দেখাও হয়নি। শিলারানী খুব কঠিন ধাতুতে গড়া। শ্বশুর বাড়ির চোখরাঙানি উপেক্ষা করে মেয়ের সাথে সম্পর্ক রেখেছেন, ঢাকায় মেয়ের বাসায় বেড়াতে গেছেন। স্বামী নবীন পাল তাকে বাধা দেয়নি, স্ত্রীর মনোবলের কাছে সে অন্যদের কথা তুলতে পারেনি। আর সোহিনী তার ছোট মেয়ে তার জন্যও অনেক অনুভূতি। মেয়েকে পুরোপুরি দূরে সরিয়ে দিতে পারেন নি।
সোহিনী শুয়ে শুয়ে মার মুখটা কল্পনা করে কেমন নিখুঁত চোখ-মুখ মায়ের যেন দুর্গা-মুর্তি। আর মায়ের ব্যক্তিত্বও দেবীর মতো। বহুভূজা মায়ের জন্য মনটা অস্থির হয়ে ওঠে।

১৪
আজ সোহিনীকে নিয়ে মধুপুরে যাওয়ার কথা।রাকিব বেশ ভোরে উঠে দেখে মা নামাজ পড়ে বিছানায় জায়নানামাজের উপর ঘুমিয়ে আছেন। মাকে না ডেকে হামিদাকে ডেকে তোলে। হামিদা দ্রুত এক কাপ চা আর ডিম অমলেট করে দেয়। রাকিব ফ্রিজ থেকে পাউরুটি বের করে ডিম অমলেট দিয়ে খেয়ে নেয়। হামিদাকে বলে মাকে না ডাকতে। একটা ছোট ব্যাগে টুকিটাকি কিছু জিনিস,ল্যাপটপ,রেকর্ডার নিয়ে নেয়। বড় দুটো বোতলে পানি আর রাতে কিনে আনা চিপস, বিস্কুট, আপেলের প্যাকেটটা গাড়িতে তোলে। ওখানে খাবারের হোটেল আছে রাস্তায় খাবার জন্য এসব নিয়েছে রাকিব। হামিদা ফ্লাস্কে চা বানিয়ে দেয়। রাকিব চায়ে চিনি দিতে বারণ করে সোহিনী চিনি খায় না। গাড়িতে উঠতেই ফোন।
কোথায়?
অন দ্যা ওয়ে। আমি চলে আসছি, রেডি হয়ে নেন।
আমি তৈরি।
ওকে বাসার কাছে এসে কল করছি।
সোহিনী আজ একটা পাঞ্জাবি, জিনস আর দোপাট্টা পরেছে পায়ে কেডস, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ।
বাহ্ আপনি তো আজকের জন্য একদম পারফেক্ট ড্রেস।
ছাতাও নিয়েছি দুটো যদি বৃষ্টি নামে।
ওহ্ ভাল করেছেন। আমার মনে ছিলো না।
গাড়ি মিরপুর বারো নম্বরের ভেতর দিয়ে সাগুফতা মোড় পার হয়। কালশীর বিলের কালো জলের দিকে তাকিয়ে রাকিবের মনে পড়ে এখানে শত শত বাঙালির লাল রক্ত আজ কালো জলে পরিণত হয়েছে। সকাল বেলায় রাস্তায় গাড়ির বিশাল বহর। এয়ারপোর্ট রোডে রাস্তা কিছুটা ফাঁকা পাওয়া যায়।রাকিব ব্যাগ থেকে চায়ের ফ্লাস্ক আর চিপস বের করে। বাহ্ আপনি চা করে নিয়ে এসেছেন? আমি তো ভাবলাম কোনো রেস্টুরেন্টে ঢুকে চা খাবো, নাস্তা খাবো।
এখন দেরি করা যাবে না। তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে। ওদিকটায় কী অবস্থা কে জানে। সিরিন নকরেককে একটা ফোন করে রাকিব।
যাক সবকিছু ঠিকঠাক আছে।
আপনি তো কাজের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস, শেষে আমাকে বিরক্ত না লাগে।
আরে না বিরক্ত লাগবে কেন? আপনার সাথে জার্নি করছি এটা দারুণ লাগছে। যদিও কাজের চিন্তা মাথায় আছে কিন্তু ভালো লাগছে। আর কাউকে কখনো বিরক্ত লাগতেই পারে। তার মানে এই নয় তার ভাললাগাগুলো বাতিল হয়ে যাবে। খারাপ এবং ভালোলাগা দুটোই জীবনের অনুষঙ্গ। নিজের কাছে নিজেকেও মাঝে মাঝে অসহ্য ঠেকে।
হুম বুঝলাম দার্শনিক সাহেব।
সোহিনী ব্যাগ থেকে নাড়ু বের করে।
বাহ্ নাড়ু? মাসি এসেছিলো?
না মা একজনের মাধ্যমে প্রায়ই নাড়ু,মোয়া পিঠা এসব পাঠায়। মোস্তফা খুব পছন্দ করে।
ও আচ্ছা। আপনার পতি দেবতাটি কিন্তু বেশ।
তাই, কেমন?
ফ্রেন্ডলি, সাদাসিধে।
হুম, আপনি তো আবার সাদাসিধে না।
হা… হা… তা ঠিক। মা বলে তুই দিন দিন জটিল হয়ে যাচ্ছিস।
মহসিন কেমন আছে?
ভাল। ও সবসময় ভালো মুডে থাকে। ভালো থাকার মন্ত্র ওর জানা আছে।
কাকলি আপার ফোন।
হ্যালো।
হুম রাকিব এখন কোথায় তোমরা?
এইতো জয়দেবপুর পার হচ্ছি। আমার সাথে কিন্তু আমার এক বন্ধুও যাচ্ছে।
খুব ভালো, নো প্রোব্লেম। কাজটা শেষ করে আসো সবাইকে নিয়ে বসবো। শুটিং এর প্ল্যান করে ফেলতে চাই।
ওকে কাকলি আপা, চিন্তা করবেন না।
বাই।
সোহিনী বলে আপনার বস বেশ আধুনিক তাই না?
হুম। এনজিও লাইনে এমনই হয়। সরকারি পর্যায়ে বেশি বসিং বিষয়টা থাকে।
আচ্ছা আপনি কী করতে চাইছিলেন। সব রেডি করে এনেছেন?
সোহিনী বলে হ্যাঁ আমি মান্দিদের কিছু নাচের ভিডিও করতে চাই আর ওদের গান রেকর্ড করবো। ওদের ছড়া, কবিতা যদি পাই কিছু।
এসব কি নাটকের কাজে লাগবে?
হ্যাঁ আমাদের দল একটা নতুন নাটক করছে সেখানে আমি একজন মান্দি মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করছি। মেয়েটি ঢাকায় এসেছে কাজের সন্ধানে, পার্লারে চাকরি নিয়েছে। তার পূর্ব জীবনে সে মান্দিদের পালা-পার্বনে গান গাইতো, নাচতো।
হুম, আপনি তাহলে গান-নাচ সবই জানেন।
নাটক করতে গেলে সব কিছুই একটু জানতে হয়।
সেদিন তো চাপাচাপি করে আমার গান শুনে নিলেন, নিজে গাইলেন না।
কেন তাল দিয়েছি তো।
আচ্ছা একদিন আপনার গান শুনবো,আজও হতে পারে। মধুপুরে কোনো নির্জন গড়ের পাশে।
সোহিনী বলে বেশ রোমান্টিক মুডে আছেন মনে হয়।
নারে ভাই, রোমান্টিক আর হতে পারলাম কই? অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল।
কেন কী বিনষ্ট হলো?
না কিছু না, রাকিব অন্যমনস্ক হয়ে একটা সিগারেট ধরাতে চেষ্টা করে। পরে নিভিয়ে ফেলে।
না, না খান, আমার কোনো সমস্যা নাই।
না এসি গাড়িতে সিগারেট খাবো না, নেমে খাবো।
আপনার কথা এখন বলতে না চাইলে বলবেন না।
রাকিব বলে ঠিক আছে পরে কখনো বলবো।
মধুপুরে ওরা গিদিমা রেমাদের মাগাস্তিনগর গ্রামে যাওয়ার পথে এক জায়গায় গাড়ি থামায়। ক্যামেরা, ল্যাপটপ, ব্যাগ সব নিয়ে রওনা হয়। ওখানে সিরিন নকরেক ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বন বিভাগের সৌজন্যে বনের ভেতরে রাস্তা তৈরি হয়েছে। সিরিন বলে, এই সব বন, সারি সারি শাল-সেগুন গাছ সব এক সময় আমাদের ছিল। আমরা তো বনেরই সন্তান।কিন্তু এ বন আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে।
রাকিব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, মান্দিদের উপর ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে জোর -জুলুম হয়েছে তার কথা ভেবে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
সিরিন নকরেক রাকিবদের মাগস্তিনগর গ্রামে নিয়ে যায়। পথে সারি সারি শালবন, উঁচু-নিচু পথ, লাল মাটি, রাতে বৃষ্টি হয়েছে, মাটিতে সোঁদা গন্ধ।
সোহানী চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পথ চলছে। গ্রামে পৌঁছালে অনেকেই ওদের দেখে এগিয়ে আসে। সিরিন নকরেক অনেককে খবর দিয়ে রেখেছিল এনজিও থেকে লোক আসবে, কথা বলবে, ছবি তুলবে।
এত লোক দেখে রাকিব প্রথমে একটু ভড়কে যায়। সবাইকে গিদিতা রেমার বাড়িতে উপস্থিত থাকতে বলে, যা কথা-বার্তা হবে ওখানেই হবে।
সিরিন নকরেক পূর্ণা সাংমার সাথে সোহিনীকে পরিচয় করিয়ে দেয়। সোহিনীকে পূর্ণা সাংমা বাড়ি নিয়ে যায়,ওখানে পূর্ণার মা সুচন্দা সাংমা মান্দি ভাষায় গান জানে, ছড়া জানে, নানা কিছু জানে।
রাকিব ধীরে ধীরে হেঁটে সিরিন নকরেকের সাথে গিদিতা রেমাদের বাড়ি যায়। সামনের উঠানে অনেক জায়গা, পাটি পাতা হয়েছে। রাকিবের জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাকিব সবার সাথে পাটিতেই বসে। গিদিতার এক ভাই জানায়, গিদিতার বোন নম্রতা চারজনের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরেই হাবিবুর রহমান গংদের সাথে গিদিতাদের পরিবারের জমি সংক্রান্ত বিরোধ। গিদিতার পরিবার হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিল। চার বছর পর ওরা সুদে আসলে চল্লিশ হাজার টাকা দাবি করে। গিদিতার পরিবার এত টাকা দিতে না পারায় গ্রামে সালিশ হয়। হাবিবুর রহমানরা গিদিতাদের দশ একর জমি দখল করে নিতে চেষ্টা করে। পরে সালিশে মীমাংসা হয় গিদিতার পরিবার হাবিবুর রহমানদের সোয়া দুই একর জমি দেবে যার মূল্য প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। গিদিতারা এই সালিশ মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই জমি পাওয়ার পরও হাবিবুর রহমানরা ওদের দশ একর জমি দখল করে নিতে চায়। গিদিতার ছোট বোন নম্রতাকে বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয়। গারো সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। মেয়েরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। ছেলেরা একটু বড় হলে নকপে মানে অবিবাহিতদের থাকার জায়গায় চলে যায়, পরে বিয়ে হলে শ্বশুর বাড়িতে। সাধারণত নির্বাচিত বা ছোট মেয়েকে সম্পত্তি দেয়া হয়। নম্রতা সম্পত্তি পাবে এজন্যই তাকে অপহরণ করা হয়। হাবিবুর রহমানের ভাই মফিজ ইসলাম নম্রতাকে ধর্ষণ করে, পরে ইসলাম ধর্মে দিক্ষীত করে। মফিজ বলে নম্রতার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে। নম্রতা গোপনে বড় বোন গিদিতা রেমার কাছে খবর পাঠায়। গিদিতা গ্রামের লোকজনের সহায়তায় নম্রতাকে উদ্ধার করে। এরপর মফিজ ও তার দলবল গিদিতাকে হুমকি দিতে থাকে। এলাকার চেয়ারম্যানও মফিজদের সহায়তা করে। নম্রতাকে ফিরিয়ে দিতে বলে না হলে বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে বলে ভয় দেখায়। এরপরেই বাজারে যাওয়ার পথে মফিজের দল গিদিতাকে হত্যা করে। এ নিয়ে নানা প্রতিবাদ হয়। মফিজরা গ্রেফতার হয়।
রাকিব অনেকের সাথে কথা বলে গিদিতার বিষয়ে আরও তথ্য যোগাড় করে। যে জায়গায় গিদিতাকে হত্যা করা হয় সেখানকার ছবি তোলে, ভিডিও করে।
গিদিতাদের বাড়ি থেকে রাকিব সোহানীকে ফোন দেয়,
আপনি কোথায়?
আমি তো এখনও পূর্ণা সাংমার বাড়িতে আছি। কিছু গান রেকর্ড করলাম।
বাহ্ ভাল। কিছু কাজ হয়েছে তাহলে।
হ্যাঁ।
রাকিব বলে আমার খুব খিদে পেয়েছে সিরিন নকরেকদের বাড়ি যেতে হবে ওরা খাবারের আয়োজন করেছে।
সোহিনী বলে আমি তো এখানে খেয়েছি।
ও আচ্ছা।
রাকিব বলে তাহলে আপনি ওদের সাথে থাকেন। আমি আপনাকে ফোন দেব।
রাকিবের ইচ্ছে ছিল সোহিনীকে নিয়ে বাজারের হোটেলে খাওয়ার। কিন্তু সিরিন নকরেকদের বাড়িতে না খেলে খুব দুঃখ পাবে এজন্য রাজি হয়। সিরিনদের বাড়িতে ওকে লাল চালের ভাত, খুব ঝাল দিয়ে মুরগির মাংস আর কয়েক রকমের সবজি খেতে দেয়া হয়। সবজিতে শুটকির গুঁড়া দেয়া হয়েছে। ভিন্নরকম একটা গন্ধ আসছে। খাওয়া-দাওয়ার পর সিরিনকে জরিপের ফর্মগুলো কিভাবে পূরণ করতে হবে বুঝিয়ে দিয়ে পূর্ণা সাংমার বাড়ি যায়। গাছ দিয়ে ঘেরা বাড়ি, ভেতরটা ঠাণ্ডা। একটু উঁচুতে বাড়ি। ঢোকার পথেই ডালিম গাছ। কিছু গোলাপ ফুটে আছে বাগানে। বাগান সুন্দর করে বেড়া দিয়ে ঘেরা। রাকিব বাড়ির ভেতর ঢুকতেই মেয়েরা সব এগিয়ে আসে। সোহিনীকে দেখতে পাচ্ছে না। হঠাৎ মেয়েদের ভেতর থেকে একজন বলে ওঠে কী চিনতে পারছেন না? সোহিনী মান্দিদের একটা ব্লাউজ আর পেটিকোটের মতো পোশাক পরেছে। নীল রঙের হাতেবোনা পোশাকে অন্যরকম লাগছে। গলায় মোটা ব্রোঞ্জের মালা সাথে নানা পুঁতি দিয়ে গাঁথা মালা। সোহিনী বলে এর নাম রিপক আর কানেও মোটা ব্রোঞ্জের দুল, হাতে ব্রেসলেট। মাথায় পোশাকের কাপড় দিয়েই পট্টির মতো বাঁধা। মেয়েরা সবাই আজ সাজগোজ করেছে। রাকিব ওদের ছবি তুলতে থাকে। সোহিনীকে ঠিক যেন একটা মান্দি মেয়ে মনে হয়। ওখান থেকে বের হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে। সিরিন নকরেক ওদেরকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এর মধ্যে রাকিব একবারও ধূমপান করার সুযোগ পায়নি। গাড়ির কাছে গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে।
সোহিনী বলে রাকিব আমার তো এখানে থেকে যেতে ইচ্ছে করছে।
তাই? থেকে যান, আমি চলে যাই।
সত্যি?
হ্যাঁ আপনি যদি ওদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন তাহলে থাকেন। আমার সমস্যা কি?
হুম, তার মানে আপনার সাথে আসলাম, সেটা কোনো বিষয় নয়।
হুম। কিন্তু কারো মনের স্বাধীনতায় আমি বাধা হতে চাই না।
সোহিনী নিজের পোশাক পরে এসেছেন হাতে এক সেট মান্দিদের পোশাক। একটা লাল হাতে বোনা গামছা রাকিবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে এটা আপনার।
ওরে বাবা এর মধ্যে কেনাকাটাও করে ফেলেছেন।মেয়েরা এই কাজটা ভাল পারে।
মেয়েরা কেন, আপনার ইচ্ছা হলে আপনিও করেন।
না এখন কিছু কেনাকাটা করতে ইচ্ছে করছে না।
গিদিতা রেমার হত্যার বর্ণনা শুনে মনটা খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।
হুম,সম্পত্তির জন্য সেই আদিকাল থেকে মানুষ লড়াই করে মরছে।
রাকিব বলে, আগে যখন রাষ্ট্র ছিল না। একেক জাতি নানা গোত্রে গোষ্ঠিবদ্ধ হয়ে থাকতো তখন খাবার, পানি, ভূমির জন্য অন্য গোত্রের মানুষের সাথে দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদে লিপ্ত থাকতো। এখন আধুনিক রাষ্ট্র হয়েছে কিন্তু সেই কামড়া-কামড়ি রয়ে গেছে। এটা হয়তো চিরন্তন, চলতেই থাকবে। তবে মান্দিরা নিজের দেশে, নিজের ভূমিতেও নিজেদের অধিকার নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না। এই আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্র বনের উপর ওদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু ওরা তো বনের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে বসবাস করে, কোনো ক্ষতি করে না। আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা দেশটাকে শুধু নিজেদের সম্পত্তি ভাবতে শুরু করেছি। এখানে যে অন্য জাতি-ভাষার মানুষ আছে তা যেন গ্রাহ্যই করতে চাই না।
সোহিনী বলে হ্যাঁ এটা খুব খারাপ আচরণ। তারপরেও ওরা কত সহজভাবে আমাদের গ্রহণ করেছে। আমাকে মেয়েরা নাচ দেখালো, গান করলো নিজেদের ভাষায়। মান্দিরা যদি নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে নিজেদের ভূমিতে বেঁচে থাকতে চায় এটা কি তাদের অপরাধ? রাকিব গাড়ির বাইরে তাকিয়ে দেখে একদল মান্দি পুরুষ পরনে লুঙ্গি, গায়ে হাতে বোনা গেঞ্জি মাথায় করে শুকনো ডালপালা নিয়ে চলেছে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত