তুলোই আর বুখাই

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা । তখনও সভ্যতার বিকাশে তেমন উচ্চমার্গীয় পরিবর্তন ঘটেনি। সেই সময় দুইটি মানব গোত্র বাস করত একটি চওড়া নদীর দুইধারে। বিশাল নদী এবং বেশ খরস্রোতা, স্বচ্ছ টলটলে জল। স্রোতের টান চলে যেতো ভাটির দিকে দুধারে সবুজ প্রকৃতি পিছে ফেলে কোন অজানায়।
নদীর দুই পাশের ভূ বৈচিত্রও অদ্ভুতভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একপাশে কেবল বিস্তৃণ তৃনভূমি-লম্বা লম্বা ঘাস। আর অন্যপাশে কেবলই ঘন জঙ্গল, লম্বা লম্বা গাছ আর ঘন বুনো ঝোপ।
তৃনভূমি পাশে বাস করে তৃণজ জাতি আর জঙ্গল পাশে বাস করে বৃক্ষজ জাতি। দুই জাতির মধ্যে কোন সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য ছিলো না।
তখন এত নৌকা টৌকা, সাঁকো টাকো আবিষ্কার হয়নি। ইচ্ছে করলেই নদী পার  হওয়া যেতনা। তথাপি কতিপয় শক্তিশালী লোকজন স্রোতকে হারিয়ে সাঁতরে নদী পার হতে পারতো। কেউ কেউ ছোট ছোট ভেলা বানিয়ে মাছ শিকারও শিখেছিলো।
অকুতোভয় কিছু লোকজন সাঁতরে বা ভেলায় করে একপাশ থেক অন্যপাশে কদাচিৎ চলে যেত খাবারের সন্ধানে। এ পাশের লোর ওপাশ থেকে চুরি করতে যেতো খাবার। উভয়ের পাশেই তেমন লোক ছিলো কতিপয়।
বৃক্ষজদের চোর তৃনজে যেতো ধান ডাল -এইসব চুরি করতে আর তৃনজরা বৃক্ষজে যেতো গাছের কাঠ, মিষ্টি ফল, মধুর চাক- এইসব চুরি করতে। এই সব চুরিকান্ড নিয়ে  দুই জাতির মধ্যে  ব্যাপক রেষারেষি ছিলো । কালেভদ্রে মারি খুনোখুনি, রক্তপাতও হতো।
তারোপর প্রকৃতির ঝড়, বিদ্যুৎ চমক, স্রোতের আকস্মিক ফুলেফেঁপে ওঠা ও অধিক টান এইসব লেগেই থাকতো। তৃনজ রা তৃণ নামে এক ঈশ্বরের উপাসনা করতো, প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর বৃক্ষজদের অত্যাচার থেকে তার কাছেই মুক্তি চাইতো।
অন্যদিকে বৃক্ষজরা বৃক্ষ নামে এক ঈশ্বরের আরাধনা করতো এবং তার কাছে প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর তৃনজদের অত্যাচার থেকে মুক্তি চাইতো।
এভাবেই চলছিলো। সময় গড়িয়ে যেতে যেতে একসময় তারা হাতে বানানো দঁড়ি দিয়ে শক্ত করে ভেলাও বানাতে শিখে ফেলেছিলো । তেমনি একসময়, একদিন তৃণজ যুবরাজ তুলোই এবং বৃক্ষজ যুবরাজ বুখাই এর মধ্যে নদীতে ভেলায় চরে মাছ ধরতে গিয়ে দেখা সাক্ষাৎ হয়, কথা হয়। দুজনে কিশোর বয়সের।  কয়েকদিন পরপর দেখা হবার পর তাদের মধ্যে একটা সখ্য হলো। সখ্যতা নদীর জলের স্বচ্ছতায় মিশে যাবার পর তারা একদিন একে অপরকে বলে :
… এই যে আমাদের সাথে তোমাদের মারামারি- রেষারেষি এই সব আর ভালো লাগে না। আমি আর তুমি যখন রাজা হবো তখন আমরা আর চুরি করতে পাঠাবোনা কাউকে বরং আমারা খাবার ভাগাভাগি  করবো, লেনদেনের ব্যবস্থা করবো। তাতে একদা সৌহার্দ্য হবে, সম্প্রীতির বন্ধন হবে, রক্তপাত বন্ধ হবে।  আমরা দু’রাজা খুব ভালো  বন্ধু হব।
আমারা একটা শক্ত দড়ি নদীর এ পাড় থেকে ওপারে বেঁধে দেবো, সেই দড়ি ধরে ধরে দ্রুত ভেলাগুলো এপার থেকে ওপারে ভাসিয়ে আনা যাবে- প্রবল জোয়ারের স্রোতে ভেলা ভেসে যাবে না।
হঠাৎ একটু পরেই দুজন একসাথে বলে ওঠে – কিন্তু আমাদের ঈশ্বররা কি তা মেনে নেবেন?
তুলোই বলে- তোমরা তো আমাদের ঈশ্বর  ‘তৃন’ কে মানো না, তৃনকে যে মানে না সে পাপী, তাদের সাথে তো বন্ধুত্ব করা বারণ…
বুখাই বলে- তাইতো ‘বৃক্ষ’ কেও তো তোমরা মানো না, বৃক্ষকে যে মানে না সে তো পাপী। তাদের সাথে বন্ধুত্ব কেমনে হবে …
হঠাৎ বুখাই বললো – আচ্ছা আমাদের লোক যখন তোমাদের ওখানে শষ্য চুরি করতে যায় , কই কখনও তো তৃণ তাদের কোন অনিষ্ট করে না।
তুলোই বললো, তাইতো , আমাদের লোক যখন তোমাদের ওখানে চুরি করতে যায় তখনও বৃক্ষ তাদের বাধা দেয় না…
দুজন ভাবতে থাকে ।ভাবতেই থাকে … … ভাবতে ভাবতে একদিন দুজনের রাজা হবার সময় চলে আসে …
(এরপরের অংশ ইতিহাসের গহ্বরে হারিয়ে গেছে)
১৫/১০/২০২১
স্থান: ১৫০ নং বাস

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত