১
অনেক রাত হয়ে গেছে। কিন্তু ছোট্ট রবিন কিছুতেই ঘুমাতে চাইছে না। এই প্রশ্ন সেই প্রশ্ন করে সে তার মাকে কেবলই জ্বালাতন করে চলেছে। অবশ্য রবিনেরই বা কি দোষ! ছোটবেলায় মানুষ তো কিছুই জানে না। এভাবে বাবা মার কাছে প্রশ্ন করতে করতেই সে একটু একটু করে নতুন জিনিস সম্পর্কে জানতে পারে। হয়তো সে জানাশোনার কিছু থাকে সত্য, কিছু থাকে মিথ্যা, আর কিছু থাকে গল্প।
যাই হোক রবিন ঘুমাতে চাইছে না বলে তার মা রবিনের মাথা বুলাতে বুলাতে গান শুরু করলো-
‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।
আয় আয় চাঁদ দাদু টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’।
কিন্তু লাভ হলো না। গান শুনে রবিনের মনে নতুন প্রশ্নের উদয় ঘটল।
রবিন বলল, আচ্ছা মা, চাঁদকে মামা, দাদু এসব বলা হয় কেন? আমার তো মামা, দাদু আছে।
মা বলল, চাঁদকে শুধু তোমার মামা, দাদু নয়, পৃথিবীর সবার মামা এবং দাদু বলা হয়।
রবিন বললো, কিন্তু কেন?
মা বললো, কবি লিখেছেন তাই।
রবিন বললো, কিন্তু কবি কেন লিখেছেন?
মা বললো, উফ দাঁড়া, বলছি। অন্য ব্যাখ্যাও থাকতে পারে কিন্তু আমি যেটা জানি সেটাই বলছি। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, একবার অসুরদের দ্বারা পরাজিত হয়ে দেবতাগণ স্বর্গ থেকে বিতারিত হয়ে ভগবান বিষ্ণুর শরনাপন্ন হয়। তখন ভগবান বিষ্ণু জানান যে অসুরদের পরাজিত করতে হলে সমুদ্রের সকল পানি সেঁচে তার তলদেশ থেকে অমৃত এনে পান করতে হবে। বিষ্ণুর কথা মতো দেবতারা সমুদ্র সেঁচে অমৃত লাভ করে। তবে সমুদ্র গর্ভ থেকে অমৃতের পাশাপাশি আরও অনেক কিছু এমনকি হিন্দুদের ঐশ্বর্য ও সৌভাগ্যের দেবী লক্ষ্মী এবং চন্দ্রদেব বা চাঁদও উঠে আসে। একই জায়গা থেকে লক্ষ্মীদেবী এবং চন্দ্রদেব উঠে আসায় তাদেরকে ভাই বোন হিসেবে ধরা হয়। আর হিন্দু শাস্ত্রে লক্ষ্মী দেবীকে যেহেতু মাতৃরূপে পুজা করা হয়, তাই মায়ের ভাই হিসেবে চাঁদকে মামা হিসেবে বিবেচনা করা হয় হয়। এই হল কাহিনী। বুঝেছিস?
রবিন বললো, বুঝেছি। কিন্তু চাঁদ আবার দাদু হল কি করে?
মা বললো, সে তো আবার আরেক কাহিনী। ওই যে জানালা দিয়ে দেখ। কি দেখা যায়?
রবিন বললো, চাঁদ দেখা যায়।
মা বললো, কয়টা?
রবিন বললো, একটা।
মা বললো, উহু, ভালো করে দেখ। বড় একটা চাঁদের পাশে ছোট্ট আরেকটা চাঁদ আছে।
রবিন বললো, হুম। তাই তো।
মা বললো, ওটা হল চাঁদেরও চাঁদ। সেই হিসেবে ঐ ছোট্ট চাঁদটি আমাদের মামারও মামা অর্থাৎ দাদু। তাই ওটা আমাদের চাঁদ দাদু।
রবিন বললো, তার মানে আমরা যে চাঁদটিকে মামা বলে ডাকি চাঁদের মানুষেরা ঐ চাঁদটিকে মামা বলে ডাকে?
মা বললো, হুম। তবে ডাকে না, ডাকতো।
রবিন বললো, মানে?
মা বললো, মানে হল, এখন আর ওখানে কেউ থাকে না।
রবিন বললো, কেন থাকে না, মা?
মা বললো, তার কারণ আবার আরেক চাঁদ মামা।
রবিন অবাক হয়ে বললো, আরও চাঁদ মামা আছে?
মা বললো, হ্যাঁ আছে। তবে এই চাঁদ আকাশের চাঁদ না, মানুষ চাঁদ।
রবিন বললো, কি করেছে এই চাঁদ মামা, বলো না?
মা বললো, আজ থাক। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমো এখন।
রবিন বললো, না মা, আজই বলো। বলো না, মা। প্লিজ! নইলে আমি ঘুমোবো না।
মা বললো, আচ্ছা ঠিক আছে, বলছি।
২
মা বলতে লাগল, সময়টা ১৯৫০ সাল। মানবজাতির জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি বছর ছিল সেটি। সে বছরই মানুষ প্রথম চাঁদে বসতি স্থাপন করেছিল। মানে আমাদের চাঁদে আর কি। অন্য যে ছোট্ট চাঁদ দেখছিস সেটি তখন ছিল না।
রবিন বললো, তাহলে এখন সেই চাঁদটি কি করে এলো?
মা বললো, আরে সে গল্পই তো বলছি। শোন। মানুষ যখন চাঁদে বসতি স্থাপন শুরু করলো তখন তারা সেখানকার বাসিন্দা হিসেবে প্রথমে মানুষকে না পাঠিয়ে বরং অসংখ্য রোবটকে পাঠাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। রোবটগুলোকে তারা পৃথিবীর মতই চাঁদের বিভিন্ন দেশ মহাদেশে পাঠালো এবং সেখানে বসতি গড়ে তোলার জন্য পৃথিবী থেকেই নির্দেশনা দিতে লাগল। এ জন্য প্রয়োজনীয় যা কি দরকার সব পৃথিবী থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন রকেটের মাধ্যমে পাঠানো হতো। রোবটগুলো সেগুলো গ্রহণ করে তা কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের নির্দেশমতো কাজ করতে লাগল। কিন্তু রোবটগুলো সবকিছু মানুষের নির্দেশমতো করতে থাকলেও তাদের মধ্যে মানবিকতা বা সামাজিকতার বিষয়গুলো অনুপস্থিত থাকায় তারা মানুষের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আশানুরূপ কাজ করতে পারছিল না। তখন বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, রোবটদের মধ্যে মানবিকতা ও সামাজিকতাবোধ জাগ্রত করতে হবে আর এ জন্য পৃথিবী থেকে কিছু মানুষকে পাঁচশ দিনের জন্য চাঁদে পাঠাতে হবে।
রোবটের মধ্যে মানবিকতা ও সামাজিকতাবোধের বৈচিত্র্য উপলব্ধি করার লক্ষ্যে মানুষ পাঠাবার ক্ষেত্রে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার পঞ্চাশজন মানুষকে নির্বাচন করলো। আর সেই তালিকায় ঢুকে গেল বাংলাদেশের চাঁদ মিয়া। কাকতালীয়ভাবে চাঁদ মিয়া চাঁদপুর জেলার বাসিন্দা।
রবিন বললো, ওয়াও! চাঁদে যাবে চাঁদ মিয়া।
মা বললো, হ্যাঁ। চাঁদে যাবার কথা শুনে চাঁদ মিয়াও প্রথমে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল এটা দুবাই, কুয়েতে যাবার মত ব্যাপার এবং সেখান থেকে প্রচুর টাকা পয়সা কামাই করে সে দেশে ফিরে আসবে, মানে পৃথিবীতে ফিরে আসবে আর বাকি জীবন রাজার হালে কাটাবে। কিন্তু মানুষ কল্পনায় যা ভাবে বাস্তবে কি তা হয়!
রবিন বললো, কেন কি হয়েছিল?
চাঁদে পঞ্চাশটি আলাদা আলাদা অঞ্চলে বিশেষায়িত কাচের ঘরে ভিতর অনেকগুলো রোবটের সাথে একেকজন মানুষকে রাখার ব্যবস্থা করা হল। সেখানে থাকা, খাওয়া নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। কিন্তু ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ। কারণ সেখানকার পরিবেশ তখনও মানুষের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। গাছপালা সবেমাত্র বিকশিত হতে শুরু করেছিল। তাই অক্সিজেন ও অন্যান্য গ্যাসের ভারসাম্য তখনও ঠিক হয়নি। রোবটেরা প্রশিক্ষিত হয়ে মূলত সেই কাজগুলোই তদারকি করছিল। পৃথিবীতে মানুষের সভ্যতার মতই নদীভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, কৃষিকাজ এবং পশুপালন এসব শুরু করছিল। যাই হোক, চন্দ্রগামী মানুষেরা একেকজন দশদিন করে একেকটি অঞ্চলে থাকবে এবং রোবটগুলোকে নিজ নিজ কৃষ্টি কালচার অনুসারে মানবিকতা ও সামাজিকতার শিক্ষা প্রদান করবে আর বৈচিত্র্যময় মানুষের সংস্পর্শে এসে রোবটগুলো মেশিন লার্নিং পদ্ধতিতে মানুষের মানবিক গুণগুলো রপ্ত করে কর্মতৎপর হয়ে উঠবে এই ছিল বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য।
অবশ্য এজন্য তারা চাইলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল চাঁদে পাঠাতে পারতো কিন্তু বিজ্ঞানীদের ভাবনা ছিল রোবটদের সাথে পৃথিবীর বৈচিত্র্যের পরিচয় ঘটানো এবং যতটা প্রাকৃতিকভাবে ঘটনাটি ঘটানো যায় সে চেষ্টা করা। তাই বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক কিছু প্রশিক্ষণ ছাড়া আর কোনোরূপ নির্দেশনাই চন্দ্রগামীদের দেয়া হয় নি। তাদেরকে শুধু বলা হয়েছিল যে, রোবটদের সাথে কিছু সময় কাটাতে এবং গল্পের ফাঁকে ফাঁকে তাদেরকে মানবিকতা এবং সামাজিকতার কিছু শিক্ষা দিতে।
কিন্তু চাঁদ মিয়ার ধান্দা তো ছিল ভিন্ন। সে কিছু অতিরিক্ত কামাই রোজকার করার চিন্তা করেছিল। তার গ্রামে যখন চাঁদে যেতে আগ্রহী লোকেদের তালিকা করা হচ্ছিল সে ভেবেছিল আমেরিকা যাবার ডিভি লটারির মতো কিছু একটা হবে। তাই সানন্দে তালিকায় নিজের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তার মতো ভেবে আরো অনেকেই নাম দিয়েছিল, কিন্তু সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে নির্বাচিত হয় এই চাঁদ মিয়া। শুরুতে এককালীন কিছু টাকা পেয়ে বেশ খুশিও হয় সে। বছর খানেক বাড়ির বাইরে থাকার বিনিময়ে যে টাকা সে পেয়েছে তা তার মত কুঁড়ে লোকের জন্য নেহাত কম নয়। কিন্তু এই বাড়ির বাহির যে উঠান পেরিয়ে একেবারে চাঁদে গিয়ে ঠেকবে তা কি সে কল্পনা করতে পেরেছিল? পারে নি। আর তাই আজ সে কাচের একটা বদ্ধ কুঠুরিতে বসে কতগুলো যন্ত্রের সাথে বকবক করে সময় কাটাচ্ছে।
খেয়ে পড়ে ভালোই দিন কাটছিল তার। কিন্তু কথায় আছে না ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডাখানা’ তাই চাঁদ মিয়ার মাথায়ও শয়তানির ভুত চাপল।
রবিন বললো, কি শয়তানি মা?
মা বললো, চাঁদ মিয়া চাঁদে বসে বসে রোবটদের ব্রেইন ওয়াশ করতে লাগল। মানবিকতার শিক্ষার পাশাপাশি সে রোবটদের ভিতর লোভ, হিংসা, আলসেমি, একগুয়েমি এসব নেতিবাচক প্রবণতার বীজ বপন করতে লাগল। তবে এসব সে খুব কৌশলে করতো। যেমন, একদিন সে রোবটদেরকে পৃথিবীতে চাঁদ ও জ্যোস্নার সৌন্দর্য এবং গুরুত্ব খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল। খুবই ভালো কাজ। কিন্তু একইসাথে সে এও বলে দিল যে, তোমাদেরকে চাঁদে পাঠিয়ে কিন্তু চাঁদের সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এখানে কোনো চাঁদ নেই, চাঁদের আলোও নেই। রাত হলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভৌতিক পরিবেশ। তোমরা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের জানাও যে তোমাদেরও একটা চাঁদ লাগবে, নইলে তোমরা চান্নিপসর রাতের কবিতা লিখতে পারছো না, চাঁদের উপর নির্ভরশীল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করতে পারছো না। এগুলো ছাড়া জীবন চলে? তোমাদের রোবট জীবন ষোল আনাই বৃথা। এসব বলে চাঁদ মিয়া রোবটদের মাঝে একটা চাঁদের কৃত্রিম প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করলো অর্থাৎ তাদের মাঝে লোভের বীজ বপন করলো। কিছুদিন যেতে না যেতেই তার কথা মতো রোবটরাও বিজ্ঞানীদের কাছে চাঁদের ব্যবস্থা করার আবদার করে বসলো।
রবিন বললো, চাঁদ এনে দিতে বললো? আমাকেও চাঁদ এনে দাও না, মা।
মা বললো, ধুর বোকা! চাইলেই কি আর চাঁদ পাওয়া যায়? কথায় আছে, ‘বামন হয়ে চাঁদের পানে হাত বাড়াতে নেই’।
রবিন বললো, তাহলে বিজ্ঞানীরা কি করলো?
মা বললো, বিজ্ঞানীরা প্রথমে রোবটদের প্রস্তাব নাকোচ করে দিল। কিন্তু চাঁদ মিয়ার ক্রমাগত ইন্ধনে রোবটরাও চাঁদের জন্য গোঁ ধরে বসে রইল। তারা ইচ্ছে করে তাদের কাজকর্মে অবহেলা করতে লাগল। চাঁদ মিয়া তাদের এমনভাবে ব্রেইন ওয়াশ করল যে, তারা আবার অন্য চন্দ্রগামী মানুষদের সাথে আলোচনা করে সেইসব মানুষদের মনেও চাঁদের চাহিদার সৃষ্টি করে ফেলল। তারাও ভাবতে লাগল, খারাপ কি, যদি একটা চাঁদ এখানে থাকে? তাহলে আমাদেরও তো ভালো লাগবে। মনে হবে পৃথিবীতেই তো আছি। তাছাড়া বিজ্ঞানীদের কাছে এটা তো এমন কোনো ব্যাপারই না। তাই রোবটদের সাথে সাথে তারাও চাঁদের জন্য পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের কাছে আবেদন জানিয়ে দিল।
চন্দ্রবাসীদের কাছ থেকে চাঁদের এমন জোরালো দাবী আসতে দেখে বিজ্ঞানীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। এমনিতেই চাঁদে বসতি স্থাপন কত ঝক্কি তার উপর এখন আবার চাঁদেও একটি চাঁদ বানাতে হবে। এটা কি যেন তেন কথা! রোবটের মাথায় কি করে এই চাঁদের বুদ্ধি এলো তা তারা কোনোভাবেই ঠাওর করে উঠতে পারলো না। কিন্তু ইতোমধ্যে চাঁদে পাঠানো মানুষদের মধ্য থেকেও এই দাবী উঠে আসায় এখন আর তাদের দাবী পূরণের বিকল্প কিছু নেই। নইলে এই ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট মাঠে মারা যাবে। বিজ্ঞানীরা আরো কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের একটি প্রজেক্ট হাতে নিল এবং চাঁদে একটি কৃত্রিম চাঁদ স্থাপনের কাজ শুরু করে দিল।
রবিন বললো, কৃত্রিম চাঁদ?
মা বললো, হ্যাঁ। ছয় মাস কঠোর পরিশ্রমের পর বিজ্ঞানীরা চাঁদে একটি কৃত্রিম চাঁদ স্থাপন করতে সক্ষম হল। এটি পৃথিবীর চাঁদের মতই নিজ অক্ষের চারদিকে এবং একই সাথে চাঁদের চারদিকে আবর্তিত হতে লাগল এবং এতে অমাবশ্যা, পূর্ণিমার মত ব্যাপারগুলোও পৃথিবীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করে দেয়া হল। কৃত্রিম একটি চাঁদ পেয়ে চন্দ্রবাসীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। রোবটরাও চাঁদকে নিয়ে কবিতা লেখা শুরু করে দিল-
‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, রোবটের বাটনে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’।
বিজ্ঞানীরা রোবটদের লেখা এমন সৃষ্টিশীল কবিতা দেখে ভাবলেন, নাহ, তাদের ছয় মাসের চেষ্টা একেবারে বিফলে যায়নি। রোবটরা চাঁদ দেখে এমন কবিতা লিখতে পারছে এও তো কম অর্জন নয়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের এ আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হল না। সমস্যার সূত্রপাত ঘটল নতুন এ চাঁদকে ঘিরেই।
রবিন বললো, কি সমস্যা?
মা বললো, এ ছয় মাসে বিজ্ঞানীরা নতুন চাঁদ বানাবার জন্য নিজেদের সকল শক্তি প্রয়োগ করতে গিয়ে তাদের মূল যে প্রজেক্ট সেখানে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে নি। ফলে রোবটদের মধ্যে মানুষের নিয়ন্ত্রণের চেয়ে স্বনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি আধিপত্য লাভ করে ফেলে। আর এদিকে চাঁদ মিয়ার ক্রমাগত গোপন উস্কানিতে রোবটরা মানুষের নেতিবাচক গুণগুলোও ভালোভাবে রপ্ত করে নিল।
ছয় মাস পর বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন যে, রোবটদের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ অনেকখানিই কমে গেছে। তারা তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করার পরিবর্তে নিজেদের খেয়াল খুশিমতো কাজ করছে এবং কাজগুলো করার ক্ষেত্রে তাদের অমনযোগিতা এবং অবহেলা প্রকাশ পাচ্ছে। যে মানবিক ও সামাজিক জাগরণ রোবটদের মধ্যে দেখতে চাওয়া হয়েছিল তা তো হয়ই নি বরং তাদের মধ্যে অনেক নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের উন্মেষ ঘটেছে। তবে বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে অবাক হলেন এটা আবিষ্কার করে যে, রোবটদের মধ্যে দুটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে আর সেটি হয়েছে নতুন এই চাঁদকে কেন্দ্র করেই। এক দল রোবট অমাবস্যার দিনকে তাদের জাতীয় কবিতা দিবস বলে নির্ধারণ করেছে, আরেকদল পূর্ণিমার দিনকে। আর এই নিয়েই যত গণ্ডগোল। একদল আরেকদলের অনুষ্ঠান বয়কট করছে, তাদের কবিতাকে অখাদ্য এমনকি মানুষের লেখা কবিতার চেয়েও অধম বলে গালিগালাজ করছে, এমনকি তাদেরকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছে। তাদের এই দলাদলি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছুল যে সেটি তাদের মূল যে কাজ তাতেও প্রভাব বিস্তার করল এবং কর্মস্থলেও তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করতে লাগল।
৩
একদিন কাজ করতে করতে দুই রোবটের মধ্যে এই কবিতা দিবস নিয়ে তুমুল ঝগড়া হল এবং এক পর্যায়ে এক রোবট আরেক রোবটের হাত ভেঙে দিল। সে খবর জানতে পেরে প্রতিপক্ষ দলের রোবটরা এসে ওই রোবটের হাত পা সব গুড়িয়ে দিল এবং রোবটটিকে মেরে ফেলল। এই ঘটনা জানতে পেরে চাঁদের সকল রোবটের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হল এবং প্রতিটি অঞ্চলেই অমাবশ্যা গ্রুপ এবং পূর্ণিমা গ্রুপের রোবটদের মধ্যে ব্যাপক মারামারি শুরু হয়ে গেল। এই হামলায় শুধু যে রোবটরা মরল তাই নয় একইসাথে মানুষের জন্য প্রস্তুত করা বিশেষ ঘরগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় চাঁদের বায়ুমণ্ডলের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে কিছু নিরীহ মানুষের প্রাণও গেল।
বিজ্ঞানীরা এ পরিস্থিতি দেখে যতদ্রুত সম্ভব সেখানে বিশেষ বাহিনী পাঠালো। বিশেষ বাহিনী চাঁদে পৌঁছে সবার প্রথমে সকল রোবটকে ধ্বংস করল। তারপর সেখানকার অবশিষ্ট জীবিত মানুষদের পৃথিবীতে ফেরত নিয়ে আসল।
এই অভিজ্ঞতার পর থেকে মানুষ আর চাঁদে বসতি স্থাপনের কোনো প্রজেক্ট হাতে নেয় নি। তবে চাঁদের চাঁদ তৈরিতে অনেক ব্যয় হয়ে যাওয়ায় সেটিকে আর ধ্বংস করা হয় নি। দুই হাজার একশ সাল পর্যন্ত সেটি চলমান থাকবে বলে জানা গেছে।
রবিন বললো, তার মানে চাঁদ মামা বেঁচে থাকলেও আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমাদের চাঁদ দাদু মৃত্যুবরণ করবে।
মা বললো, ঠিক তাই।
রবিন বললো, আর সেই চাঁদ মিয়ার কি হল?
চাঁদ থেকে পৃথিবীতে ফেরত আসা মানুষের তালিকায় চাঁদপুরের সেই চাঁদ মিয়ার নাম খুঁজে পাওয়া যায় নি।