পিঠের নিচে কিছু একটা আটকে আছে। অনেকক্ষণ ধরেই ভোগাচ্ছে জিনিসটা । কিন্তু কিছুই করতে পারছে না তোরাব আলী। নিজের পক্ষে তো হাত দিয়ে বস্তুটাকে সড়ানোর উপায় নেই। আর ময়মুনাকে যে বলবে তাও পারছে না। ময়মুনা তোরাব আলীর থেকে খানিকটা দূরে বসে আছে। কেবল যে বসেই আছে তাও না, বলা যায় দোকান সাজিয়ে বসেছে। অবশ্য দোকান বললে দোকান, না বললে কিছুই না। সামনে দুইখানা বাটি। একটাতে ভাঙতি টাকা অন্যটায় খুচরো কয়েন পড়ে আছে। ময়মুনা মুখে কোনো কথা বলছে না। যতদূর পারা যায় ঘোমটা টেনে নামিয়ে দিয়েছে। এতে প্রথমবার কেউই বুঝতে পারবে না এই মহিলার বয়স কত। কিন্তু খানিক দূরে বসে থাকা তোরাব আলীকে যদি এই ময়মুনার স্বামী ধরে নিয়ে কেউ হিসাব মেলাতে শুরু করেন তবে তার বয়স চল্লিশ হতে পারে। আবার যদি কেউ এই দুই ভিক্ষুকের মধ্যে সম্পর্ক না খোঁজেন তাহলে এই লম্বা ঘোমটার আড়ালে ময়মুনার বয়সও ঢাকা পড়ে যাবে। তার বয়স আসলে সাতাশ বছর।
ময়মুনা আর তোরাব আলী আগে একই সাথে বসে ভিক্ষা করত। তোরাব আলীর গলার স্বরটা অদ্ভুত। কথা বলতে গেলে কেবল ঘড়ড় ঘড়ড় শব্দ বের হয়। আর ময়মুনা কথা বলে কেঁদে কেঁদে, নাকি সুরে। তাদের এই ডুয়েট পরিবেশনা পরিবেশকে কিছুটা হলেও ভীতিকরই করে তোলে। ভীতিকর তো বটেই। বাচ্চাদের অনেকেই তাদেরকে ভয় পায়। কেবল বাচ্চাই বা বলি কেন, এই সেদিন এক মহিলা ময়মুনা আর তোরাবকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় তোরাবের গলার কারুকাজ শুনে ভয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। ওই মহিলা ভেবেছিল বুঝি ভয়ঙ্কর কোনো দৈত্য তাকে ধাওয়া করেছে। তবে যারা এই রাস্তায় রোজ যাতায়াত করে তাদের কাছে তোরাব আলী-ময়মুনা সামান্য বিরক্তির কারণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই যে বেশ কিছুটা সময় চলে গেল, এর মধ্যেও তোরাব আলী ময়মুনাকে ডেকে বলতে পারেনি, ময়মুনা আমার পিঠের নিচে কী য্যান আইটক্যা আছে, ব্যথা পাইতাছি… এট্টু সাহাইয্য কর। বলতে পারেনি কারণ আজ তারা ঝগড়া করেছে। ফলে পিঠের নিচের ওই বস্তুটার কাছ থেকে তোরাব আলীকে কতক্ষণ ধরে ব্যথা সইতে হবেÑ আন্দাজ করতে পারছে না সে। এর আগে সে নিজেই একটু চেষ্টা করেছে ওই বস্তুটাকে সরিয়ে দিতে, কিন্তু পারেনি। বরং তার এই চেষ্টা তাকে আরও কষ্ট দিয়েছে। এখন তার রাগও হচ্ছে। ময়মুনাটা কি মানুষ! ঝগড়া করে এতক্ষণ ধরে দূরে বসে থাকলে তার চলবে না। কিন্তু ময়মুনাকে ডাকতে পারছে না তোরাব আলী। ডাকলেই ময়মুনা পেয়ে বসবে। সকালে ঝগড়া শুরু হলে তোরাব আলী ময়মুনাকে যেসব কথা বলে খোঁটা দিয়েছে তার সবই এখন ফেরত দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছে ময়মুনা।
তোরাব আলী নিজের পিঠের নিচে আটকে থাকা বড়ইয়ের বিচি বা ওই রকম অন্য কোনো বস্তুকে সরাতে পারছে না, কারণ তার দুটো হাতই কনুইয়ের ওপর থেকে কাটা। যদিও রাতের বেলা না থাকা হাতদুটো দিয়েই সে অনেক কাজ করে, কিন্তু এখন সেই চেষ্টা করলে লোকজনের তার ওপর থেকে মায়া কমে যাবে। ফলে আয় রোজগারে টান পড়বে। তারচে মনে মনে ময়মুনাকে গালি দেওয়া আর সামান্য কষ্ট সহ্য করে যাওয়াই ভালো। তার একটা পা পুরোপুরি ভালো, অন্যটা আংশিক অচল। হাঁটার সময় সে বগলের নিচে একখানা বাঁশের তৈরি ক্র্যাচ ব্যবহার করে। তার হাত ও পায়ের কিভাবে এই অবস্থা হলো তা বলা মুশকিল। তোরাব আলী এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। থাক ওসব, বরং তাদের ঝগড়ার দিকেই মনোযোগী হওয়া যাক।
ওদিকে কেবল নতুন দোকান খুলতে পেরেই যেন স্বাধীনতা পেয়েছে ময়মুনা। দুপুর পর্যন্ত সে প্রায় শখানেক টাকা পেয়েছে। আজ তার প্রায় কোনো কষ্টই করতে হচ্ছে না। ঘোমটা টেনে দিয়ে বসে থাকা আর কারও পায়ের আওয়াজ পেলেই সামান্য আল্লাহ রসুলের নাম নেয়া ছাড়া আজ তাকে কিছুই করতে হচ্ছে না। অথচ অন্যান্য দিন তাকে কত কষ্টই না করতে হয়েছে। সকালের দিকে সামান্য শীত ছিল বলে তোরাব আলীকে নিজের হাতে একটা শার্টের ওপরে দুটো মোটা জাম্পার পরিয়ে দিয়েছে। এখন তার মনে হচ্ছে দুপুর রোদের তাপ সামান্য হলেও বেড়েছে। ফলে তোরাব আলীর অন্তত একটা জাম্পার খোলা উচিত। ময়মুনা মনে মনে ভাবছে, এবার বোঝো, ময়মুনাকে গালি দিলে কী হয়! কেবল তো শুরু। আজ তোরাব আলীকে সন্ধ্যায় বস্তিতে ফিরিয়ে নেবে না বলেও ভাবছে ময়মুনা। ঘোমটার আড়াল থেকে মাঝে মাঝেই তোরাব আলীকে দেখে তার হাসিও পাচ্ছে। মড়ার মতো চিত হয়ে শুয়ে আছে তোরাব আলী। লোকজন দেখলেই ঘড়ড় ঘড়ড় শব্দ করছে, সেই শব্দ ছাপিয়ে টিনের থালায় কয়েন পড়ার শব্দ শুনে ময়মুনার আরও হাসি পাচ্ছে। কারণ কয়েনের শব্দ মানে দুই টাকা-এক টাকার কারবার। আর শব্দ না হওয়া মানে হলো দুই থেকে দশ টাকার নোটের কারবার। আজকে তোরাবের থালা থেকে টুঙটাঙ আওয়াজই বেশি শোনাচ্ছে।
তোরাব আলীর এখন গা ঘামতে শুরু করেছে। অন্যদিন হলে এতক্ষণে ময়মুনা তার একটা জাম্পার খুলে দিত। চিত থেকে ধরে কাত করে দিত। প্রায় পাঁচঘণ্টা হলো তোরাব আলী চিত হয়ে পড়ে আছে। বুকের ওপর যেখানে টিনের থালা রাখা সেখানেই যেন যন্ত্রণাটা একটু বেশি হচ্ছে। কারণ অন্যদিন সেখানে থাকত ময়মুনার মুখ বা মাথা। আর টিনের থালা থাকত তাদের সামনে। ময়মুনা মেয়েটা যে কত বড় শয়তানী তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে তোরাব আলী। সে এখন ভাবছে বাপ-মা-হারা এই মেয়েটাকে ঠাঁই দেয়াই যেন তার ভুল হয়েছে। মুরব্বি বা স্বামী যাই বলি না কেন তোরাব আলী তাকে বকাঝকা করতেই পারে। এই বিশাল বড় ঢাকা শহরে ময়মুনার তো তোরাব আলী ছাড়া আর কারও থাকার কথা নয়। তোরাব যদি বলে, ‘যা ময়মুনা, তোরে আমি আর রাখুম না, দিলাম তালাক, বাইন তালাক’। তাহলে কি আর তার যাওয়ার জায়গা থাকবে? থাকবে না। তারপরও মেয়েটা কেন তার সাথে ঝগড়া করতে গেল, তোরাব আলী হিসাব মেলাতে পারছে না। নাকি মাগিটা নতুন ভাতার জোটানোর ধান্দা করছে। এমন প্রশ্ন কেবল আজই প্রথম নয়, এর আগেও তোরাব ভেবেছে। কিন্তু ময়মুনার হাবভাবে তেমন কিছুই তো মনে হয় না। গরমে তোরাবের শরীর ভিজে যাচ্ছে। ধুলোবালিতে তা এখন বোধ হয় কাদা হয়ে গেছে। আর শালা একটা বিচি না কী পড়েছে পিঠের নিচে, সেই সকাল থেকে জ্বালাচ্ছে।…
এই সময় তোরাব আলীর কাছে আসে তার মেয়ে তানিয়া। টিভি অভিনেত্রী তানিয়ার সাথে মিলিয়ে তোরাব আলী তার মেয়ের নাম রেখেছে, নাকি নিজের নামের সাথেই মিলিয়েছে তা পরিষ্কার নয়। তানিয়ার গা প্রায় খালি। মাথায় খুশকি আর ধুলোবালির মিশ্রণটার অনুপাত যেন কোনো সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ঠিক করে দিয়েছে। আর তার নাক থেকে যে পদার্থ গড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে তার পরিমাণ এতই বেশি যে সে নিজে গিলে খেয়েও পরিমাণ কমাতে পারছে না। একহাতে আধখানা রুটি, আর অন্যহাতে ইটের টুকরো তানিয়ার। রুটি আর ইট যে একসাথে খাওয়া যায় না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তার রুটিটুকুকেও প্রথম দেখায় খাদ্য নয়, বরং অন্য কিছুই মনে হবে। তানিয়ার দুই হাতের ময়লাই এর জন্য দায়ী।
বাজান মায় কই। সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী তানিয়া তোরাব আলীর কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করেই দৌড়ে ঘোমটা দেয়া ময়মুনার কাছে চলে যায়। মা তুই ইহানে ক্যাÑ বলেই মেয়েটা ময়মুনার ঘোমটা খুলে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু ময়মুনা জানে এখানে মা মেয়ের প্রেম-ভালোবাসার মানে টিনের থালায় টুঙ করে আওয়াজ, নিঃশব্দে দুই-পাঁচ-দশ টাকার নোটের পতন নয়। ফলে মেয়েকে এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিয়ে আবার ঘোমটা টেনে পথচারীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে কোরআনের কোনো এক সুরা ভুলভালভাবে আওড়াতে শুরু করে, যদিও তাতে সুর বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
তানিয়া তার বাবা তোরাব আলীর থালায় রাখা কয়েনগুলোর সংখ্যা কত হবে তা অনুমান করার চেষ্টা করছে। সে তার এই থালা থেকেই কমপক্ষে দুই-তিনটা কয়েন নিয়ে দৌড়ে পালানোর কথা ভাবছে। আজকেই সুযোগ। সব দিন তার বাবা-মা একসাথে বসে। তাই থালায় হাত দিলেই ময়মুনা বেগম তাকে ধমক দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, আরও বেশি কিছুও করে। বেশি কিছু আর কী, পিঠের ওপর দুমদাম দুই-চারখানা কিল। ওসব কিছু তার সয়ে গেছে। আজ মা আলাদা বসেছে। আর বাবা তো পুরোপুরি লুলা। ফলে পুরো থালা নিয়ে দৌড় দিলেও তার বাবার কিছুই করার থাকবে না। তানিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সুযোগ খুঁজছে।
মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তোরাব আলীর গলার স্বর এখন আর অন্য সময়ের মতো ঘড়ড় ঘড়ড় ঘড়ড় করছে না। শব্দটা হচ্ছে, তবে ঠিক ততটা বিভৎস হয়ে উঠছে না। এই মেয়েটাই যেন তোরাব আর ময়মুনার মাঝে সাঁকো হয়ে আছে। তোরাব আলী জানে, তানিয়ার কারনেই ময়মুনা তাকে ছেড়ে যাবে না। যদিও আজকের এই ঝগড়ার পর তার মনে হয়েছে মাগিটা গেলেই যেন সে বাঁচে। আবার এ-ও সে ভেবেছে, প্রায় একযুগ ধরে তানিয়ার মা, মানে ময়মুনাই তো তাকে আগলে রেখেছে। হাত-পা ছাড়া একটা মানুষকে দেখে-শুনে রাখাও তো কম কঠিন কাজ নয়। যাই হোক, আজ ময়মুনা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করেছে। স্বামীকে সে অসম্মান করেছে, তার জাত তুলে গালি দিয়েছে। তোরাব আলী এবং ময়মুনার ব্যাপার বস্তির অন্য পাঁচজন থেকে একটু আলাদা। বস্তিতে থাকাকালে না পারলে কারও সাথে গলা বাড়িয়ে কথা বলে না ময়মুনা। আর সারাদিন তোরাব আলীর গলার সাথে সুর মিলিয়ে কান্নাকাটি করার পর অবশ্য ঝগড়া করার শক্তিও থাকার কথা নয়। এসব অনেক কারণেই তোরাব আলী ময়মুনা বেশ ভালোই বাসে। চাইলে সে অন্য ভিক্ষুকদের মতো আরও দুই-একখানা বিয়ে করতে পারত কিন্তু করেনি, ময়মুনার এই ভালো কিছু স্বভাবের কারণেই।
তোরাব আলী মেয়েকে ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করল যে তার পিঠের নিচে কিছু একটা ঝামেলা করছে, ওটাকে সরিয়ে দিতে হবে। মেয়েটা কী বুঝল, বোঝা গেল না। তানিয়া তার রুটিটার বাকি অংশ থেকে নিজে একটা কামড় বসিয়ে বাকিটা বাবার মুখে পুরে দিল। মেয়ের এই আহাম্মকীপনায় তার রাগ হওয়ার কথা, কিন্তু তা হলো না, বরং মেয়েটা যে তার ক্ষুধার কথাও ভাবে এটা চিন্তা করেই সে খানিকটা শান্তি পেল। তবে পিঠের দিকের বিষয়টা মেয়েকে বোঝাতে না পেরে এবার বুকটা উঁচু করে দিল। তানিয়া এতক্ষণ ছিল হাঁটু গেড়ে। এবার মাথা নিচে করে বাবার পিঠের দিকে তাকাতে গিয়ে তার ধাক্কায় টিনের থালাটা গেল উল্টে। ব্যাস, আর যায় কই? কয়েনগুলো গড়াতে শুরু করল। বিষয়টা বুঝতে পেরেই তোরাব আলী আবার শুরু করল ঘড়ড় ঘড়ড় ঘড়ড়ড়ড়ড়। মানে-সব টাকা পয়সা গেলরে। ও ময়মুনা, কই গেলি, তাড়াতাড়ি আয়, তোর মাইয়া সর্বনাশ করছে। ওদিকে ময়মুনা কিন্তু ঘোমটা টেনে দিয়ে বসে আছে। সে এখনও দ্যাখেইনি যে তার স্বামী আর মেয়ে কী কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে।
তানিয়া একটা কয়েনের গতি থামাতে দৌড় দিতেই এক পথচারির সাথে তার বলা যায় মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। পথচারীকে আমরা একটু রগচটাই বলতে পারি। কারণ ওইটুকু মেয়ের ধাক্কায় তার কিছু না হলেও মেয়েটার গালে ঠাশ করে একটা থাপ্পর মেরে দিল। অবশ্য এসময় তানিয়ার কান্না করার সময় ছিল না। তাকে সবগুলো টাকা কুড়িয়ে টিনের থালায় জড়ো করতে হবে, না হলে আজ আর পিঠের হাড় আস্ত থাকবে না। তানিয়া একবার ডান দিকে তো একবার বাম দিকে ছুটে যাচ্ছে। আর কয়েনগুলোও যেন দুষ্টুর দল, তানিয়ার সাথে কানামাছি খেলছে।
নিজের মুখের কাছে শূন্য টিনের থালাটিকে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তোরাব আলী ফুঁসতে শুরু করেছে। মেয়েটাকে কষে একটা লাথি মারতে ইচ্ছে করছে। আর তারও বেশি রাগ হচ্ছে ময়মুনার ওপর। ময়মুনা যদি এখন পাশে থাকত তবে কি এই ঘটনা ঘটত! মাগিটাকে আজ ঘরেই নেব না- এমন ভাবনাও তোরাব আলীর মাথার মধ্যে কিলবিল শুরু করেছে। ঠিক এই সময় ঘটল আরেক ঘটনা। তানিয়া একটা পাঁচ টাকার নোট রাস্তা থেকে তুলে নিতেই জনৈক ট্রাফিক পুলিশ তাকে খপ করে ফেলল। তানিয়া তার এই জীবনে অনেকবারই পুলিশের হাতে মার খেয়েছে। তাই আজকে আর নতুন করে কিছু ভাবছে না।
ট্রাফিক পুলিশ সাহেব তানিয়াকে বলছে, ‘কিরে পকেটমারের পার্টনার হইছস? তুই কি মাইয়া না পুলারে! প্যান্ট খোল, দেইখা লই’।
আচ্ছা বলতে ভুলে গেছি তানিয়ার বয়স যেহেতু পাঁচ আর তার গড়নটাও ঠিক ছেলেদেরই মতোই, তাই হয়তো পুলিশ সাহেব এমন একটা অসভ্য প্রশ্ন করেছে। তানিয়া পুলিশের মুঠো থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যর্থ হলো।
সে বলতে থাকল, ‘আমি পকেট মাইরের দলে নাই, আমার বাপে ভিক্ষা করে, ধাক্কা লাইগা হের ট্যাহা পয়সা পইড়া গ্যাছে, ছ্যার’।
দয়া হলো পুলিশ সাহেবের, তানিয়াকে ছেড়ে দিল। পুলিশ সাহেব এই মোড়ে দিনে আট ঘণ্টা ডিউটি করেন। তিনি তোরাব আলী এবং ময়মুনাকে এখানে অনেকবারই ভিক্ষা করতে দেখেছেন। কিন্তু তানিয়াকে দেখেছেন বলে তার মনে পড়ল না। যাক, থাকতেও পারে ফকিরটার মেয়ে- এমন ভেবেই বোধ হয় তানিয়াকে ছেড়ে দিলেন। ওই দিকে ময়মুনা কিন্তু ঘোমটা টেনেই বসে আছে। সে কিছু জানতেও পারল না। তার স্বামীর কত টাকা আজ হাওয়ায় উড়ে গেল, রাস্তার ধুলোয় গড়িয়ে গেল কত পয়সা!
তোরাব আলী দেখছে তার টিনের থালা এখনও উল্টে আছে। মানে তানিয়া শয়তানীর বাচ্চা শয়তানী টাকা পয়সাগুলো কুড়িয়ে আনতে পারেনি। আজ মা-মেয়ে দুটোকেই ইচ্ছামতন পিটুনি দিতে হবে। নাহলে তার রাগ কমবে না- ভাবছে তোরাব আলী। কেবল মনের ভাবনায় তো আর কাজ হবে না। তাই সে এখন শুরু করল মরণগোঙানি। ঘড়ড়ড়ঘঢ়ঢ়ঢ়ঢ়ঢ়ঘঢ়ঢ়ঢ়ঢ়ঢ়ঢ় ঘঘঘঘঘ ঘঘড়ড়ড়ড়ড়ড়ড়। তার এই গোঙানির কী মানে- তা আগেই বলেছি। এ গোঙানির মধ্য দিয়ে ডাকা হচ্ছে ময়মুনাকে, কেবল ডাকই নয়, গালাগালও করছে তোরাব আলী। এসব গালির মধ্যে কিছু আছে বংশ নিয়ে, কিছু আছে বাপ-মার প্রসঙ্গ, আর কিছুতে সে মনে মনে জুড়ে দিচ্ছে ময়মুনার গোপন অঙ্গের বিষয়-আশয়। তানিয়া তার এই গোঙানির মানে বোঝে সামান্য হলেও। সে হয়তো এইটুকুই বুঝতে পেরেছে- বাবা খুব রাগ করেছে, তাড়াতাড়ি টাকা-পয়সাগুলো কুড়িয়ে টিনের থালায় রাখতে হবে।
তানিয়া যে টাকাগুলো কুড়িয়ে নিতে পেরেছে সেগুলো প্যান্টের কোচড়ে রেখেছে। কিন্তু তার ছুটোছুটিতে কোচড়ই বা আর কতক্ষণ ঠিক থাকে। ফলে সেখান থেকেও যে দুই-চার টাকা পড়ে যায়নি আর তা তুলতে গিয়ে অন্য টাকা সে কুড়াতেই পারেনি- তা-ই বা কে বলবে! তবে আবার আপনারা ভাববেন না যেন তোরাব আলীর টাকার বস্তা উল্টে গেছে। উল্টে গেছে তার সামান্য ভিক্ষার থালা। আর সেই সামান্য টাকা কুড়িয়ে নিতেই তানিয়া, যে কিনা পাঁচ বছরের মেয়ে- সে হয়রান হয়ে পড়েছে। কেবল হয়রান হয়েই নয়, সে একটা প্রাইভেট কারের নিচেও পড়েছে এখন। একটা চঞ্চল পাঁচ টাকার কয়েন যখন তানিয়ার কোচড় থেকে পড়ে গিয়ে রাস্তার দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছিল তখন তানিয়াও দিল ছুট। ব্যাস, ছুটে আসা প্রাইভেট কার দিল তানিয়াকে একটা ধাক্কা। না, তার তেমন কিছুই হয়নি। গাড়ির ধাক্কায় সে গিয়ে পড়েছে তার মায়ের গায়ে। আর তাতে করে তার মায়ের টিনের থালাও গেছে উল্টে।
আরও খানিকক্ষণ বাদে দেখা গেল তোরাব আলী আর ময়মুনা একই সাথে বসে আছে। তাদের ঝগড়া হয়তো মিটে গেছে। আর দুজনের মাঝখানে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তানিয়া। ক্ষুধা, নয়তো গাড়ির ধাক্কার ব্যথায়। তবে তার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তোরাব আলী আর ময়মুনার ডুয়েট ভিক্ষাপ্রার্থনাগীত এখন বেশ উঁচুগ্রামেই বাজছে। থালা উল্টে যাওয়ার ক্ষতি তাদের পুষিয়ে নিতে হবে। আর হ্যাঁ তোরাব আলীর পিঠের নিচে সেই বিরক্তিকর জিনিসটা এখন আর নেই।