দশ.
ধুপানিছড়া পাড়া। বান্দরবন পার্বত্য এলাকা। বাংলাদেশ।
এলাকাটা একদম জনবিচ্ছিন্ন। পাহাড়ী এলাকায় একটু সমতল জায়গা স্থানীয়দের জন্য মহামূল্যবান। পুরো বসতিটা এক একরের চেয়েও কম হবে। গাছ কেটে পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করা হয়েছে। আশেপাশের তুলনামূলক জনবহুল অঞ্চলের লোকজন এইখানটায় আসেনা বললেই চলে। সব দিক থেকে দুর্গম ভৌগলিক অবস্থা, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দুষ্প্রাপ্যতা আর বৈরী পরিবেশ একে আরও দুর্বোধ্য করে তুলেছে। এমনকি স্থানীয়রাও বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসীর মত করে এখানে টিকে আছে গত ছয় বা সাত দশক ধরে।
ছোট বড় মিলিয়ে সাত আটটা কুঁড়ে ঘর নিয়েই বসতিটা গড়ে উঠেছে। সমতল জঙ্গলবিহীন খোলা জায়গার আকৃতি অনেকটা অস্ট্রেলিয়ার মানচিত্র উল্টো করে ধরলে যেমন যেখাবে, তেমন। পায়ে চলার ফলে ঘন ঘাসের মধ্যে হাল্কা যে পথের রেখা তৈরী হয় এমন কয়েকটা রেখা বসতিটার আশে পাশে অনেক খোঁজাখুঁজি করলে পাওয়া যায়। যা দেখে ক্ষীণ একটা ধারণা হয় যে বাইরের সাথে খুব অনিয়মিত একটা যোগাযোগ আছে এদের।
আঁকা বাঁকা একটা পায়ে চলা পথ পাহাড়ের দুর্গম চড়াই উৎরাই ডিঙ্গিয়ে পূর্বের দিকে গেছে। সেই পথ ধরে একজন স্থানীয় আদিবাসী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। ফতুয়ার সাথে বিচিত্র ছাপার একটা লুঙ্গীজাতীয় পোশাক পরে আছে। মাথায় একটা গামছা গোল করে প্যাঁচানো। ফর্সা মুখটা ঘামে চক চক করছে। মোটা কাপড়ের ফতুয়াটাও ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। খালি পায়ে হাঁটছে লোকটা। ঠিক হাঁটাও বলা যায়না, হাঁটা আর দৌঁড়ের মাঝামাঝি। চেহারায় পরিশ্রমের ছাপ থাকলেও সেখানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা লক্ষণীয়। বোঝা যাচ্ছে অনেক দূর হতে এসেছে।
তিন চারদিন ধরে তীব্র শৈত প্রবাহ চলছে, যার ফলে এই শেষ বিকেলেই চারপাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে এসেছে। এমনিতেই পাহাড়ী এলাকায় ঘন গাছপালার কারণে বেশ আলোক স্বল্পতা। বাতাসে আর্দ্রতা অনেক কম। এ অবস্থায় সাধারণত শরীর ঘামে না বা ঘামলেও দ্রুত শুকিয়ে যায়। অথচ লোকটার পোশাক প্রায় ভেজা। আদিবাসীদের চেহারার বিশেষত্বের কারণে বয়স আন্দাজ করা কঠিন। লোকটার বয়স পঁচিশও হতে পারে আবার পঁয়তাল্লিশ হওয়াও বিচিত্র নয়। তার গতির সাথে মিল রেখে হাত আর পায়ের মজবুত পেশীগুলো ফুলে ফুলে উঠছে।
বসতিটায় ঢুকে কোন বিরতি না দিয়ে সমতল উঠানের মত জায়গাটা পেরিয়ে কয়েকটা কুঁড়ে ঘর পাশ কাটিয়ে একদম দক্ষিণ পশ্চিমের কুঁড়েটার দরজার কাছে চলে গেল। কুঁড়ের সামনে খানিকটা জায়গা নিয়ে কয়েকটা ওষধি গাছ লাগানো আছে। ঘরের সৌন্দর্য বর্ধনও হচ্ছে পাশপাশি প্রাথমিক চিকিৎসার কাজও চলে। বসতিটা দূর্গম হওয়ায় সাধ্যমত সবকিছুই নিজস্ব উৎস থেকে সংগ্রহ করতে হয় অধিবাসীদের। কুঁড়ের দরজারমত জায়গাটাতে একটা বেতের তৈরী পাল্লা ঠেক দিয়ে রাখা আছে, যেটা তুলে ধরে এক পাশে সরিয়ে দিলে পুরো দরজার কাটা অংশটা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এখানকার সব কুঁড়ের দরজার ব্যবস্থাই এমন।
লোকটা দরজা ঢাকা বেতের পাল্লাটায় হাতের তালু দিয়ে কয়েকটা চাপড় দিয়ে শব্দ করল। চাপড় দেয়ার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে সে খুব অস্থির হয়ে আছে, অপেক্ষা করতে রাজী নয়। ভেতর থেকে কেউ একজন পাল্লাটা তুলে একপাশে সরিয়ে দিল। একটা আবছা মাথা বেরিয়ে এল, আগন্তুককে দেখে আবছা মাথার উদ্বিগ্ন চেহারাটা মুহুর্তেই হাসিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এক পাশে সরে দাঁড়াতেই আগন্তুক কুঁড়ের ভেতর প্রবেশ করল। ভেতরটায় অন্ধকার ভাব আছে। সন্ধ্যা হয় হয়। তবুও কোন প্রদীপ জ্বালানো হয়নি। দরজার বিচ্ছিন্ন পাল্লাটা আবার বসিয়ে দিতেই কুঁড়ের ভিতরটা আরও বেশী অন্ধকার হয়ে পড়ল। আগন্তুক ছাড়াও জনা ছয়েক লোক ভেতরে আছে। তাদের শান্ত ভঙ্গিতে বসে থাকা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে প্রদীপ জ্বালাবার কোন ব্যস্ততা বা এমনকি ইচ্ছাও তাদের নেই । মেঝেতে পাতার তৈরী মাদুরে সবাই বসা। আগ্রহের সাথে আগন্তুককে জায়গা ছেড়ে দিল একজন, আগন্তুক সেখানেই বসে পড়ল। এখনও হাঁপাচ্ছে দেখে কেউ আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করছেনা।
আধো আলো আধো ছায়াতে চোখ সয়ে আসতেই আগন্তুক দেখতে পেল সে ছাড়া আরও চারজন স্থানীয় পোশাক পরে আছে। তবে দুইজনের পরনে পুরনো জিন্সের প্যান্ট আর টি শার্ট। বোঝাই যায় তারা স্থানীয় আদিম জীবনধারার কেউ নয়। টি শার্ট পরা একজন পাশের লোকটার কানে কানে কিছু বলতেই লোকটা আগন্তুককে উদ্দেশ্য করে স্থানীয় ভাষায় বলল,
-কী খবর নিয়ে এলে?
-‘বাবা’ কাল এখানে আসবে।
-কী বলছ?
-হ্যাঁ, অসময়ে আমার ছুঁটে আসার এটাই কারণ।
-কাল কখন?
-ঠিক জানিনা, সন্ধ্যায় অথবা রাতেও আসতে পারেন। তোমরা তৈরী থেকো।
-এমন সিদ্ধান্ত নেবার কারণ কী?
-ঠিক জানিনা। তবে মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটেছে। আসলেই জানা যাবে।
-তুমি জানতে পারোনি?
-না। ‘বাবা’র মেজাজ ভাল নেই। তিনি খুব অস্থির হয়ে আছেন। তাঁকে এমন অবস্থায় এর আগে দেখিনি।
আরও বেশ কিছুক্ষণ আলাপ চলল। আলাপচারিতা শেষ হতে কুঁড়ের লোকেরা বার্তাবাহক আগন্তুককে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। কিন্তু সে দেরী করতে চাইলনা। এখনি ফিরবে, তাকে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমারে ঢুকতে হবে। অত্যন্ত বিপদসংকুল কাজ। যদিও এই কাজটা সে প্রায়ই করে। প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটারের পাহাড়ী পথ। ‘বাবা’র প্রতি শ্রদ্ধা তাকে কষ্ট সহিষ্ণু করে তুলেছে। এসব আজকাল আর খুব একটা পরোয়া করেনা সে। দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে সে প্রায় নিয়মিতই বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের ভেতর যাতায়াত করছে। রাতের বেলায় পথ চলাটা যতখানি কঠিন সীমান্ত পাড়ি দেয়াটা ততখানিই সহজ। সব মিলিয়ে ফিরে যাবার সিদ্ধান্তটা নিজের কাছে ঠিকই মনে হচ্ছে বার্তাবাহকের। গন্তব্যে পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে, আজ বোধহয় আর রাতে খাওয়া হবেনা। খুব দেরী করলে খিদে মরে যায়, তখন আর খেতে ভাল লাগেনা। তবে এটা এমন কোন কষ্টকর কিছু নয়। প্রায়ই হয়। দুপুরের খাওয়াটা ভাল হয়েছে, মুখ বন্ধ বাঁশের চোঙে প্রচুর পরিমাণে ঝাল দিয়ে নদীর মাছ পোঁড়ানো হয়েছিল, আর সাথে জাউ ভাত।
চলার পথে মাঝে মাঝে নীশাচর পাখির মৃদু ডানা ঝাপটানি বা নড়াচড়ার শব্দ কানে ভেসে আসে। অদূরে অস্পষ্ট ছোটাছোটির আওয়াজও হয়। সেদিকে বা অন্য কোন ভয়ের উৎসের দিকে বিন্দু মাত্র মনযোগ নেই। অবিরাম ছুটে চলা। চুড়ান্ত পরিত্রাণের আর বেশী বাকি নেই।
ধুপানিছড়া পাড়ার ক্ষুদ্র বসতিটাতে ‘বাবা’ পৌঁছাল পরদিন দুপুরের পর পর। তার আসল নাম বাবর আসমেত। সময় পরিক্রমায় হয়ে গেছে ‘বাবা’। সে বাংলাদেশ ভারত আর মিয়ানমার এর সংকীর্ণ সীমান্ত বেষ্টিত অঞ্চলে অবস্থান করছে প্রায় সাত মাস যাবত। তার উচ্চতা ছয় ফুটেরও বেশী হবে। সব সময় ট্রাউজারের সাথে বুশ শার্ট পরে আর পায়ে থাকে সৈনিকদের বুট। টকটকে ফর্সা চেহারা, মাথা ভর্তি লম্বা ঢেউ খেলানো চুল। চুলের রং কালচে বাদামী। একটু চাপা চোখের উপর মোটা মোটা ভুরু। গাল ভর্তি বড় বড় চাপ দাড়ি। বেশ শক্ত সমর্থ কাঠামো। চেহারা আর আকৃতিতে ককেশীয় বলে মনে হয়। তার সাথে আরও দুইজন ককেশীয় ও তিনজন আরব রয়েছে। স্থানীয় সঙ্গী চারজন। মোট নয়জন সঙ্গী নিয়ে সে এসেছে। এখানে তার অভ্যর্থনায় রয়েছে জিন্স প্যান্ট আর টি শার্ট পড়া সেই যুবকদ্বয়। স্থানীয় কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ আছে বলেই এই জায়গাটা আগেই পছন্দ করা ছিল। পুরো দল যথা সময়ে সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসেছে। ধুপানিছড়া পাড়ার অন্যান্য অধিবাসীরা এসব তৎতপরতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, তাদের এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে মাথা ব্যথাও নেই।
দক্ষিণ পশ্চিমের সেই কুঁড়েটাতে অবস্থান নিল সে তার সঙ্গী সাথীসহ। তাদের সাথে বেশ বড় সাইজের কয়েকটা ব্যাগ রয়েছে। প্রচলিত ব্যবহার্য ব্যাগের সাথে এসবের মিল নেই। কাপড় চোপড়, অস্ত্র আর কিছু ডকুমেন্ট ছাড়াও একটা স্পেশাল বাক্স রয়েছে ব্যাগে। এসব কথা ‘বাবা’ আর তার সঙ্গীরা ছাড়া এমনকি স্থানীয় সহযোগীরাও জানেনা।
দুপুরের খাওয়া শেষে কেউ ঘর থেকে বের হল না। রাতের বেলায় বৈঠকে বসল সবাই ‘বাবা’র নেতৃত্বে। সে কথা বলে মূলত উজবেক ভাষায়, তবে আরবীতেও সমান পারদর্শী। তার সঙ্গীরাও এই দুই ভাষা রপ্ত করেছে সাথে থেকে থেকে। শুধু স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগের জন্য এখানকার একজনের সহায়তা নিতে হয়। আরবীয় সঙ্গীদের সাথে বাবরের পরিচয় হয় আরও বছর তিনেক আগে, সিরিয়ায়। বাবর আসমেত মূলত জিহাদীদের সঙ্গে সিরিয়ায় ছিল খেলাফত প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে। দুই হাজার তের-র শেষ দিকে উজবেকিস্তান থেকে জিহাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে বাবর। তুর্কি ট্রলারে করে কাস্পিয়ান সাগর অতিক্রম করে প্রথমে আজারবাইজান যায়, সেখান থেকে আর্মেনিয়া হয়ে তুরস্কে প্রবেশ করে। সিরিয়া তুরস্ক সীমান্ত অঞ্চলে প্রায় চারমাস প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর গাযিয়ানটিপ হয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করে। কুখ্যাত পালমিরা ধ্বংস কাণ্ডের সে অন্যতম অংশগ্রহণকারী।
বাবর চৌদ্দজনের একটি অপারেশন টিমের সদস্য হিসাবে যখন পালমিরয়ায় প্রাচীন নিদর্শন আর সংরক্ষিত ভাস্কর্যের উপর নির্বিচারে গুলি আর আর আর.পি.জি দিয়ে আক্রমণ চালাচ্ছিল তখনই ঘটনাটা ঘটে।
এটি ছিল অপারেশনের দ্বিতীয় দিন সকালের ঘটনা। দলের একজন জঙ্গী বড় একটা রাস্তা খোঁড়ার গাইতি দিয়ে একটি এ্যাসিরিয় মূর্তি ভাংছিল। সেখানকার প্রায় সব মূর্তি বা ভাস্কর্যই নিরেট হলেও এই মূর্তিটা ছিল ব্যতিক্রম। আঘাতের সাথে সাথে গাইতি যেমন উল্টো দিকে প্রতিঘাতে ফিরে আসে তেমন না হয়ে বেশ গম্ভীর আর ভোতা একটা শব্দ তৈরী হল। বোঝা গেল মুর্তির ভেতরটা ফাঁপা। দু’চারটা আঘাতে মূর্তিটা ভেঙ্গে পড়তেই দেখা গেল মুর্তির ভেতরের ফাঁপা জায়গায় একটা ব্রোঞ্জের আয়তাকার বাক্স রাখা আছে। বলা বাহুল্য মূর্তিটি বাহ্যিকভাবে এ্যাসিরিয় মনে হলেও মোটেও তা ছিলনা। অপারেশনে থাকা দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কমান্ডার ছিল বাবর স্বয়ং। যে মূর্তি ভাংছিল যে ব্রোঞ্জের বাক্সটি দেখে ঘাবড়ে গিয়ে দৌঁড়ে এসে বাবরকে খবরটা জানায়। তারপর বাবর সেখানে গিয়ে বাক্সটি সংগ্রহ করে। এরপর বাকি মূর্তি ধ্বংসের কাজ শেষ হলে বাবর সবাইকে নিয়ে বসে বাক্সটা খুলে। বাক্সের ভেতর হালকা সবুজ রঙের অদ্ভুত একটা পাথরের ফলক রাখা। ফলকে অচেনা ভাষার বর্ণে কিছু একটা লেখা আছে। ফলকের নীচের দিকে কোণা ভাঙ্গা।
অপারশেন দলের সদস্যদের বাবর জানায় এই পাথরগুলি সম্পর্কে যেহেতু বিস্তারিত জানা নেই তাই এখানে তা সংরক্ষণ করা উচিত হবেনা। হতে পারে এটা মূল্যবান কোন পাথর যার বিক্রিত অর্থ সংগঠনের তহবিল বৃদ্ধিতে কাজে লাগবে। তবে যা ই করা হোক হেড কোয়ার্টারের সম্পৃক্ততা ছাড়া কোন পদক্ষেপ নেয়া যাবেনা। তাই বাবর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, সে রাকায় যাবে। সেখানে আই.এস এর শীর্ষনেতাদের সব খুলে বলবে এবং বাক্সের পাথর দেখে তারা যেটা ভাল মনে করে করবে। সব বলে বুঝিয়ে বাবর বাক্স নিয়ে রাকার উদ্দেশ্যে পালমিরা হতে বেরিয়ে পড়ে পরদিনই। কিন্তু আর কখনোই রাকা বা আই.এস. সংশ্লিষ্ট কারও কাছে যায়নি বাবর। আই.এস ও আর বাবরের সন্ধান পায়নি।
ছোট বেলা থেকেই সে ছিল প্রখর মেধার অধিকারী। আর তাছাড়া নানার কাছে পেয়েছে প্রত্মতত্ত্ব আর রহস্য উন্মোচনের নেশা। প্রাইমারীতে থাকা অবস্থায় বাবরের বাবা মারা যায়। তারপর বাবরকে নিয়ে তার মা চলে আসেন বাবার বাড়ীতে। বাবরের বড় হয়ে উঠা মূলত নানার বাসায়ই। নানা উজবেকিস্তানের একজন শীর্ষস্থানীয় প্রত্মতত্ত্ববিদ ছিলেন আর পাশাপাশি ছিল তার সোভিয়েত ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ সরকারী কাজের অভিজ্ঞতা। বাবরের রহস্যের প্রতি ঝোঁক আর তীক্ষ্ম মেধা তার নানার উচ্চাকাঙ্খাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণ। তিনি চাইতেন বাবর তার মত উজবেকিস্তানের অন্যতম প্রত্মতত্ত্ববিদ হয়ে উঠুক আর তার নিজের কর্ম-অভিজ্ঞতার ধারাকে বজায় রাখুক। ছোট বেলায় নানা সুলেইমান আদহামের বলা কথাগুলি বাবরের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। সেও নিজেকে পৃথিবীর সব রহস্যের দ্বার উন্মোচক ভাবতে শুরু করে।
হাইস্কুলে পড়ার সময় সবচেয়ে বড় ধাক্কাটার সম্মুখীন হয় বাবর, যখন নানার কাছে তৈমুরের সমাধি খোঁড়ার গল্পটা শুনতে পায়। অবশ্য সুলেইমান আদহাম বলে দিয়েছিলেন আগেই, যেন কখনোই বাবর এসব কারও সাথে বলাবলি না করে। নানার কারনেই বাবর উৎসাহী হয় এসবের প্রতি। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তিও হয়েছিল প্রত্মতত্ত্বের উপর। কিন্তু অনেক কিছুই আর আগের মত থাকেনি…..
বাংলাদেশ-মায়ানমার-ভারত সীমান্তের এই সংকীর্ণ অঞ্চলজুড়ে যে মাদক ও স্বর্ণের চোরাকারবারীরা সক্রিয় আছে বাবর তাদের সহযোগীতা নিচ্ছে বিগত মাস দেড়েক হয়। ইতি মধ্যেই সে তার বিশেষ পার্সেল খানিকটা আশে পাশের দেশগুলির দুয়েক জায়গায় বিতরণ করেছে। তার ফলাফলও কাঙ্খিত মাত্রায় এসেছে। তবে এসবই মূল অভিযানের সামান্য ট্রায়াল মাত্র। শৗঘ্রই পুরো দ্রব্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে।
বাবর জানে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি চুপচাপ বসে নেই। তবে সেসব পরোয়া করলে চলেনা। সবচাইতে বড় কথা,বাংলাদেশের মত একটা হতদরিদ্র তৃতীয় সারির দেশের পাহাড়ী সীমান্তে বসে এত জটিল একটা কাজ সে সম্পন্ন করতে যাচ্ছে-এটা বিশ্বমোড়লদের মাথায় আসার আগেই কাজ হয়ে যাবে। তারপর যত পার লাফালাফি কর। আর তোদের মত কীটদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবী আবার নতুন করে জেগে উঠুক। পৃথিবী তেমনই হয়ে যাবে ঠিক যেমনটা শুরুর দিকের মানুষেরা দেখেছিল। পবিত্র , শুদ্ধ আর সত্য এক পৃথিবী। যেখানে শান্তির জন্য পরকালের অপেক্ষায় থাকতে হয়না।
এর মধ্যে সে নিজের সঙ্গীদের ছাড়াও যাদের মাধ্যমে পার্সেল ডেলিভারী হবে তাদের খবর দিয়েছে। স্মাগলাররা খুশি মনে কাজ করে দিচ্ছে। জানেও না এই ক্ষুদ্র পার্সেল দিয়ে পুরো পৃথিবীকে বদলে দেবার কাজ চলছে। প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণের বার আর ডলার সাথে নিয়ে এখানে এসেছে বাবর। স্মাগলাররা যতখানি আশা করবে তার চাইতেও বেশী মূল্য দিতে তৈরী বাবর। স্মাগলাররা এমন ক্লায়েন্ট পেলে আর কিছুই চায়না।
পার্সেল বুঝিয়ে দিয়ে বাবর চলে যাবে মিজোরামে। মায়ানমার এবং বাংলাদেশের কোন রাষ্ট্রীয় সংস্থা যদি ওকে খোঁজার চেষ্টা করেও, পাবেনা। মিজোরামের দুর্গম পাহাড়ে কিছুদিন অবস্থান করার পর সে তার একান্ত গোপন গন্তব্যের পথে বেরিয়ে পড়বে।
রাতের মধ্যে সব ব্যবস্থা কনফার্ম করতে হবে। আগামী এক সপ্তাহ থেকে দশদিনের মধ্যে চুড়ান্ত বিতরণের কাজ সমাপ্ত করতে হবে। সময় খুব বেশী নেই। তবে আপাতত শুধু কর্মপ্রক্রিয়া চুড়ান্ত করা থাকবে। স্মাগলারদের সে পার্সেল হস্তান্তর করবে একদম শেষ মুহুর্তে। আর পৃথিবী জুড়ে তার প্রাপকরা তৈরী আছে। পার্সেল হাতে পাওয়া মাত্রই ছড়িয়ে দেবে তারা প্রাগৈতিহাসিক ঐশ্বরিক শাস্তি।
যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে, তার পরবর্তী ভবিষ্যত নির্মাণের জন্য বাবর ও তার গুপ্ত সংগঠনের সদস্যদের টিকে থাকা প্রয়োজন। ধ্বংসের যে বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছে সে তার থেকে বাঁচার একটামাত্র উপায় আছে যা প্রাচীনকাল হতে ধ্বংসের সাথেই অবস্থান করছিল। বর্তমানে তা ব্যবহার উপযোগী অবস্থায় গুপ্ত সংঘের কাছে আছে। সবাইকে তা বুঝিয়ে দেয়া আছে। শুধু হাতে পায়নি প্রাপকরা, পাবে পার্সেলের সাথে।
ধ্বংসের বীজটিকে বিজ্ঞানের ভাষায় জীবাণু বা বায়োলজিক্যাল এজেন্ট বলা যেতে পারে। একে বাঁধা দেবার শক্তি পৃথিবীতে নেই। তবে যে পাত্রে তা রাখা ছিল তার নীচের গোপন অংশে এটিকে বাঁধা দিয়ে টিকে থাকার বা সোজা ভাষায় আত্মরক্ষার উপকরণ দেয়া ছিল। কিন্তু সেটির ব্যবহার পরিপূর্ণ ভাবে জানতে হলে সংশ্লিষ্ট ফলক দুইটির ভাষা উদ্ধার করার বিষয় আছে। সেটিও করা হয়েছে। একটি ফলকে জীবাণুর ব্যবহার আর আরেকটি ফলকে তার থেকে বাঁচার উপায় বলা আছে। সমস্যা হলো প্রতিরোধের উপায় যে ফলকটিতে আছে তা অসম্পূর্ণ। সেটি ছাড়া কাজটা সমাপ্ত করা যাচ্ছেনা। এতদিন সে উপায় পাওয়াও যাচ্ছিলনা। যার ফলে জীবাণু প্রয়োগে যেতে পারেনি বাবর ও তার দল, কিন্তু এখন জানা গেছে-ফলকের খণ্ডিত অংশটি উজবেকিস্তানের নুকুস মিউজিয়াম অব আর্টের গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে। যদিও বোকার দল জানেই না কত মহামূল্যবান জিনিস ওরা মিউজিয়ামে একটা সাধারণ নিদর্শন মনে করে রেখে দিয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যেই সংগঠনের পক্ষ থেকে নুকুসে আক্রমণ চালানো হবে। ফলকের টুকরোটা সংগ্রহ হয়ে গেলেই মূল অপারেশনের পথে আর কোন বাঁধা থাকবেনা। মিউজিয়ামে লুট বা ডাকাতির ঘটনায় কয়েকদিন একটু হইচই হবে হয়তো। তারপর সবাই ঠিকই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কারণ মিউজিয়াম থেকে যা হারিয়ে যাবে তা দিয়ে যে কতবড় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে উজবেকিস্তান সরকারের সেটা জানার কথা নয়।
সব মিলিয়ে অনেকগুলি স্পর্শ কাতর বিষয় একই সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এজন্যই চুড়ান্ত মুহুর্তে বাবর আসমেত খুব অস্থির হয়ে আছে। এত দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার পালা শেষ হতে যাচ্ছে। অথচ খেলার সবগুলি তাস এখনও হাতে আসেনি। কোথাও সামান্য ভুল হলেই পুরো মিশনটা মাঠে মারা যাবে!