“কেউ জানতে চায়নি” -( নবম , দশম এবং একাদশ অংশ)


অফিস থেকে রাকিবকে নতুন প্রামাণ্য চিত্রের জন্য রাঙামাটি পাঠানো হয়। জায়গাটা দেখার জন্য সুফিয়ান এবং মিডিয়া সেকশনের নম্রতা আর সবুজও যায়। যাওয়ার পথে গাড়িতে সারাপথ রাকিব মনমরা হয়ে থাকে। শান্তার জন্য একটা বুকচাপা কষ্ট হতে থাকে, একটা হাহাকারের মতো। মনে হয় সবকিছুই চলছে কিন্তু ওর যেন কোনো কিছুতেই আনন্দ নেই, শান্তি নেই। পোড়া দগদগে একটা মন নিয়ে থাকতে হচ্ছে সারাক্ষণ। প্রায়ই শান্তার নম্বরটা বের করে ফোন করতে চায় কিন্তু আর করে না। শান্তা একদিন ফোন করেছিল রাকিব ধরেনি। ওর মনে হয় এখন শান্তার সাথে কথা ওর মনে শুধু যন্ত্রণার তৈরি করবে। ও এ যন্ত্রণা দূরে থাকতে চায়। মনে প্রবল কষ্ট আর এক ধরণের প্রত্যাখ্যানের অনুভূতি হয়। রাকিব ভাবতে চায় না শান্তা ওর সাথে কোনো খেলা খেলেছে, শান্তা তেমন মেয়ে নয়। কিন্তু এতোটা দিন ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে মেয়েটি কেন ওকে সঙ্গ দিলো? শান্তার কি ওকে আগেই জানিয়ে দেয়া দরকার ছিল না? রাকিবের বিষয়ে ও যে তেমন কিছুই ভাবেনি এটা রাকিবকে জানানো উচিত ছিল। গাড়ির জানালা দিয়ে রাঙামাটির আঁকা-বাঁকা পথ দেখতে দেখতে রাকিব কিছুটা ঢুলতে থাকে। সবুজ জিজ্ঞেস করে রাকিব ভাই ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?
না। কই নাতো।
না গাড়িতে ওঠার পর থেকেই কী এক ঘোরে ডুবে আছেন। সে জন্য আমরাও আপনাকে বিরক্ত করিনি।
রাকিব মৃদু হেসে আবার বাইরের দিকে তাকায়। ওরা রাঙামাটিতে পর্যটনের মোটেলে ওঠে। পর দিন বোটে চড়ে কাপ্তাই লেকে ঘুরে বেড়ায়। লেকের মাঝে বেশ কিছু বৌদ্ধ মন্দির। চমৎকার কারুকাজ। রাকিব সাথে করে ওর ক্যামেরাটা নিয়ে এসেছে। চাকমাদের নতুন রাজবাড়িতে যায়। কাপ্তাই লেকটা তৈরি করতে গিয়েই এক রাতের মধ্যে চাকমাদের বসতিতে পানি ঢুকে পড়ে। তলিয়ে যায় ক্ষেতের ফসলসহ ঘর-বাড়ি, গাছপালা, উপাসনালয় একটা সমগ্র জীবন। লেকের মধ্যে একটা কাঠের থামের মতো দেখা যায় ওখানে ছিল চাকমাদের রাজবাড়ি। রাজবাড়ির কুঠিটা দেখে রাকিবের মনে গভীর সমবেদনা জেগে ওঠে। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার জন্য একটা পুরো জাতির বসতি ধ্বংস করা হয়েছে। কে দিয়েছে তাদের এই অধিকার? পাকিস্তান সরকার ১৯৬০ সালে যা করেছে তা একটি নির্মম ঘটনা। বাংলাদেশে যে পঞ্চাশটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে তাদের সাথে অনেকক্ষেত্রেই বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছে, হচ্ছে। তাদের ভূমির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এই ভূখণ্ডের মানুষ হয়েও যেহেতু তারা সংখ্যালঘু তাই তাদেরকে দাবিয়ে রাখাটা সহজ। তারা যে ভিন্ন রাজনীতির দিকে চলে গেছে এটা করতে তারা বাধ্য হয়েছে। নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে গিয়েই হাতে অস্ত্র ধরেছে। দেয়ালে পিঠ না ঠেকলে কেউ তা করে না।
রাকিবদের দলটি রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ালো। চাকমাদের আবাসস্থলে গিয়ে সেখানকার লোকজনের সাক্ষাৎকার নিলো। কাকলি আপা বৈজু চাকমার ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিল। তার বাড়িতে যায় রাকিবরা। বাঁশের মাচার উপরে ঘর। বৈজু চাকমার স্ত্রী পানের বরজ তৈরি করেছে বাড়ির পাশের জমিতে। আনারসের ক্ষেতও করেছে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে।
রাকিবরা বৈজু চাকমার বাড়িতে গেলে সবাই ছুটে আসে কাজ ফেলে। কাকলি আপা ওদের অনেক আপনজন এখানকার বাচ্চাদের জন্য বেশ ভালো মানের একটা স্কুল তৈরি করতে সহযোগিতা করেছেন। নানা বিষয়ে বৈজু চাকমাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেন। কাকলি আপাদের প্রতিষ্ঠান থেকে এখানে বয়স্ক নারীদের জন্য একটা সমিতি করা হয়েছে। সেখানে চাকমা নারীরা নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলে, কোনো সহযোগিতা লাগলে চায়। চাকমাদের সমস্যা সমাধানের জন্য নানা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। একটা প্রকল্পের সাথে রাকিবও জড়িত। অবশ্য রাকিবদের এবারের কাজ চাকমা ও মধুপুরের মান্দি সম্প্রদায়ের জমি-জিরাত নিয়ে। জমির উপর তাদের কতটুকু অধিকার আছে, কতটুকু ভোগ দখল করতে পারছে এসব নিয়ে। একজন গারো নারীর জীবনচিত্র নিয়ে আরেকটা প্রামাণ্য চিত্র তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
মধুপুরের শালবন সমতল বনভূমির মধ্যে বৃহত্তর। ব্রিটিশ আমলে জমিদারি প্রথায় মধুপুর গড় ও তার বাসিন্দারা নাটোরের রাজার শাসনাধীনে আসে, ওই এলাকার সম্পত্তিকে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসাবে উৎসর্গ করা হয়। মান্দিরা শুধু উঁচু জমিতে লিজ নিয়ে চাষবাস করে এবং নিচু জমি নিজেদের নামে দলিল করে নিতে পারতো। মান্দিরা ১৮৯৭ সালে ভারতীয় প্রজস্বত্ব আইনের মাধ্যমে জমি প্রথম নিজেদের নামে নথিভুক্ত করতে পারে। ওখানকার জমি বেশিরভাগই রেজিস্ট্রিভুক্ত। কিন্তু পাকিস্তান আমলে সরকার আদিবাসীদের উপর উচ্ছেদের নোটিশ জারি করে। ন্যাশনাল পার্ক তৈরির জন্য এ নোটিশ দেয়া হয়েছিল। মান্দিরা যে জমিতে বসবাস করতো সেখানে ন্যাশনাল পার্ক তৈরির পরিকল্পনা হয়। ওই জমি মান্দিরের নামে রেজিস্ট্রিকৃত ছিল, মান্দিরা কর দিতো সরকারকে। চুনিয়া গ্রামের অধিবাসীদের ১৯৬৮ সালে প্রথম উচ্ছেদের নোটিশ দেয়া হয় কিন্তু কোনো ক্ষতিপূরণের কথা বলা হয় না। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ন্যাশনাল পার্ক নিয়ে মান্দিদের সাথে সরকারের আলোচনা হয়। তাদের জমি থেকে বনবিভাগ আনারসসহ নানা দ্রব্য নিয়ে যায় ইচ্ছামতো। ১৯৭৮ সালে আবার উচ্ছেদ নোটিশ জারি করে এবং অন্যত্র সরে গেলে মান্দিদের পরিবার পিছু এক একর জমি ও এক হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু যেখানে পুনর্বাসন করা হবে বলা হয় সেখানে বাঙালিরা বসবাস করতো।
রাঙামটি থেকে ফিরে রাকিব মধুপুরের মান্দিদের সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করে একটা সাক্ষাৎকার ও কিছুটা ফিচারধর্মী প্রামাণ্য চিত্র তৈরির কথা ভাবতে থাকে। শান্তাকে নিয়ে ন্যাশনাল পার্কে যাওয়ার স্মৃতি মনে হয়। মান্দিদের সম্পর্কে জানতে গিয়ে রাকিব বিস্মিত হয়। কী নৃশংস। একটা জাতির বসতি থেকে তাদের উচ্ছেদ করে সেখানে তুঁত চাষ করা হয়। মান্দিদের বসতিতে পার্ক বানিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। একজনের ঘর ভেঙে দিয়ে সভ্যতার মিনার তৈরি করছি।
রাতে বারবার শান্তার কথা মনে হয়। এতোদিনের সম্পর্কটা এতো সহজে মিলিয়ে গেল? নাকি মনসুর যেটা বলেছে শান্তা রাকিবের সঙ্গ উপভোগ করেছে কিন্তু ওকে সিরিয়াসলি নেয়নি। রাকিবেরই ভুল হয়েছে এতটা দিন নিজের অনুভূতিকে লুকিয়ে রাখাটা। মনটা বিষণ্ণ হয়ে আছে। পরদিন রাতে খাওয়ার সময় হাসিনা বেগম বলেন, কিরে রাঙামাটি থেকে আমার জন্য কিছু আনলি না?
ও হ্যাঁ রাকিব ভুলেই গিয়েছিল চাকমাদের তাঁতে বোনা কয়েকটা শাল এনেছে, কিছু না ভেবেই। তবে কেনার সময় শান্তার কথাই শুধু ভাবছিল। একটা শাল কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? না না রাকিব এসব কী ভাবছে? এসব পাগলামি আর করা যাবে না। শান্তা ওর প্রতি করুণা দেখাবে। দয়া করে শালটা রেখে দেবে বা অন্য কাউকে দিয়ে দেবে।
অফিসে পৌঁছাতে রাকিবের অনেক দেরি হয়ে যাবে। এমনিতেই ঘুম থেকে দেরিতে উঠেছে তার মধ্যে রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট। গাড়ি নড়ছেই না।পিঁপড়ার গতিতে চলছে। জাহাঙ্গীর গেটে প্রায় পৌনে একঘণ্টা বসে থাকে। অফিসে পৌঁছে শোনে কাকলি আপা ওকে কয়েকবার খুঁজেছে। হন্তদন্ত হয়ে কাকলি আপার রুমে ঢোকে। কাকলি আপা ল্যাপটপে কাজ করছিলেন। রাকিবকে দেখে বলেন, ওহ্ এতক্ষণে? আমি ভূটান ঘুরে এলাম আর তোমার দেশের মধ্যে রাঙামাটি থেকে আসতে এতো দেরি হলো?
রাকিব হেসে বলে, হুম আজ একটু দেরিতে রওনা দিতে এই অবস্থা। মহাখালী পর্যন্ত আসতে দুই ঘণ্টা লাগলো।ঢাকা শহরের কী অবস্থা। এতো ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে একটা শহর কিভাবে টিকে আছে ভাবতে অবাক লাগে।
হুম।
সবাইকে এখন অফিসের কাছাকাছি থাকতে হবে না হলে ভোর পাঁচটায় রওনা দিতে হবে। যাই হোক তোমার অভিজ্ঞতা বলো। কী মনে হচ্ছে এবারের কাজ নিয়ে?
আমি তো খুবই যুক্ত হয়ে গেছি মানসিকভাবে। রাঙামাটি আর মধুপুর বন,ওখানকার মানুষের বারবার ভূমি থেকে উৎখাত,জমি দখল,মালিকানার সমস্যা,নিরাপত্তাহীনতা সব অত্যন্ত অমানবিক। এতদিন এ নিয়ে খুব একটা ভাবিনি একই দেশের মধ্যে দুরকমের ব্যবস্থা, দুই আইন ।
মান্দিরা, চাকমা, মারমা এবং অন্য আদিবাসী মানুষদের যুগ যুগ একটা নির্দিষ্ট ভূমিতে বসবাস করলেও এখন পর্যন্ত তাদেরকে সংশয়ের মধ্যে কাটাতে হয়। কখন জমি থেকে, বসতি থেকে উৎখাত করা হয়।
কাকলি আপা বলে রাকিব আমি ঠিক এই বিষয়টাই ফোকাস করতে চাচ্ছি ডকুতে। কিছু ঐতিহাসিক তথ্য,সাক্ষ্য, স্থিরচিত্র। ব্রিটিশ আমল থেকে এ পর্যন্ত জমি কতবার হাত বদল হতো এসবের কাগজপত্র সব দরকার। কিছুটা স্ক্যান করে, ভিডিও করে দেখানো হবে।
রাকিব বলে, ওই সময়ের দলিল, ছবি কিছু পাওয়া যাবে। তবে অনেকের গলায় ভয়ের সুর। নিজেদের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে যদি আইন লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটে, সেটা নিয়ে সবাই চিন্তিত। আর এসব বিষয় নিয়ে এত বেশি জরিপ হয়েছে, গবেষণা হয়েছে সবাই কিছুটা বিরক্ত।
এ জন্যই তো তুমি আছো। তুমি সবাইকে বোঝাতে পারবে।
রাকিব বলে এতোটা কনভিডেন্স না থাকাই ভাল।
না থাকলে কাজ এগোবে কিভাবে?
রাকিব বলে হ্যাঁ তা ঠিক। সাহস না করলে কোনো কাজই করা যাবে না। মান্দিরা বছরের পর বছর লড়াই করে যাচ্ছে তাদের জমি, ফসলের জন্য। এজন্য গিদিমাকে প্রাণ দিতে হয়েছে, আরও অনেককে প্রাণ দিতে হচ্ছে।
কাকলি আপা বলে, তুমি স্ক্রিপ্টটা নিয়ে কাজ করতে থাকো। সাথে তনিমা, সবুজ ওদের নিয়ে নাও। যতবার লাগে মধুপুর যাও। অফিসের গাড়ি তোমাদের নিয়ে যাবে। বিশেষ করে গিদিমা হত্যা বিষয়ে আলাদা একটা ডকুফিল্ম হবে।
কাকলি আপার রুম থেকে বের হতে প্রায় বিকাল হয়ে যায়। কাকলি আপার সাথে কাজ করার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। আবিষ্কারের বিষয় আছে, নতুন কিছু জানার স্পৃহা তৈরি করে দেন তিনি মানুষের মাঝে।

১০
রাকিব ডেস্কে ফিরে মোবাইল খুলে দেখে সোহিনীর চারটা মিসড কল। এতক্ষণ ফোন সাইলেন্টে ছিল, ফোন দেখার কথা মনেই ছিল না। আর শান্তার ঘটনার পর ব্যক্তিগত বিষয়গুলোকে ভুলে থাকতে চাচ্ছে রাকিব। কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে কষ্টটা কিছুক্ষণ ভুলে থাকা যায়।
অফিস সহকারী সানোয়ারকে দিয়ে একটা বার্গার আনিয়ে খায়। লাঞ্চ-টাইম শেষ। কাকলি আপা আজ খাবারের কথা ভুলে গিয়েছিলেন কিন্তু রাকিবের খুব খিদে পেয়ে যায়।
সোহিনীকে ফোন করে। সরি আমি মিটিংয়ে ছিলাম।
হুম। ব্যস্ত আছেন ভেবেছি, তাই খাবার সময়ে ফোন করেছিলাম।
ওহ্ আচ্ছা কিন্তু খাওয়া এখনও হয়নি।
তাই? কেন? সময় পাননি?
ওই যে বসের সাথে মিটিং।
তা কেমন কাটলো রাঙামাটি?
ভালো। খুব সুন্দর জায়গা, মানুষগুলোও কিন্তু আমাদের মতো কিছু মানুষ তাদেরকে শান্তিতে থাকতে দেই না।
হ্যাঁ। তা ঠিক। এতো চিরকাল চলে এসেছে।
আবার মধুপুর যাচ্ছি। যাবেন?
আমাকে নেবেন সাথে?
নেবো।
কিন্তু আপনার অফিসের কাজে আমি গেলে সেটা খুব একটা ভাল দেখাবে না।
না সমস্যা নেই। আমাকে কয়েকবার যেতে হবে। আপনি একবার ঘুরে এলেন।
ওকে তাহলে খুব ভাল হয়। শুনেছি মান্দিদের নিজস্ব গান, কবিতা এসব আছে। সেখান থেকে কিছু সংগ্রহ করতে চাই।
তাহলে তো খুবই ভালো। বেড়ানোর সাথে কাজও হবে।
হুম। ওহ্ আমি যে জন্য ফোন করেছিলাম। সামনের শুক্রবারে আসেন দুপুরে।
দাওয়াত?
হা… হা… হ্যাঁ দাওয়াত।
গার্ল ফেন্ড আনা যাবে?
ওহ্ হো… হ্যাঁ আনা যাবে।
তো আপনার বয়ফ্রেন্ড থাকবে তো?
থাকবে বলেছে।
ওকে —- দুপুরে আসবো। সাথে বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে আসবো যদি তার সময় থাকে।
আপনার বয়ফ্রেন্ড?
হা… হা… হ্যাঁ।
আচ্ছা আর ওইসব তিতা পানি?
তারও ব্যবস্থা হবে। আমি কিন্তু খিচুড়ি খাবো।
ওকে হবে। হাঁসের মাংস চলবে তো?
অবশ্যই।
ওকে রাখি ভাল থাকবেন।
সোহিনীর সাথে কথা বলে রাকিবের বেশ ভাল লাগে, মনের ভেতরের গুমোট আবহাওয়াটা কিছুটা কেটে গেছে। বার্গার আর কফি খেয়ে ইন্টারনেট থেকে কিছু তথ্য খুঁজতে থাকে রাকিব। কাজ করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায়। সবুজ এসে বলে, রাকিব বাসায় যাবেন না?
হুম যাবো। এখনই উঠবো ভাবছিলাম।
সবুজের সাথেই বেরিয়ে পড়ে রাকিব। সাথে ল্যাপটপ থাকে তাই এখন উবারই ব্যবহার করে রাকিব। সবুজকে নিয়ে নেয় সঙ্গে।
রাকিব আপনার কাজে তো আমাদের ম্যানেজমেন্ট খুব খুশি।
কী এমন কাজ করলাম। এখন আমরা যে কাজে হাত দিয়েছি। এটা এত বিশাল পরিসর যে এর থেকে একটা এক ঘণ্টার প্রামাণ্য চিত্র বানানো সত্যি কঠিন।
হুম, আপনি খুব সিরিয়াসলি করছেন তাই এমন মনে হচ্ছে। অন্য এনজিওতে এসব কাজ ফরমায়েসি কাজের মতোই হয়।
আমি ঠিক ফরমায়েসি কাজে অভ্যস্ত নই। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা যেমনভাবে করেছি। এখানকার কাজও তেমনভাবেই করছি।
হুম। এজন্যই এতো চাপ নিতে হচ্ছে।
কাজের জন্য চাপ নিতে আমার খারাপ লাগে না। সবুজ একটা সিগারেট ধরিয়ে জানালাটা খুলে দেয়। রাকিবকে অফার করে।
রাকিব নিজের পকেট থেকে বেনসন বের করে ধরায়।
রাকিব একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না তো।
না না বলেন।
আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। হঠাৎ বিয়ে করে ফেলেছি।
ও মাই গড। এটা বলেননি এখনও কাউকে?
না। অফিসে বলিনি। নানা ঝামেলার মধ্যে আছি।আপনাকেই প্রথম বললাম।
গুড।
সবুজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, এতোদিন তো মেসে ছিলাম। বিয়ে করে ছোট একটা বাসা নিয়েছি কাঁঠালবাগানে। বিয়ে মানে যে এতো ঝামেলা বুঝিনি আগে। খরচ কুলাতে পারছি না।
আমার কিছু লোন দরকার।
কত?
এই বিশের মতো।
আচ্ছা। ডিবিবিএল এর একটা এটিএম বুথের সামনে একটু থামাতে বলেন।
না না এক্ষুনি লাগবে না। পরে দিয়েন।
না অসুবিধা নাই। আপনার দরকার আমি দিতে চাচ্ছি দ্রুত।
ফার্মগেট থেকে পূর্ব রাজাবাজারে যেতে গাড়ি ডানে মোড় নিলে বামে একটা বুথ দেখা গেল। উবার ছেড়ে দিয়ে রাকিব টাকাটা দেয় সবুজকে।
সবুজ বলে রাকিব আপনি যে কী উপকার করলেন। অনেক ধন্যবাদ। এটা ফেরত দিতে একটু দেরি হবে।
আরে এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। যখন পারবেন দিবেন। আমার কোনো তাড়া নেই।
বাসায় চলেন রাকিব ভাই একটু চা খাবেন। শিউলি আপনাকে দেখলে খুব খুশি হবে।
আজ না ক্লান্ত লাগছে। আরেকদিন প্ল্যান করে যাব।
প্ল্যান করে যাওয়া হবে না। আজই চলুন। এই বিয়েটা প্ল্যান করলে জীবনেও করতে পারতাম না।
হা…হা… হা… কেন?
শিউলির বাসা থেকে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছিল, ও পালিয়ে এসেছে। একদিনের নোটিশে বিয়ে। না কোনো বেনারসি, শেরোয়ানি না কোনো পোলাও-বিরিয়ানি।
তাতে কি? আপনি যার সাথে জীবন কাটাতে চেয়েছেন তাকে তো পেয়েছেন। এর চেয়ে বেশি আনন্দের আর কী আছে? ওসব পরে হবে।
থ্যাঙ্কস রাকিব ভাই। তবে আপনার বিয়েতে কিন্তু কাচ্চি-বিরিয়ানি খাবো।
হা… হা… বিয়ে?
রাকিব একটা রিকশা নিয়ে ইন্দিরা রোডের আঁকা-বাঁকা পথ ধরে পূর্ব রাজাবাজারে বাসার সামনে এসে থামে।
বাসার সামনে অনেক মানুষ। রাকিব একটু ভয় পেয়ে যায়। মা বাসায় একা। কিছু হয়নি তো ভিড় ঠেলে সামনে আগাতেই জানতে পারে পাশের বাসার উকিল সাহেবের বড় ছেলে আল আমিন ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। রাকিব খবরটা শুনে খুব মর্মাহত হয়। আল আমিন ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে মাস্টার্স করে বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যালসে চাকরি করছিল। রাকিবকে সবসময় সাহায্য-সহযোগিতা করতো। দুজনে অনেক সময় এক সাথে ইউনিভার্সিটিতে গেছে।
আল আমিন ভাইয়ের লাশ রাখা হয়েছে বাসার নিচের খালি জায়গায়। অনেক ভিড়। রাকিব ভিড় ঠেলে সাদা কাফনে মোড়ানো আল আমিন ভাইকে দেখতে পায়। উকিল চাচা একটা চেয়ারে বসে অঝোরে কাঁদছেন। এইসব দৃশ্য রাকিব বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। ভেতরে না গিয়ে বাসায় চলে আসে।
হাসিনা বেগম দরজা খুলতে একটু দেরি করেন। নামাজ পড়ছিলেন।
এতো রাত করলি কেন?
কই এতো রাত? আজ তো তাড়াতাড়িই এসেছি। উকিল চাচার বাসায় গেছিলাম।
হুম। এটা কী ঘটলো বলতো কোনো মা-বাবা মেনে নিতে পারবে? আমি গিয়েছিলাম বিকালে।
ভাবীর কান্না দেখে নিজেকে সামলাতে পারিনি। তোকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছিলো।
মা এতো চিন্তা করো না, আমি এখন উবারে আসা-যাওয়া করি। কোনো সমস্যা নাই।
অফিস ছাড়াও তো কত জায়গায় যাস।
যেতে তো হবেই। জীবন তো থেমে থাকবে না।
চুপ কর। তোর লেকচার ভালো লাগে না। আজ তোর বড় মামা এসেছিল। তোর জন্য একটা বিয়ের আলাপ নিয়ে এসেছিলেন। ছবি দিয়ে গেছেন, দেখ তোর টেবিলে আছে।
মা তুমি যা করো না। আমি ছবি দেখে মেয়ে পছন্দ করবো।
তাহলে কিভাবে করবি? কর।
এখনই আমার বিয়ের জন্য এতো কী তাড়াহুড়া?
ওমা বিয়ে করতে হবে না? বয়স বাড়ছে, চাকরিতে ঢুকলি। আত্মীয়-স্বজনরা প্রস্তাব আনবেই।
মা আমার এটা স্থায়ী চাকরি না। আসল চাকরির এখন পর্যন্ত কোনো খবর নেই। চেয়ারম্যান স্যার বলেছেন দু-এক মাসের মধ্যে সার্কুলেশন হবে।
আচ্ছা হোক। মেয়ে দেখতে তো ক্ষতি নেই।
প্লিজ মা, এটা বোঝার চেষ্টা করো আমি এভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়ে দেখে বিয়ে করবো না। সবাইকে এভাবে ছবি দিয়ে যেতে না করো।
তাহলে তোর কোনো পছন্দ আছে?
রাকিব বলে আছে।
ও। তা সেকথা এতোদিন মাকে বলোনি কেন?
না, মা বিয়ে করার মতো কাউকে আমার পছন্দ নেই।তবে পছন্দের অনেকেই আছে।
এ আবার কেমন কথা?
তা ওরা তোকে বিয়ে করবে না?
জানি না মা।
কী সব হেঁয়ালি করছিস। হাত মুখ ধুয়ে আয় ভাত দিচ্ছি টেবিলে। আজ তোর প্রিয় গরুর মাংস রান্না হয়েছে।
বাহ্। দারুণ খিদে পেয়েছে।
কেন অফিসে খাওয়ার সমস্যা কী?
কাজে ব্যস্ত ছিলাম,পরে একটা বার্গার খেয়েছি।
এই জন্যই তোর একটা বউ দরকার। ফোন করে ধমক দেবে। আমার ফোন তো ধরিস না।
ধমক খাওয়ার জন্য বিয়ে করবো?
হাসিনা বেগম রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।
রাকিবদের দোতলা বাসায় দুটি শোয়ার ঘর। বসার আর খাওয়ার ঘর একসাথে, ছোট একটা অতিথি কক্ষ,দুটা বারান্দা। নীচতলাটা ভাড়া দেয়া হয়েছে। বাসার সামনে একটু ফাঁকা জায়গা। ওখানে হাসিনা বেগম পুঁইশাক, কাঁচামরিচ এসব লাগিয়েছেন। রাকিব একটা জারুলের চারা এনে লাগিয়েছিল। গাছটা বেশ বড় হয়েছে। গত বছর সারা গাছ জুড়ে বেগুনী ফুল।
খেতে খেতে রাকিব বলে মা তুমি রহিমা খালাকে ছেড়ে দিয়ে একটা স্থায়ী লোক রাখো।
কী বলিস? রহিমা আমার সাথে আছে পনেরো বছর ধরে। আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
না রহিমা খালা বাসায় চলে গেলে তুমি একা থাকো, কখন শরীর খারাপ হয়, প্রেশার বাড়ে। তুমি লোক দেখো।
কিন্তু রহিমাকে ছাড়বো না।
আচ্ছা রহিমা খালা থাকবে আর একজনকে রাখো।
এতো কুলাতে পারবি? এখন অনেক বেতন কাজের লোকদের।
হ্যাঁ মা পারবো। তুমি লোক দেখো।
ঠিক আছে বড় ভাইজানকে বলবো দেশ থেকে একটা মেয়ে এনে দিতে।
ও আচ্ছা বড় মামা কোথায় উঠেছে?
ওই মেয়ের বাসায় এলিফ্যান্ট রোডে।
আমাদের এখানে বেড়াতে বলতে।
বলেছিলাম থাকবে না।
হুম।
তুই উড়নচন্ডীর মতো টাকা না উড়িয়ে টাকা-পয়সা জমা। বিয়ে করতে হবে। তিনতলাটা করতে হবে।
মা যে কী বলো না।

১১
রাকিব খাবার শেষ করে নিজের ঘরে এসে দোলন-চেয়ারটাতে বসে দুলতে থাকে। মনসুরের দেয়া হুইস্কিটা এখনও রয়ে গেছে। আজ খেতে ইচ্ছে করছে। মা ঘুমিয়ে পড়লে রাকিব বারান্দায় বসে অনেকখানি খেয়ে ফেলে। হঠাৎ খুব আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। শান্তাকে একটা খুদে বার্তা পাঠায়।
কেমন আছো শান্তা।
শান্তা উত্তর দেয় ভালো।
রাকিবের মাথায় খুব যন্ত্রণা শুরু হয়। হঠাৎ মাথা ঘুরতে শুরু করে। সবকিছু দুলছে, ফ্যানের মতো ঘুরছে। বমি পায়। হর হর করে ঘরের মধ্যে বমি করে দেয়। বাথরুমে গিয়েও অনেক বমি হয়। এতোটা একসাথে খাওয়া ঠিক হয়নি। শাওয়ার ছেড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে নগ্ন দেহে। আয়নায় নিজেকে দেখে কেমন অচেনা লাগে। আয়নায় বহুক্ষণ নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা পুরানো গেঞ্জি বের করে ঘরটা মুছে ফেলে। ধুর মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় রাকিবের। কেন যে বোকার মতো এতোটা একসাথে খেতে গেল।
মনসুরকে একটা ফোন দেয়।
দুবার বাজার পর মনসুর ধরে।
হ্যালো,এতো রাতে ফোন করছিস কেন? আমি কি তোর গার্লফ্রেন্ড?
হা… হা… সেরকমই।
মানে?
মানে তুই ছাড়া আর কেউ নাই যাকে মাঝরাতে ফোন করতে পারি।
রাবিশ।
শোন তোর ওই হুইস্কি খেয়ে যাতা অবস্থা। কী দিছিলি আমাকে।
কী দিবো আবার। সেদিন যেটা খেলাম, ওইটাই তো।
হুম কিন্তু আজ খেয়ে বমি-টমি হলো।
ওহো- পুরোটা খাইছিলি?
হুম।
তাহলো তো হবেই। তুইতো অভ্যস্ত না।
আচ্ছা বাদ দে। শোন সামনের শুক্রবার কী করছিস?
তেমন কোনো প্ল্যান নাই তবে মেকানিক্যালের শোয়েবের ওয়াশ প্ল্যান্ট দেখতে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে।
আচ্ছা, ওটা বাদ দে। শুক্রবার আমার সাথে মিরপুরে চল, দাওয়াত আছে।
সেটাতো তোর।
না আমি বলেছি আমার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে যাবো।
শালা। বলিস কী?
হা… হা… হ্যাঁ।
কার বাসা?
গেলেই দেখতে পাবি। হতাশ হবি না।
ওকে তোর সঙ্গ তো বরাবরই ভালো লাগে। সাথে উপরিও আছে যখন।
শোন একটা ব্ল্যাক লেবেল নিয়ে নিস।
আচ্ছা নেবো।
আমি পেমেন্ট করবো।
করিস। এখন রাখছি। আর শান্তাভূত বিদায় হয়েছে?
হুম।
হুম কী?
হুম মানে হয়েছে আবার হয়নি।
তুই না মানুষ হলি না, বুঝছি তোকে কিছু ছবক দিতে হবে।
তো যেখানে বেড়াতে যাচ্ছিস জুঁই-চামেলী কেউ নাই?
আরে না। সোহিনী আমার বন্ধু। পতিবরও থাকবে সাথে।
ওহ্ আচ্ছা দেখি চল, কেমন তোর বন্ধু।
ওকে।
মনসুরের সাথে কথা বলে রাকিব কিছুটা ভাল বোধ করে। শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে পড়ে। সারা সপ্তাহ রাকিবের খুব খাটনি যায়। প্রামাণ্য চিত্রর জন্য অনেক পড়াশোনা করতে হচ্ছে। সামনের সপ্তাহে মধুপুরে যাবে ভাবছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছে। রাকিব আবেদন করে বিভাগীয় প্রধানের কক্ষে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু একটা হয়েছে…. ক্লাস বন্ধ। কিছু শিক্ষকের কক্ষে তালা ঝুলছে। ইংরেজি বিভাগের অফিস খোলা। বিভাগীয় প্রধান নিজের কক্ষেই ছিলেন। রাকিবকে ঢুকতে দেখে উচ্ছ্বাসিত হয়ে ওঠেন।
কী খবর রাকিব। এখন তো আসা একদম ছেড়ে দিয়েছো।
না স্যার, নতুন চাকরিতে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়।
হুম সেটা জানি, তুমি সব জায়গায় সিনসিয়ারলি কাজ করো। তোমার অ্যাপ্লিকেশন আমরা পেয়েছি। আশা করছি দ্রুতই ইন্টারভিউর জন্য চিঠি পাবে।
রাকিব স্মিত হেসে বলে, স্যার আমার একটু দোদুল্যমানতা আছে। ওই গ্রুপের সবাই খুব তৎপর শুনলাম। আজাদ রহমানের জন্য ছোটাছুটি শুরু গেছে।
হয়ে যাক, হতে দাও। তোমার যে রেজাল্ট আর পারফর্মেন্স অন্যরা কেউ পাত্তাই পাবে না।
স্যার এতোটা কনফিডেন্স থাকলে আমার জন্য ভালো হতো।
ভালো হতো কি? তোমার এটা থাকতে হবে।
হুম। রাকিব কিছুটা চিন্তিত মুখে সামনের কাচের টেবিলে রাখা একটা ফাইলের উপর হাত রাখে।
ওয়াকিল আহমেদ বলেন,আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তোমার জন্য। ভিসি স্যারও তোমাকে পছন্দ করেন। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। আর তুমি আসবে মেধা দিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে নয়।
চেয়ারম্যান স্যারের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে রাকিব বেরিয়ে রেজিস্টার বিল্ডিং পার হয়ে নীলক্ষেতের দিকে হাঁটতে থাকে। আজ ভয়ানক রোদ উঠেছে, চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। এই কিছুদিন আগেই রাকিব এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। কত স্মৃতি,বন্ধুদের সাথে নির্মল আড্ডা,মল চত্বরে,হাকিম চত্বরে ,মধুর ক্যান্টিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চা সিগারেট খেয়ে কেটেছে। পাশ করার পর এমফিলের জন্য প্রতিদিন এসেছে। প্রায় বাড়ি-ঘর হয়ে গেছিল বিভাগ। আজ রাকিব এখানে শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রার্থী। যদি তা ঘটে তাহলে এর চেয়ে আনন্দের রাকিবের জীবনে আর কিছু থাকবে না। সবসময় ও পড়াশোনাটাই করতে চেয়েছে ছোট থেকে। মা কত যত্ন করে ওকে পড়াতো। বাবার অনুপস্থিতি কখনো রাকিব টের পায়নি। ইংরেজি সাহিত্য পড়তে এসে আরেকটা নতুন জগতের দেখা পায়। ইয়েটস, উইলয়াম ব্লেক, ওয়ার্ডসওরথ, শেলী, কিটস, বায়রন, শেক্সপিয়ার। সবাই ওকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনেছে। তবে বাংলা সাহিত্যের প্রতিও রাকিবের অসম্ভব ঝোঁক। অন্য একটি ভাষার সাহিত্য পড়তে এসে মাতৃভাষার সাহিত্য চর্চা থেকে সরে যায়নি। চর্যাপদ থেকে শুরু করে নানা পর্বের সাহিত্য রাকিবের নখদর্পণে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্য নিয়ে রাকিব উচ্চাকাঙ্ক্ষী।
ওর ধারণা দীর্ঘ সময় ধরে পশ্চিম বাংলা আধুনিক বাংলা সাহিত্য চর্চার কেন্দ্র হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের সাহিত্য নতুন এক ভাষা তৈরি করতে পেরেছে। যা ভিন্ন এক মাত্রা এনে দিয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। আর সবসময়ই পূর্ব বাংলার সাহিত্যের একটা আলাদা স্বর ছিল। এখানকার সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা তাদের জীবনের চরম বাস্তবতা এসব উঠে আসছে বাংলা সাহিত্যে। যা এ অঞ্চলের মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী সাহিত্য। নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে রাকিব পুরাতন এলিফ্যান্ট রোডের এরোপ্লেন মসজিদের গলিতে চলে এসেছে নিজেই জানেনা। যন্ত্র চালিতের মতো শান্তাদের বাসার গেটে নিজেকে আবিষ্কার করে। দারোয়ান ছেলেটি রাকিবকে দেখে এগিয়ে আসে। রাকিব ভাই আপনি তো অনেকদিন আসেন না। রাকিব কী করবে বুঝতে না পেরে গলি থেকে বের হওয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করে। ছেলেটি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। রাকিব একটা চলন্ত রিকশাকে থামিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে।
সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। শুক্রবার সকালটা রাকিব প্রায় এগারোটা পর্যন্ত শুয়ে থাকে। দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে আরও আলসেমি করতে থাকে। হাসিনা বেগম বার বার ছেলের ঘরের দরজার সামনে এসে দেখেন দরজা বন্ধ। ছেলেকে রেখে কিভাবে খায়, দুটা দিনইতো ছেলেকে কাছে পায় সকালটা। কিন্তু সকাল সকাল না খেলে হাসিনা বেগমের মাথা ঘুরাতে থাকে। রক্তের গ্লুকোজ কমে যায়। বুক ধড়ফড় করতে থাকে। তাই সকালে উঠেই চা দিয়ে বিস্কুট খেয়ে নিয়েছেন। তবু এখন একটু খিদে খিদে লাগছে। কিরে রাকিব উঠবি না? নাস্তা খাবিনা?
রাকিব ভেতর থেকে উত্তর দেয় পাঁচ মিনিট মা, আসছি। ডিম অমলেট, সুজি এসব করেছেন। এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। রহিমা সাহায্য করায় সব করতে পেরেছেন।
হাসিনা বেগম খাবার টেবিলে গরম গরম লুচি দিতে বলেন। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে হাসিনা বেগম চমকে ওঠেন, হাত দুটো কেমন শীর্ণ হয়ে গেছে, চামড়া কোঁচকানো। এই সেদিনইতো হাতটা কত ভরাট ছিল। রাকিবের বাবার সাথে নিউ মার্কেটে গিয়ে নতুন ডিজাইনের একজোড়া সোনার চুড়ি বানিয়ে হাতে পরলেন। হাতের চুড়ি দুটো এখনও আছে, ঢলঢল করছে, যেকোনো সময় খুলে পড়ে যেতে পারে। তবু হাসিনা বেগম চুরি খোলেন না। স্বামীর দেয়া চিহ্নটি তিনি সযত্নে নিজের শরীরের সাথে জড়িয়ে রাখেন। চোখ থেকে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ে গালে। রাকিব তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে খাওয়ার ঘরে ঢোকে।
ওরে বাবা আজতো হেব্বি খাওয়া-দাওয়া। গরম গরম লুচি।
হাসিনা বেগম বলেন, ছুটির দিন ছাড়া তুই তো ভাল করে খাস না। তাই আজ করলাম।
মা তুমি এতো কষ্ট করতে যাও কেন, আমাকে বলতে বাইরে থেকে নিয়ে আসতাম।
বাইরে থেকে আনবি কেন? এটা কেমন কথা?
না তুমি তো রাহিমা খালাকে দিয়ে কিছু করাবে না, নিজেই সব করবে।
আরে না, আমি এখন এসব পারি না। জিজ্ঞেস কর রাহিমাকে।
আচ্ছা ভালো, তুমি তো কথা শুনবেনা। আমি ছোট খালাকে বলেছি তোমার জন্য সামনের রবিবার একটা মেয়ে নিয়ে আসবে। সে সবসময় তোমার সাথে থাকবে।
আশ্চার্য, আমাকে না জানিয়েই লোক ঠিক করে ফেলেছিস।
এছাড়া উপায় ছিল না।
হাসিনা বেগম মুখ ভার করে একটা লুচি ছিঁড়ে আলুর দম দিয়ে মুখে দেন।
রাকিব পাঁচটা লুচি খেয়ে বলে, মা দারুন, চমৎকার হয়েছে আজকের নাস্তা। থ্যাংক ইউ মা বলে রাকিব মাকে জড়িয়ে ধরে।
আরে পাগল ছেলে করে কী? হাসিনা বেগম রহিমাকে তাড়া দেয় চা দিয়ে যাওয়ার জন্য। চা নিয়ে রাকিব নিজের ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় আসে। সারাক্ষণ শান্তার চোখ দুটো মনে ভাসছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে চোখ রাকিবকে দেখছে না, অনেক দূরের কিছু দেখছে, ঝাপসা অস্পষ্ট,বোঝা যায় না। ফেসবুক খুলে শান্তার একাউন্টে ঢুকে দেখে শান্তা একটা কমলা রঙের শাড়ি পরা ছবি দিয়েছে, অনেক গাছপালা চারপাশে। রাকিব দীর্ঘক্ষণ শান্তার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের ছায়াকে খুঁজতে থাকে কিন্তু বারবার চোখ ভেসে ওঠে কুল কুল নদীর স্রোত। রাকিব ভেসে যাচ্ছে স্রোতের সাথে। কোনো কিছুই পাচ্ছে না আঁকড়ে ধরার।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত