দুই
কানাডা থেকে মাস দেড়েক আগে বাংলাদেশে এসেছিল রূপক ।
আসার পর কয়েকদিন যেতেই টের পেল এত ভাল ভাল কথা বলে দেশে টেনে আনার আসল উদ্দেশ্য ওর কাছে গোপন করেছে সবাই। আসলে তলে তলে পাত্রী দেখা চলছিল । মোটামোটি একটা দুইটা পাত্রী প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে যেতেই ওকে কৌশলে খবর দিয়ে দেশে ডেকে পাঠানো হয়েছে। রূপকের মতামত নিয়ে পাত্রী চুড়ান্ত করা হবে।
সব শুনে ওর মাথায় হাত। বিশ্বিবিদ্যালয়ের পড়াশুনা আর ইন্টার্নি শেষ করে মাত্র একটা আধা সরকারী সায়েন্টিফিক রিসার্চ ফার্মে জয়েন করেছে রূপক, এক বছরও হয়নি এখনও। অমনি সবাই বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
ওর সব বন্ধুদের এখনও বিয়ে হয়নি। ওরাও জেনে গেছে যে রূপকের জন্য পাত্রী দেখা চলছে। সব শুনে ওর বন্ধুরা ইতিমধ্যেই ওকে অদ্ভুত অদ্ভুত মেসেজ ফেসবুকে ইনবক্স করছে। হাসান তো চৌধুরী জাফর উল্লাহ শরাফতের ধারাভাষ্য নকল করে বার্তা পাঠিয়েছে- ‘আরও একটি মূল্যবান উইকেটের পতন’।
পরিস্থিতি ঠেকাতে মাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছে রূপক
-মা, আমাকে দেশে ডেকে এনেছ। ভাল করেছ। তোমাদের সাথে কয়েকটা দিন ভাল ভাবে কাটিয়ে যাব। কিন্তু এখন বিয়ে টিয়ে হচ্ছেনা। আমি মাত্র জয়েন করেছি। একটু গুছিয়ে নেই আগে। দয়া করে এই মুহুর্তে আমাকে সাংসারিক ঝামেলায় ফেলোনা। কানাডিয়ান সায়েন্টিফিক ফার্ম কোন সোজা-বোজা জিনিস নয়। এমনিতেই জান কালি করে দিচ্ছে। এর মধ্যে যদি তুমি আবার বিয়ে নিয়ে আমার পিছনে লাগো তাহলে আমার আন্দামান যাওয়া ছাড়া কোন গতি থাকবেনা।
রূপকের মা রুশিয়া বেগমের সাফ জবাব
-আমার এক কথা বাপু, তুই এতদিন পড়াশোনা ক্যারিয়ার ফ্যারিয়ার বলে আমাকে বহুত মুলা দেখাইছিস। আর না। আমার শরীরের ভাব গতি ভাল না। কখন চোখ উল্টে জিভে কামড় দিয়ে মরে পড়ে থাকব তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই । আমার বয়স হয়েছে; তাই ছেলের বউ দেখতে চাই। বউয়ের একটু সেবা পাওয়ার ইচ্ছাও তো আমার হয় নাকি? তোর এসব বৈজ্ঞানিক ফ্যাদর ফ্যাদরে আমার দিন যাবে না।
রূপক চুপ করে রইল। মার সাথে ঝামেলায় যাওয়ার ইচ্ছা ওর নেই। তাছাড়া মার কথাগুলি ফেলে দেয়াও যায় না। রূপক সেই ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় ডুবে ছিল। মাকে তেমন দেখাশোনাও করতে পারেনি সময়ও দেয়নি। ওর বড় বোন রাজিয়া মার যত্ন-আত্তি যতটা পারে করে। রাজিয়ার স্বামী কলেজে শিক্ষকতা করেন। মায়ের বাসা থেকে রাজিয়ার বাসা খুব দূরে নয়। তাই সব সময়ই আসা যাওয়ার মধ্যে থাকে। বাসায় একটা কাজের মহিলা ছাড়া রুশিয়া বেগমের আর কেউ নেই। রূপকের বাবা মারা গেছেন আরও বছর সাতেক আগে। মা একা সব সামলে ওদের এতদূর নিয়ে এসেছেন। তাঁর কষ্টের দিকটাও ভাবা উচিত। সব মিলিয়ে মার কথা ফেলা চলেনা।
রাজিয়াও রূপকের বিয়ের পক্ষে। সে ই মূলত বাংলাদেশের যত কিসিমের পাত্রী আছে সব দেখে বেড়াচ্ছে। রাজিয়া যতগুলি মেয়েকে দেখে ফেলেছে কোন বিউটি কন্টেস্ট কর্তৃপক্ষও এক সিজনে এত মেয়ে দেখে না। সে এখন এই শহরের যাবতীয় যুবতী মেয়ে ও পাত্রীদের এক জীবন্ত ডেটাবেজ হয়ে উঠেছে। শহরের আশে পাশে হেন কোন ঘটক নেই যার সাথে সে যোগাযোগ করতে বাকী রেখেছে। রূপক আরও বেশী দুশ্চিন্তায় পড়ে যাচ্ছে আর ভাবছে- শেষে কি না কি একটা ঝুলিয়ে দেয়। ফেসবুকে দেখা হাতি সাইজ বউয়ের পাশের ইঁদুর সাইজ স্বামীর ছবিটার কথা মনে পড়ে রূপকের; ওই ছবিটা ওকে প্রীতম পাঠিয়েছিল ভয় দেখাবার জন্য। বরটাকে বন্ধুরা নাকি এই বলে সান্তনা দিয়েছিল- ‘ঘাবড়াইসনা দোস্ত। একদিন না একদিন তো সবাইকেই মরতে হয়’। কথাটা মনে আসতেই রূপক আরেকবার শিউরে উঠল।
বিয়ে হওয়া-না হওয়া নিয়ে প্রতিদিনকার এই বিবাদ যখন তুঙ্গে তখনই মুক্তির পথ পেয়ে যায় রুপক। রূপকের দূর সম্পর্কের মামা ড. বাবুল আশরাফ। ছোট বেলা থেকে আশু মামা নামেই চেনে। সারা জীবনে কয়েকবার মাত্র দেখা হয়েছে। ড. বাবুল আশরাফ একাকী আর নির্ভেজাল জীবন পছন্দ করতেন বিধায় রূপকদের বাসায়ও খুব বেশী আসা যাওয়া ছিলনা। গত কয়েক বছর ধরে অনিয়মিত যোগাযোগ হলেও হঠাৎ সেদিন তাঁর কাছ থেকে রূপকের এড্রেসে একটা ইমেইল আসল। মোবাইল নোটিফিকেশন দেখে মেইল খুলে দেখল খুব সংক্ষিপ্ত বার্তা-
‘রূপক, আমি জানি তুমি এই মুহুর্তে বাংলাদেশে আছ। তোমাকে আজ বাংলাদেশ সময় রাত একটা ত্রিশ মিনিটে আমি কল করতে চাচ্ছি। তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে। যেহেতু বাংলাদেশের জন্য এটা অনেক রাত তাই আগেই জানালাম। যদি এই মেইল তুমি পেয়ে থাক তাহলে দয়া করে তোমার এই মুহুর্তে একটিভ ফোন নম্বরটা আমাকে ফিরতি মেইলে দ্রুত পাঠাও।
তোমার
আশু মামা’
ব্যস এতটুকুই।
রূপক ছোটবেলা থেকেই আশু মামাকে খুব পছন্দ করে। তাই মনে মনে খুব উত্তেজিত ছিল। সাথে সাথেই ফিরতি মেইলে মামাকে ফোন নাম্বার জানিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। রূপকের ফোনটা যখন বেজে উঠল তখন দেয়াল ঘড়িতে একটা ঊনত্রিশ বাজে। প্রায় আধাঘন্টা কথা হল দু’জনের। মামাই বেশীরভাগ কথা বললেন, রূপক শুধু মুগ্ধ শ্রোতার মত শুনে গেল। সব শুনে রূপকের চিন্তা আর আনন্দ দু’টোই হচ্ছিল। চিন্তা হল সামনে কী হতে যাচ্ছে সে অনিশ্চয়তার কথা ভেবে আর আনন্দের বিষয় হল আপাতত বিয়ের হাতকড়া থেকে বাঁচার একটা পথ পাওয়া গেছে। আশু মামা অর্থাৎ ড. বাবুল আশরাফের সাথে কথা বলে যা বোঝা গেল তার সারমর্ম হচ্ছে:
সম্প্রতি পেন্টাগন আর সি. আই. এর কাছে সংরক্ষিত থাকা বেশ কিছু পুরাতন ও অতি গোপন নথি ডিক্লাসিফাইড (উন্মুক্ত) করা হয়েছে। সামরিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বের কথা ভেবে অনেক দিন আড়াল করে রাখা তথ্যসমূহ উন্মুক্ত করার ফলে ব্যপক ভিত্তিক অজানা বিষয় নির্দিষ্ট কিছু মহলের হাতে না থেকে যথাযথ প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে চলে এসেছে। এতে করে মার্কিন সরকারের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এসব তথ্যকে কেন্দ্র করে বহুমাত্রিক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে সেসব উন্মুক্ত নথিসমূহ থেকে প্রয়োজনীয় নথি বাছাই করে বিভিন্ন সেক্টরের এক্সপার্টদের সহায়তায় বিশ্লেষণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিক বিশ্লেষণের সময় বাছাই করা ফাইলগুলি মধ্য থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বেশ কিছু ফাইল পুরো নির্বাচকদলকে ধাঁধাঁয় ফেলে দিয়েছে।
নথিতে দেখা যাচ্ছে বিশ শতকের চল্লিশের দশকেই একজন সোভিয়েত বিশেষজ্ঞ মৃত ব্যক্তির দেহাবশেষ বিশ্লেষণ করে তার প্রকৃত চেহারার চিত্র তৈরীতে পারদর্শী হয়ে উঠেন। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃবিজ্ঞানী মিখাইল গেরাসিমভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন চৌদ্দ শতকের বিশ্ব শাসনকারী দাপুটে মঙ্গোল নেতা তৈমুর লং এর দেহাবশেষ থেকে প্রতিকৃতি তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
একটা দলকে পুরো অনুসন্ধান ও প্রতিকৃতি তৈরীর প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একজন বিশ্বসেরা এক্সপার্ট। বলা বাহুল্য তিনি ছিলেন গেরাসিমভ।
ঊনিশশো একচল্লিশ সালে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে গেরাসিমভের দল উজবেকিস্তানের সমরখন্দের একটি কবরকে তৈমুর লং এর সমাধি বলে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। যখন গবেষক দল চিহ্নিত তৈমুরের কবরটি খুঁড়বে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ল তখন স্থানীয়দের মধ্যে প্রচন্ড আতঙ্কের ছায়া দেখা গেল। গেরাসিমভের দল জানতে পারল বিগত চারশ বছর ধরেই অত্র অঞ্চলে ঐতিহ্যগতভাবে একটা অদ্ভুত বিশ্বাস সবার মধ্যে আছে। সেটা হচ্ছে- তৈমুরের কবর অভিশপ্ত এবং এই কবরে তৈমুরকে নির্বিঘ্নে থাকতে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কোন কারণে তৈমুরের শান্তির বিঘ্ন ঘটালে তা পুরো পৃথিবীর জন্য ধ্বংসের কারণ হবে।
গেরাসিমভ যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানী মানুষ। এসব রূপকথায় কান দেয়া তার মানায় না। তিনি স্থানীয়দের কথায় পাত্তাই দিলেন না। মহাসমারোহে কবর খোঁড়াখুঁড়ি চলতে লাগল। কবর খুঁড়তে গিয়ে গেরাসিমভ বাহিনী রীতিমত হতভম্ব! কবরের ভেতর ফাঁকা। কোন দেহাবশেষ নেই । একদম পরিচ্ছন্ন। কোন কালে দেহাবশেষ ছিল বলেও মনে হচ্ছেনা। একসময় তাদের মনে হল ভুল জায়গায় চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি হয়ত তৈমুরের কবর নয়, বিকল্প অনুসন্ধানে যাওয়া উচিত।
দলের একজন পরামর্শ দিল- আরেকটু গভীরে গিয়ে দেখা যাক। হয়ত চারশ বছরে মাটির স্তর নীচে নেমে গেছে। কথায় যুক্তি আছে বিধায় গেরাসিমভ অনিচ্ছা স্বত্তেও রাজি হলেন। আরও গভীরে খোঁড়াখুঁড়ি চলতে লাগল নতুন উদ্দ্যমে। হঠাৎ একজন খননকর্মীর বেলচা একটা শক্ত বস্তুতে আঘাত করতেই শব্দ কানে আসল। মনে হতে লাগল নীচে আসলেই কিছু একটা আছে। কবরটা আসলে এমন কৌশলে নির্মাণ করা যাতে খুব সাধারণ ধারণা দিয়ে বিচার করলে যে কেউ ভাববে ভূয়া। কিন্তু সত্যিই গভীরে গিয়ে আসল কবরের সন্ধান পাওয়া গেল।
নীচে পাওয়া প্রকৃত কবরের পাটাতন সরালেই পাওয়া যাবে তৈমুরের কাঙ্খিত দেহাবশেষ। পাটাতন সরাবার প্রস্তুতি যখন চলছে তখন খবর আসল তিনজন বৃদ্ধ ব্যক্তি গেরাসিমভের সাথে দেখা করতে চান। উত্তেজনার এমন কঠিন মুহুর্তে গেরাসিমভ যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে তাদের সাথে দেখা করতে কবরকে ঘিরে তৈরী করা ক্যাম্প এরিয়ার বাইরে বের হয়ে এলেন।
তিনজন বৃদ্ধকে দেখে গেরাসিমভ ভীষণ চমকে গেলেন। তিনজন দেখতে শতকরা নব্বই ভাগ একই রকম। এমনকি পোশাকেও। যে কেউ একত্রে না দেখে তিনজনকে আলাদা দেখলে ভাববে একই ব্যক্তিকে তিনবার দেখেছে। তাদের চেহারা আর পোশাক বলে দিচ্ছিল যে তারা বর্তমান পৃথিবীর মানুষ নয়। যেন প্রাগৈতিহাসিক রূপকথার যুগ থেকে এই মাত্র চলে এসেছে।
বৃদ্ধরা রুশ ভাষা জানেনা। তারা ঠিক আরবী নয় কিন্তু কাছাকাছি শোনায় এমন ভাষা আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফরাসী ভাষা মিলিয়ে যা বলল তা দ্বোভাষীর মাধ্যমে রুশ অনুবাদ করিয়ে গেরাসিমভ জানতে পারলেন বৃদ্ধরা তাকে কবর খুঁড়তে নিষেধ করছেন। গেরাসিমভ তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্টালিনের সরকারী নির্দেশের কথা জানালেন। এতে একজন বৃদ্ধ স্মিত হেসে বললেন, “যা বলছি তা শুনুন, মানবজাতির স্বার্থেই মেনে নিন। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্টালিন নন- ‘তিনি’ ” বলে উর্ধ্বে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন।
গেরাসিমভ জানতে চাইলেন, ‘সামান্য একটা মৃতদেহ তোলা নিয়ে এত আপত্তি কীসের আর সমস্যাই বা কোথায়’।
বৃদ্ধ বললেন , ‘এটি সামান্য মৃতদেহ নয়; এটি তৈমুরের মৃতদেহ’।
তৈমুরের মৃতদেহ- শব্দ দু’টি উচ্চারণের মধ্যে এমন একটা দৃঢ়তা ছিল যে গেরাসিমভ এক মুহুর্তের জন্য দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন।
তিনজনের মধ্যে একজন বৃদ্ধ তার আলখেল্লার ভাজের মধ্য থেকে একটা ছিন্ন প্রায় প্রাচীন কাগজের স্তুপ বের করলেন। অনেকটা বইয়ের মতই দেখতে। সেখান থেকে একটা পৃষ্ঠা উল্টে আঙ্গুল দিয়ে গেরাসিমভকে একটা লিখিত বাক্য দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে লেখা-আমি যেদিন পূণরায় জাগ্রত হব, ধরিত্রী সেদিন কেঁপে উঠবে’। বৃদ্ধ জানালেন লেখাটি তৈমুরের দেহাবশেষকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। বইয়ের ভাষা ছিল সিরিয়ান আরামায়িক। আরবীর আদিরূপ। যে ভাষায় স্বয়ং যিশু খৃস্ট কথা বলতেন।
তৈমুরের সময়ের চেয়েও দেড় থেকে দুই হাজার বছর আগে ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণপূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে যে ভাষা ব্যবহৃত হত সেই ভাষায় কীভাবে তৈমুরের দেহাবশেষ সম্পর্কিত সতর্কবাণী থাকতে পারে তা কিছুতেই গেরাসিমভের মাথায় আসছিলনা। ফলে গেরাসিমভের মধ্যে কোন ভাবান্তর না দেখতে পেয়ে বৃদ্ধরা চিন্তিত ও বিরক্ত চেহারা নিয়ে চলে গেল।
অত:পর মাটি সরিয়ে দেখা গেল কবরে সমাহিত কফিনের উপরিতলেও কিছু একটা কথা উজবেক ভাষায় খোদাই করা রয়েছে। অনুসন্ধান দলের সর্ব কনিষ্ঠ উজবেক সদস্য ছিলেন সমরখন্দের স্থানীয়। তার মাধ্যমে জানা গেল এটি বৃদ্ধদের বলে যাওয়া সেই একই কথা-
আমি যেদিন পূণরায় জাগ্রত হব, ধরিত্রী সেদিন কেঁপে উঠবে।
এবার গেরাসিমভ ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তথাপি দেহাবশেষ উত্তোলন চলমান থাকল। পাটাতন সরিয়ে কবর উন্মুক্ত করতেই দারুণ সুগন্ধে পুরো এলাকা ভরে গেল। দেহাবশেষ এর পাশে একটা চাইনিজ জেড পাথরের ফলক রাখা ছিল। ফলকটা হাতে নিয়ে গেরাসিমভ দেখলেন সেখানে আরবীজাতীয় একটা ভাষায় কিছু লেখা রয়েছে। টিমের সেই তরুন উজবেক সদস্য অনুবাদ করে শোনাল লেখা রয়েছে
‘যে আমার কবর উন্মুক্ত করবে, সে আমার চাইতেও ভয়াবহ দুর্যোগকে পৃথিবীর জন্য উন্মুক্ত করবে’
গেরাসিমভ ও তার দল যথারীতি তাদের কাজ সম্পন্ন করেছিল। কবর খোঁড়া হয়েছিল ঊনিশশো একচল্লিশ সালের একুশে জুন। ঠিক বাইশে জুন জার্মান ফুয়েরার এডলফ হিটলার ‘অপারেশন বারবারোসা’ নামে এক অভিযান সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন যা প্রায় পাঁচ মাস স্থায়ী হয়েছিল এবং এর ফলে প্রায় ঊনত্রিশ লাখ সোভিয়েত লোক নিহত হয়েছিল। এসবের সাথে তৈমুরের দেহাবশেষ উত্তোলনের বা খোদাইকৃত লিপির আদৌ কোন সম্পর্ক আছে কীনা তা নিয়ে অনেক কথাই প্রচলিত আছে। এসব তথ্য মোটামোটি স্বাভাবিক অনুসন্ধানেই পাওয়া যায়। কিন্তু নথিতে যে ব্যতিক্রমী ও আশ্চর্যজনক তথ্যটি পাওয়া গেছে তা হল; দেহাবশেষ এর পাশে একটা সিল করা ধাতব পাত্র পাওয়া গিয়েছিল যা মস্কোতে গোপনে নিয়ে এসে খোলার পর মৃতদেহ থেকে যে সুগন্ধ আসছিল সেই একই ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এমনকি দেহাবশেষ এর পাশে একটা অস্বাভাবিক তলোয়ারও ছিল যা গেরাসিমভ সুগন্ধি পাত্রের সাথে উজবেকিস্তান থেকে মস্কোতে নিয়ে আসেন।
ড. আশরাফ আমেরিকার উচ্চ পর্যায়ের অনেক কর্তাব্যক্তিদের কাছে পরিচিত নাম। নাসার একটি গবেষণার কাজে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বর্তমানে আমেরিকাতে অবস্থান করছেন। গবেষক দলটির সাথে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারী নিরাপত্তা বিষয়ক উচ্চপদস্থদের একটা সমন্বয় আছে।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে সম্প্রতি একটি এক্সক্লুসিভ মিটিং এ তিনি জানতে পেরেছেন রুশ বাহিনীর সিরিয়ায় আই এস বিরোধী অভিযানের সময় বেশ কিছু আই এস সদস্য আটক হয়। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের ফলে বেরিয়ে এসেছে যে সিরিয়ার পালমিরায় প্রাচীন নিদর্শন ধ্বংসের সময় জঙ্গীদের ঐ দল একটা সবুজাভ পাথরের তৈরী ফলক পায় যাতে আরামায়িক ভাষায় কিছু লেখা ছিল। সেটি নিয়ে ঐ জঙ্গি গ্রুপের একজন উচ্চ পর্যায়ের নেতা পালমিরা থেকে রাকার উদ্দেশ্যে চলে আসে। এর পর থেকে উক্ত জঙ্গি নেতা নিখোঁজ আছে। বাহ্যিক পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে ও সিরিয়া যুদ্ধ নিয়ে রুশ-মার্কিন সরকারের পরস্পর বিরোধিতা থাকলেও দুই হাজার তেরো সালে করা সিরিয়া যুদ্ধ বিষয়ক গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে আমেরিকা এসব তথ্য জানতে পারে।
পুরো বিষয়টি জটিল আর রহস্যময় হয়ে উঠায় পরে সরকারী সামরিক গোয়েন্দা দপ্তর হতে এ বিষয়ে গবেষক ও বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে একটি যৌথ প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। ড. আশরাফ তখন ঘটনার স্পর্শকাতরতা আন্দাজ করতে পেরে বেসামরিক ও বেসরকারী আবরণে অনুসন্ধান বা তদন্তের প্রস্তাব দেন, যাতে করে মিডিয়ায় বা সিভিল সোসাইটিতে হইচই না পড়ে যায়। তিনি প্রস্তাব করেন,ব্যকগ্রাউন্ডে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সকল প্রকার সহযোগিতা দিয়ে যাবে এবং অনুসন্ধানী দলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ স্বাপেক্ষে পরে প্রয়োজন বুঝে সরকারী দপ্তরগুলি সংশ্লিষ্ট হতে পারবে। আপাতত সরকারী লোকজন পরোক্ষভাবে শুধু নজরদারী করবে।
মার্কিন সরকার আগের নাসা প্রজেক্টে ড. ববের অবদান সম্পর্কে ভালই জানে, তাই প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে। বলা বাহুল্য পশ্চিমারা ড. বাবুল আশরাফকে ড. বব নামে ডাকে।
ছদ্মাবরণে অনুসন্ধানের প্রাথমিক অংশ হিসেবে রূপককে উজবেকিস্তান যাওয়ার প্রস্তাব করেছেন তিনি। তবে কথার শেষের দিকে ছোট্ট করে আভাস দিয়ে রেখেছেন রূপককে যে – এতক্ষণ যা বলা হল তার পরিপ্রেক্ষিতে রূপক যদি এই কাজে সংশ্লিষ্ট হয় তাহলে এ বিষয়ে পরবর্তীতে আরও অনেক স্পর্শকাতর অধ্যায়ের মুখোমুখি হতে হবে ওকে যা যথা সময়ে জানানো হবে।
পুরো বিষয়টা নিয়ে রূপক আবার নতুন করে নানান এঙ্গেলে ভাবতে শুরু করল। (চলবে)