তৈমুরের অভিশাপ- শেষ পর্ব

পনের.

লম্বা সময় পরে ড. বাবুল আশরাফ দেশে এসেছেন। ছুটি কাটাতে নয়। তার আসার বিশেষ কারণ রয়েছে। জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন এন্ড অপারেশন টিম এর সেন্ট্রাল ইউনিট এখন ঢাকায় অবস্থান করছে। তারা এসেছে ড. আশরাফের আসারও একদিন আগে।

মিয়ানমার এবং ভারত তাদের নির্দিষ্ট সীমান্তে অস্বাভাবিক কিছু গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছিল। তাছাড়া বাংলাদেশের নিজস্ব রাষ্ট্রীয় অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যের সাথে অন্য দুই দেশের তথ্য সন্বিবেশিত করে এবং সম্প্রতি আটক হওয়া গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল স্মাগলিং রিং এর একজন সদস্যের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন এন্ড অপারেশন টিম নিশ্চিত হয়েছে যে, গুপ্ত সংগঠনের প্রধান হোতারা এই মুহুর্তে বাংলাদেশের দক্ষিণে পার্বত্য এলাকায় অবস্থান করছে।

অপরদিকে নুকুস থেকে লুট করে আনা নেফ্রাইটের টুকরো মিয়ানমার হয়ে কোনদিকে গেছে তা অতি গোপনে অনুসরণ করা হয়েছে। ফলে ঠিক কোথায় চক্রটাকে খুঁজতে হবে তা মোটামোটি নির্ধারিত হয়ে আছে। ইনভেস্টিগেশন টিমের ধারণা দৈব বস্তু এই মুহুর্তে বাংলাদেশেই অবস্থান করছে এবং তা বিশ্বব্যাপি ডেলিভারীর জন্য তৈরী অবস্থায়ই আছে। পাচারের আগেই তা প্রতিহত করতে হলে চিরুনী অভিযানের বিকল্প নেই। তাই স্বাভাবিক ভাবেই রাষ্ট্রীয় সহযোগীতা চাওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার তা অফিশিয়ালি অনুমোদন দিয়েছে।

এখন জয়েন্ট অপারেশন টিম এবং স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান পরিচালিত হবে। ব্যাকআপ হিসাবে সামরিক বাহিনীর সহায়তার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। মূল অপারেশনটা বাংলাদেশে পরিচালিত হবে। শুরুতেই যাতে বিষয়টা সাধারণ মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে নিরবে নিভৃতে সেরে ফেলা যায় তার জন্য এক ব্যতিক্রমী আইডিয়া এদেশেরই কৃতী সন্তান ড. আশরাফ দিয়েছিলেন। নিজ দায়িত্বে ভাগ্নে রূপকের কথা তুলেছিলেন জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিমের কর্তাদের কাছে। তার প্রতি নাসা প্রজেক্টের জের ধরে প্রশাসনের নিখাদ আস্থা ছিল বলেই তারা এক প্রকার বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজি হয়ে গিয়েছিল। তার ফলাফলও হাতে নাতে পাওয়া গেছে। উজবেকিস্তান ভ্রমণের পুরো বিবরণ রূপক যৌথভাবে মামা ড. আশরাফ আর জয়েন্ট টিমের কন্ট্রোলারদের কাছে নিয়মিত দিয়ে গেছে। নিজস্ব তথ্য আর রূপকের নতুন করে পাওয়া তথ্যের সমন্বয়েই কন্ট্রোলাররা একটা অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেবার মত অবস্থায় আসতে পেরেছেন, আর তার চুড়ান্ত পর্বই এখন চলছে।

 

রাত এগারটা।

আটটা এস.ইউ.ভি- তে করে দেশী বিদেশী কমান্ডোদের নিয়ে গঠিত অপারেশন টিম ঢাকা থেকে রওনা হয়ে গেছে বান্দরবনের উদ্দেশ্যে। কনভয়ের পেছনে একটা আলাদা সেডান কারে ড. আশরাফ,ড. রাফায়েল ভিক্টর আর রূপক রয়েছে। পুরো অপারেশন এর সাইন্টিফিক এরিয়াটা কাভার করবেন ফরাসী মাইক্রোবায়োলজীর বর্তমান কিংবদন্তী ড. রাফায়েল- তিনি জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিমের উঁচু পর্যায়ের সদস্য, সাথে রয়েছেন ড. বাবুল আশরাফ স্বয়ং।
ড. রাফায়েলকে তার যোগ্যতা বিবেচনায় পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন নাসার প্রজেক্টে ড. বাবুল আশরাফের সিনিয়র সহকর্মী বিজ্ঞানী হারমান কোহলার। তিনি ওয়ার্ল্ড সায়েন্টিফিক কনফারেন্সের সূত্রে ড. রাফায়েল ভিক্টর এর সাথে পূর্ব পরিচিত ছিলেন। বলা দরকার, বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড থেকে যখন ইউরোপে আক্রান্ত রোগীদের তথ্যাদি ও সঙ্ক্রমণের নমুনা পাঠানো হয়; সেসব পরীক্ষা নীরিক্ষার সাথে ড. রাফায়েলও যুক্ত ছিলেন। যার দরুন ড. রাফায়েল ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ভদ্রলোক বিজ্ঞানী হলে কী হবে, একদমই ভারিক্কি নন। প্রাণ চঞ্চল খোলামেলা মনের মানুষ। উচ্চস্বরে হাসতে পছন্দ করেন। ড. বাবুল আশরাফের কাছে রূপকের কথা শুনেছেন, আজ সরাসরি কথা বলেছেন। খুব দ্রুতই রূপকের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠও হয়ে উঠেছেন। রূপক কিছুটা অবাক হয়েছে, এত উঁচু মাপের একজন মানুষ অথচ ভেতরটা কত সরল!

সেডানের ড্রাইভার নিজেও অভিযাত্রী দলের সদস্য। তার চোখ সামনের এস.ইউ.ভি-র উপর আঠার মত লেগে আছে। গাড়ী চালানোর পাশাপাশি ভি.আই.পি যাত্রীদের নিরাপত্তার দায়িত্বও তার; অন্তত যতক্ষণ তার গাড়ীতে আছে তারা। বয়স খুব বেশী নয় তার, রূপকের চেয়ে বছর দুই তিন বেশী হবে বড়জোড়। কথায় আন্তরিক তবে চেহারা আর চলন বলনে আলাদা কাঠিন্য আছে। এলিট ফোর্সের কঠিন প্রশিক্ষণের কারণেই হয়তো এমন হয়ে গেছে।
গাড়ীর বহর বারৈয়ার হাট পার হয়েছে, সামনে মীরসরাই। রাস্তা তেমন ব্যস্ত নয়। এত রাতে থাকার কথাও নয়। যাত্রীবাহী গাড়ী মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। রাস্তায় যা আছে তার বেশীর ভাগই মালামাল বোঝাই ভারী ট্রাক। বন্দরনগরী থেকে মালামাল লোড করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েছে। এক সাথে নয়টা গাড়ীর বহর সারিবদ্ধ ভাবে সুশৃঙ্খল অবস্থায় যাচ্ছে বিধায় বিপরীত দিক থেকে আসা অনেক ট্রাক ড্রাইভারই একটু বাড়তি মনযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ঘটনা কী। বান্দরবনের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং সীমান্তবর্তী সেনা চৌকির কমান্ডার গাড়ী বহরের জন্য নির্ধারিত পয়েন্টে অপেক্ষা করছেন।
গাড়ীর ভ্রমণের একঘেয়েমী দূর করতে ড. রাফায়েল দুয়েকটা কৌতুক বলার চেষ্টা করেছেন, তবে সেসব জমেনি। মাথার ভেতর ধ্বংসপ্রায় বিভৎস পৃথিবীর ছবি নিয়ে হাসতে পারা খুব কঠিন কাজ। সেজন্য সরল বিজ্ঞানী মোটেও বিচলিত নন। কৌতুক বলা শেষ করে অন্যদের প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা না করেই উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়েছেন। নিজের কৌতুকে নিজেই হেসে খুন। ড্রাইভার বিরক্ত হলেও কিছু বলতে পারছেনা। সে কমান্ডো, এসব হাল্কা হাসি তামাশা তার কাজকর্ম আর স্বভাবের সাথে একদমই যায়না। তবুও ভি.আই.পি বিজ্ঞানী বলে কথা-মেনে নিতেই হচ্ছে। ড. বাবুল আশরাফ মনে মনে খুব অবাক হলেন। এত বড় একটা বিপদ আর সুক্ষ্ম দায়িত্ব মাথায় নিয়ে ভদ্রলোকের হাসি আসছে কেমন করে। জাতি হিসেবে ফরাসীরা খুব যে কৌতুকপ্রিয় তাও তো নয়।

রাত সোয়া তিনটা নাগাদ গাড়ী বহর পটিয়া হয়ে বান্দরবনের দিকে ছুটল। ঢাকা থেকে যাত্রার করবার সময়টা এমন ভাবে বেছে নেয়া হয়েছে যাতে মাঝরাতে চট্টগ্রাম শহরের ভীড় কোন ঝক্কি ঝামেলা ছাড়াই এড়ানো যায়। আর তাছাড়া সীমান্ত বসতিতে পৌঁছাতে হবে ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই। নিখুত হিসেব অনুযায়ী সব চলছে, নির্ধারিত সময়ের প্রায় ছয় মিনিট আগেই পটিয়া অতিক্রম করেছে গাড়ী। অপারেশন দলের কমান্ডার মেজর বখতিয়ার নিজের হাত ঘড়িতে সময়টা পরখ করে নিলেন। তিনি আছেন বহরের দ্বিতীয় এস.ইউ.ভি-তে।

যেমনটা আশা করা হয়েছিল, কমান্ডো টিম যখন ধুপানিছড়া পাড়ার ক্ষুদ্র বসতিটাতে পৌঁছেছে তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। আকাশের রং হালকা ধূসর। আলো ফুটতে পনের বিশ মিনিট বাকী। প্রথমেই প্রায় সব কটি কুঁড়েঘর ঘিরে ফেলা হল। তেমন কোন প্রতিরোধ তৈরীর সুযোগই পেলনা অপরাধীর দল। পাঁচ জনের ছোট একটা দল ভ্রাম্যমাণ ল্যবরেটরীটার চারপাশে অবস্থান নিয়েছে। চার জন নিয়মিত কমান্ডো ছাড়াও অপারেশন টিমের ডেপুটি চীফ সাথে আছে। শুধু যে ঘরটায় যিন হো ছিল সেখানে পরিস্থিতি একটু কেচে গেল। কমান্ডো টিমের আশা ছিল এমনকি সম্ভব হলে একটাও গুলির শব্দ না করে দলটাকে আটকে ফেলা। কিন্তু হো যিন টের পেয়ে যায় বাইরের তৎপরতা। পরাজয় আর ধ্বংস সুনিশ্চিত বুঝতে পেরে অভিযাত্রী দল লক্ষ্য করে নিজের পিস্তল থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করে সে। ঢাকায় প্রাথমিক ব্রিফিং এ বলা ছিল, গুরুতর প্রয়োজন না পড়লে কেউ যেন ফায়ার ওপেন না করে। কিন্তু যিন হো এর কুঁড়ের সামনে যে কয়জন ছিল তারা গুলির জবাব হিসেবে গুলি করা ছাড়া আর কোন উপায় দেখতে পেলনা। ফলে সব কুঁড়ের অধিবাসীরা চিৎকার চেচামেচি করে ঘরে বাইরে বেড়িয়ে আসতেই দেখতে পেল কালো পোশাক আর কালো মুখোশ পরিহিত একদল ভৌতিক ছায়া পুরো বসতি জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

গুলির শব্দ মানুষের ভীত আর্ত চিৎকার আর শিশুদের কান্নায় ঊষার সময়টাকে বিকট করে তুলল। পুরোপুরি আলোকিত হওয়ার আগেই ফিরতি যাত্রার কথা থাকলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যখন আসল তখন বেলা সাতটা। সদ্য জন্মনেয়া সূর্যের আলোয় পুরো পাহাড়ী বনাঞ্চল ঝলমল করছে। অনেক কষ্টে সাধারণ অধিবাসীদের শান্ত রাখতে হচ্ছে। গুপ্ত সংগঠনের প্রধান কর্তা হো’র চাচা গুলিতে নিহত হয়েছেন তাৎক্ষণিক। তিনি হো’র কুঁড়েতেই ছিলেন । হো’কে লক্ষ্য করে ছোড়া গুলির শিকার হয়েছেন। বাবর কোন ঝামেলা না করেই ধরা দিয়েছে। সব কয়টাকে পাকড়াও করে দেখা গেল, হো নেই। একমাত্র সে ই পালাতে পেরেছে। ছোট্ট একটা দল আশ পাশের বেশ খানিকটা জায়গায় গভীর অনুসন্ধান চালিয়ে এসেছে। কোন চিহ্ন নেই হো’র। একটা অনাকাঙ্খিত লেজ অবশিষ্ট রয়ে গেলই শেষ পর্যন্ত।

ড. রাফায়েল স্বশরীরে সব ক্যান তদারকি করে সাথে আনা বিশেষ বক্সে তুলে নিয়েছেন। বাবরের সাথে থাকা বিশেষ ব্যাগটাও পাওয়া গেছে। সেখানে ভারী অস্ত্র ছাড়াও মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ আর কয়েকটা অচেনা যন্ত্রাংশ দেখা যাচ্ছে। সব গাড়ীতে নেয়ার পর আটককৃতদের পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলা হয়েছে। পায়ে চলা রাস্তা পেরিয়েই অপেক্ষমান গাড়ীতে তাদের তোলা হবে।

স্থানীয় অধিবাসীদের বোঝানো হয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী পার্বত্য সন্ত্রাসীদের একটি দলকে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই ধরণের খবর যাতে মিডিয়াতেও যায় সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবাই জানবে শান্তি চুক্তির পর আবার কিছু পাহাড়ী সন্ত্রাসী মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল যাদের অঙ্কুরেই দমন করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ জানতেও পারবেনা কতবড় নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে পৃথিবী।

গাড়ী বহর কোন বিরতী না নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। ড. রাফায়েলকে একবার অনুরোধ করা হয়েছিল তিনি সড়ক পথে ভ্রমণে অস্বস্তি বোধ করলে ফিরতি যাত্রায় চট্টগ্রাম বিমান বন্দর থেকে লোকাল ফ্লাইটে ঢাকা ফিরতে পারবেন। সব ব্যবস্থা করা যাবে। তিনি রাজি হননি। পুরো দলের সাথে যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই ফিরতে ইচ্ছুক বলে জানিয়েছেন। বিকেল চারটায় ঢাকা পৌঁছে গেল গাড়ী বহর। সংগৃহীত ক্যান , বাক্স ও অন্যান্য অচেনা ডিভাইস পরীক্ষার জন্য সরকারী তত্ত্বাবধানে  জয়েন্ট অপারেশন টিম সাথে করে নিয়ে যাবার জন্য তৈরী হল। ড. রাফায়েল আজকের দিন ঢাকায় থেকে আগামীকাল ফ্রান্সে ফিরবেন। পরে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে ডেকে পাঠানো হবে বিস্তারিত গবেষণার স্বার্থে।

ড. বাবুল আশরাফ সব ঝামেলা পেছনে ফেলে যখন বাসায় ফিরেছেন তখন সন্ধ্যা হয় হয়। রূপক মামার সাথেই এসেছে। সে নিজের বাসায় যাবে আগামীকাল। করবেনা করবেনা করেও রাত দশটার দিকে আশু মামাকে প্রশ্নটা করেই ফেলল রূপক
-মামা, পুরো বিপদটা ছিল দৈব বস্তুকে ঘিরে। অথচ পৃথিবীকে নিজের পুনরোত্থানের বিষয়ে সাবধান করেছেন তৈমুর লঙ। এটা কেমন হল?
ড. আশরাফ রূপকের দিকে না তাকিয়েই বললে
-এটা ইতিহাস আর বর্ণনাকারীদের ভুল।
-মানে?
-হুমকিটা আদতে তৈমুর দেননি। দেবার কোন কারনও নেই।
-তাহলে?
-আশীর্বাদ স্বরূপ যে দৈব বস্তু পৃথিবীতে এসেছে মানুষের নাগালে, হুমকিটা সে ই দিচ্ছে। আসলে কম বেশী যেটা বোঝা যাচ্ছে- হুমকিটার মানে হল, কেউ যদি দৈব বস্তুটার আধ্যাত্মিক বা ঐশ্বরিক প্রভাবের বাইরে বাস্তব প্রয়োগে আগ্রহী হয় তাহলে তার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে পৃথিবীর ধ্বংস। চিন্তা করে দেখ, পৃথিবীটা টিকে আছে মানুষের কল্যাণে মানুষের জন্যই। সেই মানুষ যদি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাহলে মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে তা তো পৃথিবী ধ্বংস হওয়াই; তাই না?
-হুম।
-আর তৈমুর নিজে এমন শক্তিশালী আর নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে অনির্ভরযোগ্য একটা বস্তুকে আর পরবর্তী প্রজন্ম তথা যে কারও কাছে হস্তান্তরের বিষয়টাকে অনুচিত মনে করলেন এবং তা নিজের সাথে নিয়ে দাফন হয়ে গেলেন। সুতরাং কবর খুঁড়ে তৈমুরের লাশের সাথে সতর্কবাণীটা পেয়ে মানুষ ভুল করে ধরে নিল যে তৈমুর নিজেই জাগ্রত হবেন এবং পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবেন। মানুষ আসলে বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণের চাইতে আধিভৌতিক চিন্তার দিকে যেতে বেশী পছন্দ করে।
-কিন্তু মামা সবটাই কি বাস্তব? আধিভৌতিক একটা ব্যপার কি এর মধ্যে নেই?
-ঠিক কী বলতে চাইছ?
-বলতে চাইছি ‘দৈব বস্তু’ নামক একটা বিষয়কে ঘিরেই তো পুরো অঘটন বা যা ই বলেন। তাহলে যদি মেনেই নিই যে এটা আদতে একটা দৈব বস্তু তাহলে তো প্রকারান্তরে আধিভৌতিক বিষয়কেই বিশ্বাস করাই হল ।
-না, তা নয়।
-কীভাবে?
-আমরা একটা কথিত দৈব বস্তু নিয়ে ছিলাম বা এখনও আছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, যেটা তুমি এখনও ব্যাখ্যা করতে পারনি সেটা আধিভৌতিক কিছু। এখন এটা নিয়ে অনেক অনেক গবেষণা হবে। নিশ্চয়ই প্রামাণ্য কিছু বেরিয়ে আসবে অন্তত আশা রাখতে দোষ নেই।
-আপনি যে বস্তু নিয়ে গবেষণা করছেন নাসার অধীনে, যা কীনা এই পৃথিবীর নয় বলে মনে করা হচ্ছে, তার বিষয়ে কি বাস্তবভিত্তিক কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছেন? তা কি আধিভৌতিক নয়?
-সে গবেষণার ফলাফল নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কথা বলার সময় এখনও আসেনি। যথা সময়ে তা অফিশিয়ালি প্রকাশ করা হবে নাসার পক্ষ থেকে। সুতরাং সেসব নিয়ে আলাপ করতে চাইছিনা।
-তাহলে অপেক্ষা করতে বলছেন, তাহলে একটা না একটা বাস্তব ব্যাখ্যা বেরিয়ে আসবে?
-অন্তত আশা করতে দোষ কি? তবে নিশ্চয়তা দিচ্ছিনা। মানুষের সম্ভাবনা অসীম হলেও সাধ্য এখনও সীমিত। তোমাকে উদাহরণ দেই- বাইবেলে বুক অব এজিকিয়েল হতে জানা যায় এজিকিয়েলকে তার ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরপ্রেরিত দূতরা শুণ্যে ভ্রমণ করিয়েছিল এবং তাদের অপার্থিব অবস্থার সাথে এজিকিয়েল এর সাময়িক পরিচয় ঘটেছিল। এটাকে না নিরেট ধর্মীয় বর্ণনা হিসেবে নেয়া যাচ্ছে না তার বাস্তব ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয়েছে। পিরামিডের নির্মাণ নিয়েও যত থিওরী আছে তার কোনটাই বিতর্কের উর্ধ্বে নয় কেননা এখনও নতুন নতুন থিওরী আসছে। অর্থাৎ আগের থিওরীর অসাড়তা আমরা নিজেরাই প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিচ্ছি। ভারতের গ্রানাইট পাথরের তৈরী শিব মন্দিরের ক্ষেত্রেও একই বিষয়, এত বড় গ্রাণাইট পাথর এ যুগের টেকনোলজিও এ মুহুর্তে কাটতে এবং এভাবে স্থাপন করতে অক্ষম। রহস্যময় উদাহরণের তো শেষ নেই। সুতরাং নিশ্চয়তা দিয়ে বলা কঠিন। তবে আমার ধারণা রহস্যের শেষ অবশ্যই আছে, তা সেটা যেদিনই উদঘাটিত হোক।
-মামা আপনি কিন্তু নিজের জালে নিজেই ফেসে যাচ্ছেন। যা লৌকিক প্রমাণ করতে চাইছিলেন তা ই কিন্তু অলৌকিকতার দিকে যাচ্ছে।
ড. আশরাফ হেসে ফেললেন।
-বাদ দাও তো। অনেক ক্লান্ত লাগছে। এসব কথা পরে সারা যাবে। ভাল করে ঘুম দাও।
-আরেকটা কথা।
-কী?
-তিনজন রহস্যময় বৃদ্ধের বিষয়টা কী?
-আমি বুঝতে পারছিনা। তবে যিশু খৃস্টের জন্মের সময়কার ঘটনাবলীতেও এরকম রহস্যময় তিনজন মানুষের কথা পাওয়া যায়। সেই তিনজনকে নানান গবেষক নানা ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। একজন জার্মান গবেষক তাদেরকে বৌদ্ধ লামা বলে অভিহিত করেছেন এবং দাবী করেছেন যিশু কৈশোর হতে যৌবন পর্যন্ত লামাদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এসব মেনে নেয়া কঠিন, তবে যুক্তিগুলি ফেলে দেবার মত নয়। এই তিন আরব বা কথিত আরব বৃদ্ধের বিষয়েও একদিন না একদিন কিছু বাস্তব সম্মত কথা উদঘাটিত হবে। সে পর্যন্ত আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাই আর অপেক্ষায় থাকি। কারণ সব কথার শেষ কথা হল মানুষ এমন একটি প্রজাতি যার সক্ষমতা সীমিত হলেও সম্ভাবনা কিন্তু অসীম।
-আর পেন্টাগন বা ইউ.এস সরকার দৈব বস্তু বা এর চুরি সংক্রান্ত তথ্য পেল কোথায়?
-পেন্টাগন বা সি.আই.এ-র কার্যক্রমকে ব্যাখ্যার আওতায় আনা কঠিন। এ প্রশ্নের উত্তর আমি একদমই জানিনা। তবে হতে পারে স্ট্যালিনের ছেলের সহায়তায় গুপ্ত সংগঠন যখন কে.জি.বি ভল্ট থেকে চুরি করে নেয় সেখানে তখন সি.আই.এ বা মার্কিন সরকারের অন্য কোন সংস্থার গুপ্তচর সক্রিয় ছিল।

এ কথার পর আর কথা বাড়ানো চলেনা। রূপক মনের মধ্যে একটা খচ খচে ভাব নিয়ে শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

উপসংহার.

রূপক কানাডায় চলে এসেছে প্রায় সপ্তাহ খানেক হল। প্রচুর কাজের চাপ। তবে পছন্দের বিষয় বলে চাপটাকে এনজয় করতে পারছে।

মাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আপাতত বিয়ের উত্তাপটা চাপা দিয়ে এসেছে। খুব তাড়াতাড়িই পরের ছুটিতে দেশে যাবে ও, তখন বিয়ে করবে কথা দিতে হয়েছে। তবে নিজেই জানেনা, তা আদৌ সম্ভব কীনা।
আজ একটু অনিয়ম করে ফেলল। বিকেলে অফিস থেকে বাসায় ফিরেই কাপড় বদলে বিছানায় গড়াগড়ি দিয়েছিল, কখন যে অজান্তে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি। ঘুম থেকে উঠে দেখল সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে। অবেলায় ঘুমাবার কারণে বুকটা হাল্কা ব্যাথা ব্যথা করছে।

বিছানা থেকে উঠে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিল। মনে হচ্ছে গোসল না দিলে শরীর স্বাভাবিক হবেনা। বেশ সময় নিয়ে গোসল করল ও। গোসল শেষে ল্যাপটপ অন করে প্রায় ঊনিশদিন পর ইমেইল খুলল। অনেক অনেক মেইল এসে ইনবক্স ভারী হয়ে আছে। অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন টাইপের মেসেজগুলি ডিলিট করতে করতে নীচের দিকে নামছে।
হঠাৎ খেয়াল করল জারার দুটো ইমেইল এসেছে। তাও এগার তারিখের একটা , ষোল তারিখের একটা। বুকটা কেন জানি হঠাৎ ধুক করে উঠল। এ কয়দিন জারাকে ভুলেই গিয়েছিল সে, মনে মনে ভীষণ লজ্জিত হল। জারার মেইলগুলি ঠাণ্ডা মাথায় পরে পড়তে হবে। আগে অন্য গুলি সেরে নেয়া যাক। চেক করতে করতে প্রায় চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেল। এবার জারার মেইল দেখার পালা। এগার তারিখের মেইলটা ওপেন করল ও। জারা লিখেছে কোন সম্বোধন বা উপসংহার ছাড়াই-
‘তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু কোন সাড়া-শব্দ পাইনি। তুমি কেমন আছ? আমি জারা, চিনতে পারছ না? তুমি কি আমার মেইলের জবাব দেবে? আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। এক লাইনের হলেও একটা রিপ্লাই দিও। প্লিজ…….’

লাইনগুলির দিকে একদৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকল রূপক। দু’পাশের গাল বেয়ে নেমে আসা মসৃণ চুলের ধারা চোখে ভেসে উঠল।

দ্বিতীয় মেইলটা খুলল। এটা আরও সংক্ষিপ্ত-
‘কী হয়েছে রূপক? কেন রিপ্লাই দিচ্ছনা? এখন আর আমার সাথে যোগাযোগ করার প্রয়োজনবোধ করছনা? সব রহস্য সমাধান করে ফেলেছ, তাইনা?’

সারা ঘরময় পায়চারী করে আবার ল্যাপটপের সামনে এসে বসল রূপক।

জবাব লিখল –
‘তুমি ভুল করছ আমার অপেক্ষায় থেকে,

অথবা আমি ভুল করেছি তোমাকে সারা না দিয়ে।

অথবা ভুল করলাম তোমাকে এই জবাবটা পাঠিয়ে। ঠিক বুঝতে পারছিনা।

আর রহস্য?

না সব রহস্যের সমাধান আমি করতে পারিনি।

তৈমুরের রহস্য সমাধান করা গেছে, পৃথিবীও বেঁচে গেছে সৃষ্টির ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবসৃষ্ট দুর্যোগের হাত থেকে।

কিন্তু কেন আমার কিছুই ভাল লাগেনা,

কেন একটা প্রায় অচেনা মানুষ আমার ভেতর গুঞ্জন করছে,

কেন অনেক বছর আগের একটা সুন্দর ভালবাসাময় মুহুর্ত আমার কাছে একটু অন্যভাবে ফিরে এল,

কেন আমি মাথা পেছন দিকে একটু হেলিয়ে হাসতে থাকা একটা নির্মল মুখ আবার দেখলাম- সে রহস্য আমার কাছে এখনও রহস্যই রয়ে গেছে।

সৃষ্টিকর্তা হয়তো চান না মানুষ সব রহস্য উন্মোচন করে ফলুক,

রহস্য না থাকলে পৃথিবী আর জীবন আনন্দহীন হয়ে পড়বে যে…’

মেইলটা টাইপ করা হয়ে গেছে। টাচ প্যাডে আঙুল রেখে পয়েন্টারটা সেন্ড বাটনে নিয়ে গেল রূপক। বুঝতে পারছেনা, ক্লিকটা করবে নাকি এই জবাবটাকেও মহাবিশ্বের রহস্যভাণ্ডারের আরেকটি রহস্য বানিয়ে অসমাপ্তই রেখে দেবে। এক দৃষ্টিতে স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে আছে ও …….। মাথার ভেতর ঘুরছে রবার্ট ফ্রস্টের লাইন:

And miles to go before I sleep

And miles to go before I sleep……

সমাপ্ত

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত