– তোরা যা-ই বলিস, এই একটিমাত্র কারণেই তসলিমা নাসরীন বাংলাদেশের সব মেয়ের স্যালুট পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। বাইরেই শুধু নয়, পরিবারের ভেতরেও সেক্সুয়ালি এবিউজ হওয়ার ব্যাপারটা তসলিমাই প্রথম সামনে নিয়ে আসে, প্রকাশ করবার সাহস জোগায়।
– তুই তো আবার বিষয়টিকে অন্যদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিস, আমি তো ওর লেখার সাহিত্যমান নিয়ে কথা বলছিলাম।
– আমাদের মতো দেশে তথাকথিত সুশীল সাহিত্যের চেয়ে এ ধরণের মুখোশ উন্মোচন অনেক বেশি জরুরি। আমি তো একে সামাজিক -বিপ্লব বলবো। আমাদের মেয়েরা কতোটা উপকৃত হয়েছে বুঝতে পারিস? আজ যে ‘মি টু’ হচ্ছে, এটার বীজ বাংলাদেশে তসলিমাই প্রথম বুনেছিল।
– সেটা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু সাহিত্যের ভেতর ভিন্ন অভিসন্ধি বা আরোপিত কিছু না থাকাই শ্রেয়।
– কোনটাকে আরোপিত বলছিস তুই? ও যা লিখেছে, তা যথেষ্ট জীবন-ঘনিষ্ট, এবং খুব দরকার ছিল। অবাক লাগে, নানী-দাদীরা নিজেরা ভিকটিম হয়েও মা-খালাদের বেলায় উদাসীন ছিল। আবার মা-খালারা ভিকটিম হয়ে নিজের মেয়েদের বেলায় না-বোঝার ভান করে থাকতো! মেয়েরা যেন পুরুষের সম্পত্তি। এভাবে নিগৃহীত হবে, এটাই যেন স্বাভাবিক।
– সবই মানলাম। কিন্তু সাহিত্যের নামে অপসাহিত্য তো মেনে নেয়া যায় না।
– সাহিত্য, অপসাহিত্য বিচার করে কারা? তোরা যাদেরকে তথাকথিত বড় বড় পুরস্কার দিচ্ছিস, তারা সবাই কি ‘সাহিত্য’ লিখে উল্টে ফেলছে? আসলে আমরা না বড় অকৃতজ্ঞ জাতি। প্রাপ্য মূল্যায়নটুকু করতেও দ্বিধা করি।
– কী রে! থামবি তোরা? কী শুরু করলি বলতো? নে, চা খা। ট্রে-টা বিছানার উপর রাখে ইয়াসমিন।
আসলে সবাই মজা নিচ্ছিল মেঘনা আর শিউলির তর্কাতর্কিতে। মেঘনার ওই এক কথা, এত বড় উপকার করার পরেও মেয়েরাই তসলিমা নাসরিনের বদনাম করে বেশি। আর শিউলিও নাছোড়, তসলিমার প্রতি এই মনোভাবের জন্য তসলিমা নিজেই দায়ী।
তসলিমার ব্যাপারে যতই দ্বন্দ্ব থাক, ওরা সবাই খুব ভালো ফ্রেন্ড, সন্দেহ নেই। সাতজনের গ্রুপে সবাই একইসাথে কর্মজীবি এবং স্টুডেন্ট। প্রায় প্রতি বৃহস্পতিবার মেঘনার রুমেই আড্ডা হয়। আজ অবশ্য ছয়জন আছে। টুম্পাটা টিউশনি থেকে ফেরেনি এখনও। মনের গড়নে ভিন্নতা সত্বেও কী করে এত গাঢ় বন্ধুত্ব হয় –অবাক লাগে মাঝেমাঝে।
পুরোনো বলে তিনতলা বিল্ডিং এর সব ফ্লোরই ব্যাচেলর মেয়েদের ভাড়া দিয়েছে বাড়িওয়ালা। এতে লাভ বেশি। বিল্ডিং-এর নাম মাতৃছায়া হলেও মাস শেষে লোভী বাড়িওয়ালার ছায়া ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। তবু একটা লাভ, বাড়িওয়ালা নিজে থাকেন না এখানে। গ্রামের এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় দেখভাল করে। নিজেদের মতো করে থাকতে পারছে, এতেই খুশি ওরা।
একইসাথে মুক্তার মোবাইল আর ডোরবেলটা বেজে উঠল। টুম্পা ফিরেছে। ফোনে কথা বলতে বলতে মুক্তার মুখে আঁধার ঘনিয়ে এল।
– কী হয়েছে মুক্তা?
– বাবার হাঁপানিটা আবার বাড়াবাড়িরকমের বেড়েছে রে! কালই বাড়ি যেতে হবে। মাসের আজ বিশ তারিখ।
স্ট্রোক হয়ে আজ প্রায় তিনবছর শয্যাশায়ী মুক্তার বাবা। তিন ভাইবোনের মুক্তাই বড়। সামান্য একটা সরকারী চাকুরী করতো। অল্প কিছু পেনশনের টাকা আর মুক্তার পাঠানো টাকা দিয়েই সংসার চলছে টেনেটুনে। এরমধ্যে কারুর অসুস্থতা মানে কী, তা বুঝতে বাকি থাকে না কারো। ওদের মধ্যে মুক্তাই সর্বোচ্চ পরিশ্রম করে। সকালে, বিকালে পার্টটাইম জব, ফাঁকেফাঁকে টিউশনি।
মুক্তার হাতে হাত রাখে ফারিয়া। কিচ্ছু ভাবিস না। গোছগাছ করে নে। কাল গাড়িতে তুলে দিয়ে আসবো। তোর টিউশনগুলোর এড্রেস দিয়ে যাস, আমি কাভার দিব। ফারিয়াকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল মুক্তা। এই ফাঁকে নুসরাত আর মেঘনা মিলে বেশ কিছু টাকা মিলালো। যার হাতে যা ছিল সব একসাথে তুলে দিল মুক্তার হাতে।
– খবরদার! ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা, ঋণ- এসব শব্দ একদম উচ্চারণ করবি না। তাইলে কিন্তু খবর আছে কইলাম! সিগারেট ঠোঁটে চেপে এমনভাবে বললো মেঘনা, না হেসে পারল না কেউ।
– তোকে না বলেছি, সিগারেট খাবি না, দু’হাতে চোখ মুছে শাসনের ভঙ্গিতে বলল মুক্তা।
– আজই শেষ রে দোস্তো! আর খামু না। তুই এত আম্মা আম্মা কেন, মুক্তা? এত ভালো কেন তুই? মুক্তার মাথাটা কাঁধে টেনে নিল মেঘনা। দুজনের চোখেই পানি।
মেঘনা আর মুক্তাকে নির্বিঘ্নে কাঁদতে দিল ওরা। মাঝেমাঝে মন খুলে কাঁদা ভালো। হালকা হওয়া যায়।
দুই
পুরোনো স্মৃতি রোমন্থনের সময় সুমনের মুখটা খুব উজ্জ্বল দেখায়। যেন সেই দিনগুলোই ওর জীবনের মূল্যবান সম্পদ। এরপরে আর কোনো বাড়তি সম্পদ যোগ হয় নি। ঘুরেফিরে সেই একই কথা। তবু যতবার বলে ততবারই মনে হয় এই প্রথম বুঝি বলছে। শ্রোতা হিসেবে নীলার হাবভাব আর মুখের রেখাগুলো এমন থাকে যেন নতুন করে শুনছে।
সুমন তখন থার্ড ইয়ারে পড়ে। ক্লাস, ওয়ার্ড, পরীক্ষা, পড়ার চাপে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। পরেরদিন আইটেম, ক্লাস থেকে ফিরেই বই নিয়ে বসেছে সবাই। হঠাৎ হয়ত ‘ক্যারা’ উঠল মাথায়। চার, পাঁচজনের একটা গ্রুপ আছে ওদের। লিটন, রুবেল, ইসহাক আর শিহাব। সুযোগ পেলেই চলে যায় খেয়াঘাটে। সারি সারি নৌকা বাঁধা সুরমা নদীর ঘাটে। বেশিরভাগ সময় যাওয়া হয় সন্ধ্যা নামার পর। পূর্ণিমা থাকলে তো আর কথাই নেই। সঙ্গে থাকে সিগ্রেট, মারিজুয়ানা আর মাঝেমাঝে বোতল, যখন যেটা ম্যানেজ করা যায়। ধুমসে নেশা করে খেয়াঘাটের নৌকায় চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই। পুর্ণিমার চাঁদটাকে মনে হয় হাতের নাগালে। অমাবস্যায় তারার মিটমিট দেখতে দেখতে আবেশে চোখ বুঝে আসে। অপরূপ সৌন্দর্য!কখনও কখনও নৌকা ভাড়া করে পুরো নদীটা চক্কর দেয়। মারিজুয়ানার নেশায় চোখের সামনে মেঘ ভাসতে থাকলে শরীরটা পলকা মনে হয়। পিঠে ডানা লেগেছে যেন বা। উড়ে যেতে পারে যেকোন মুহূর্তে!রাজা রাজা লাগে নিজেকে। পঙ্খীরাজে চড়ে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশ-বিদেশ। মেঘের ভেতর দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে পাহাড়, নদী, সমুদ্র!
স্মৃতিচারণে বেশ অর্থবহ সঙ্গ দেয় নীলা। বহুবার শোনার পরেও প্রথমবার শোনার মতো বড় বড় চোখ করে বিস্ময় প্রকাশ করে,অধীর আগ্রহে কৌতূহলী হয়ে ওঠে ‘তারপর কী হল?’ এতে সুমন দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে শুরু করে।
এই মুহূর্তে দুজনেই টালমাটাল অবস্থায় আছে। মারিজুয়ানার দুটো স্টিক অলরেডি শেষ। ফাঁকেফাঁকে সিগ্রেট তো আছেই। নীলাই বেশি টেনেছে আজ । হাত বাড়িয়ে সামনে ভেসে বেড়ানো মেঘটাকে ধরবার চেষ্টা করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে সুমনের গায়ের ওপর। এসময়ে নীলার ইউফোরিক ভাবটা খুব এনজয় করে সুমন।
টালমাটাল হলেও সময়জ্ঞান হারায় না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে! দুটো বেজে পাঁচ। দ্রুত বেরুতে হবে। একঘেয়ে টানাপড়েনের জীবনে তিন/চার মাসে একবার বহু প্রতিক্ষিত, অতি কাঙ্খিত এই দুটি ঘণ্টাও ফুরিয়ে যায় চোখের পলকে। এই সুখটুকুই ওদেরকে ভালো থাকতে সাহায্য করে বাকিটা সময়।
ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় পড়ে অভ্যস্ত হাতে অতি দ্রুত তৈরি হয়ে নেয় দুজনে। যার যার গন্তব্যে ফিরে মিশে যেতে হবে চিরাচরিত জীবনে।
তিন
ওর সাথেই কেন এমন হল? ভেবে কূল পায় না তমা!এত সুন্দর সংসার। বন্ধু আর পরিবারমহলে ঈর্ষণীয় জুটি ওরা। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!মাহবুব বেশ ভালো। খুব কেয়ারিং। তমার ব্যাংকের চাকুরী,ভার্সিটিতে মাহবুবের শিক্ষকতা,গবেষণা–ভালোই চলছিল সব। বিয়ের প্রথম দুই বছর দেশে-বিদেশে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছে। কোনো ধরণের খবর ছাড়াই যখন তিন বছর পার হয়ে গেল,তখনই টনক নড়ল তমার!মাহবুব তেমন গা করলো না। কিন্তু তমার চিন্তা হতে লাগল। সেই থেকে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে ছোটা। এখনও চলছে। ঠিক প্রেমের বিয়ে না হলেও আগে থেকেই জানাশোনা ছিল দুজনের। বলা যায় বেশ প্ল্যানিং করে গুছিয়ে নিয়ে বিয়ে করা। কিন্তু আসলেই কি গোছানো যায়,সব? ইনভেস্টিগেশনে তমার ইউটেরাস আর ওভারিতে পাওয়া গেল নানান সমস্যা। দেখতে দেখতে চার বছর কেটে গেল। অষুধেও তেমন ফলপ্রসূ কিছু হল না।
ডোরবেলের শব্দে দরজা খুললো তমা। কাজের মেয়ে আমেনা। ছুটির দিন হলেও কিছু এসাইনমেন্ট নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে মাহবুব। শীতের মধ্যেও আমেনার নাকের নীচে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। তিন ছেলে থাকার পরেও আবার সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। সারা শরীর জুরে আলগা নরম লাবণ্য। ঢলঢলে মুখটাতে মায়ামাখা। বুক, পেট, নিতম্ব ভরাট হয়ে উঠেছে। এবার প্রেগন্যান্ট হবার পর খুব বকেছিল তমা। লাজুক স্বরে জবাব দিয়েছিল,’আমার জামাইটা খুব বদমাইশ কিসিমের আফা,একটা রাত্রও ছাড়ে না,আবার কোনো পদ্ধতিও আইনা দেয় না।হের আবার একটা মাইয়ারও খুব শখ’। মুখে বদমাশ বললেও চেহারার রং বদল তা সমর্থন করে না। রিকশাওয়ালা জামাইয়ের শখ দেখে আর বাঁচে না তমা। মুখে যা আসে তাই বলে গালাগালি করে ও। প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই রাগ কি দেখায় তমা!ভেতরে ভেতরে কি একটু ঈর্ষাও অনুভব করে? মন চাইলেই, ইচ্ছে হলেই সন্তান নিতে পারে ওরা!ডাক্তার ছাড়া,অষুধপত্র ছাড়া,হাসপাতাল ছাড়া!গত তিনবার বাসাতেই ডেলিভারি হয়েছে। এবার তমা হাসপাতালে ডেলিভারি করানোর সব দায়িত্ব নিয়েছে।
আমেনার বিকশিত শরীরের দিকে মাহবুবের চোখ পড়ায় খাবার টেবিলে বিব্রত বোধ করেছিল সেদিন। বেশি ভারী কাজ দিতে মানা করল তমাকে। রাগে-ক্ষোভে বিস্ফোরিত হল তমা ভেতরে ভেতরে। সেদিনই কেন জানি, ইচ্ছে করেই আমেনাকে দিয়ে অনেক কাপড় কাঁচাল, দুইবার করে ফার্নিচার আর ঘর মোছাল। পরে অপরাধবোধ আর বোবাকান্নায় জেগেছে সারারাত।
শেষবার পরীক্ষায় জানা গেছে তমার ওভারিতে ডিম্বাণুর রিজার্ভ একদম কম। টেস্টটিউব বেবিই একমাত্র পথ, তবে সেটাও সাকসেস হবার সম্ভাবনা কম। এতদিন কিছুটা শক্ত থাকলেও, এবার ভীষণ ভেঙ্গে পরেছে। সাথে নতুন একটা উপলব্ধি হচ্ছে। গর্ভধারণের সম্ভাবনা না থাকলে সম্ভবত যৌনকাঙ্খাতে পরিবর্তন দেখা দেয়। পারস্পরিক আকর্ষণও কি কমে যায় কিছুটা! গত দু’বছর ধরে ডাক্তারের বেধে দেয়া ডেট অনুযায়ী সেক্স করতে মাহবুবের অনীহাটা স্পষ্ট টের পায় তমা। আগের মতো আগ্রহটা আর নেই। ফ্রেন্ডদের দেখেছে আনপ্ল্যানড ইন্টারকোর্স হয়ে গেলে সে কী টেনশন! সেই টেনশনের সাথে কেমন যেন আদুরে আহলাদ আর অহংকার মিশে থাকে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় তমা। কুয়াশায় সাদা হয়ে আছে। প্রকৃতির শীতকাল চলে যাবে একসময়, তমার হৃদয়ের শীতের কী হবে! ছলছল করে ওঠে তমার চোখ।
চার
সাতসকালে পিঠা আর খেজুরের রস নিয়ে বিয়ের দাওয়াত দিতে হাজির নীলার ননস মনোয়ারা বেগম। ছোটোমেয়ে মুনমুনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। গ্রামের লোকদের এই এক সমস্যা! সকাল সকাল মানুষের বাসায় গিয়ে হাজির হয়। ব্যাপারটা ভীষণ অপছন্দ নীলার। বিয়ের প্রথম প্রথম বাধ্য হয়ে উঠে হাসি হাসি মুখ করে গল্প করতো। এখন আর ভুলেও সে চেষ্টা করে না। অসহ্য লাগে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। মোটে সাতটা বাজে! মাথার উপর কানে বালিশ চাপা দিয়ে পাশ ফিরে শোয় নীলা। ড্রইংরুম থেকে নোমান আর মনোয়ারার কথাবার্তার হালকা শব্দ কানে আসে। কী বিষয়ে কথা হচ্ছে ঠিক শোনা না গেলেও বুঝতে পারে নীলা। জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে নীলা। নাহ, ঘুমটা বোধহয় কেঁচেই গেল! মহাবিরক্তি নিয়ে চোখ বুজে রইলো নীলা।
মনোয়ারা বেগমের স্বামী মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত অবস্থাতেই মারা যায়। ওমানে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করতো। বড় মেয়েটার বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিল। অবিবাহিত এক মেয়ে আর তিন ছেলেকে নিয়ে বিধবা হয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখেছিল মনোয়ারা বেগম। সেদিন থেকেই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, যে করেই হোক মেয়েটিকে পার করতে হবে তাড়াতাড়ি। গ্রামদেশে বাপ-ছাড়া মেয়ের বিয়ে হতে এম্নিতেই অনেক ঝামেলা তার উপর মেয়ের বয়স বেড়ে গেলে আরও মুশকিল। প্রবাসী ছেলে। সৌদি আরবে একটা কাপড়ের দোকান চালায় পার্টনারশিপে। একটু বড় পরিবার হলেও ছেলের আয়-রোজগার ভালো। এমন ছেলে পেয়ে আর হাতছাড়া করতে চায় নি মনোয়ারা। পাকা কথা দেয়া হয়ে গেছে।
বিয়ের পরপর ছোটভাইয়ের বউ নীলাকে খুব স্নেহ করতো মনোয়ারা বেগম। পরে আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়ে। নীলার চাকুরী, ছেলেমেয়ের পড়াশুনা, শহুরে জীবনের টানাপড়েনে যোগাযোগটা ঠিক তেমনভাবে হয়ে উঠত না। অথচ প্রথম দিকে কত গল্প শোনাতেন মনোয়ারা বেগম। গ্রাম্য একান্নবর্তী পরিবারের প্রবাসী বড়ছেলের বউ হয়ে আসেন। নিদারুণ কষ্টে কেটেছে তার দিন। রোজগার তেমন বেশি না থাকায় পাঁচ – ছয় বছরের আগে দেশে আসতে পারতো না। যৌবনের সময়গুলো একা কাটানোর কষ্টের কথা শেয়ার করেছিল নীলার সাথে। সারাটা দিন কাজেকর্মে সময় কাটলেও রাত্রিবেলা একা একা ছটফট করতো। অনেকসময় দু’চোখের পাতা এক করতে করতে ফজরের আজান পড়ে যেত। কী শীত কী গ্রীষ্ম তখনই উঠে ঝপঝপ করে গায়ে পানি ঢেলে নামাজে বসে যেত। একবুক হাহাকার নিয়ে বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে শুরু করে দিত প্রাত্যহিক কাজকর্ম। উঠান ঝাড়ু দেয়া থেকে শুরু করে হাঁসমুরগির খাবার দেয়া, পানি ভরা, কাপড় কাঁচা, শ্বশুর-শ্বশুড়ির খেদমত করা, রান্না করা। দিনগুলো এভাবেই যেত। সন্ধ্যের সাথে সাথেই রাত হয়ে যেত গ্রামে। রাতটা ভীষণ বড় মনে হত মনোয়ারার। শরীর আর মনের চাঞ্চল্য কমাতে কোরআন শরীফ পড়ত, চাদরে ফুল তুলতো, জামাকাপড় সেলাই করতো। বড় কষ্টের সেসব দিন। স্বামী বিদেশ থেকে এলে চোখের পলকে দিন-রাত কেটে যেত। শরীরে বয়ে যেত সুখের নহর। মাঝেমাঝে অভিমান হত। ভাবতো, স্বামীকে তার কষ্টের কথাগুলো বলে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার দমে যেত। অনেক ভালো মানুষটা তার। রাতদিন খেটে মরছে পরিবারের মানুষগুলোর মুখে ভাত জোগাতে। তারও যে মনোয়ারার জন্য, সন্তানদের জন্য মন কেমন করে, বোঝে সে। এর মধ্যে মনোয়ারার কষ্টের কথা বলে তার দুঃখ বাড়িয়ে কী লাভ! যতদিন দেশে থাকত, মানুষটার যত্নআত্তি আর সেবাযত্ন করে কাটিয়ে দিত মনোয়ারা। যাবার দিন কিছুতেই আর সামনে আসত না। মুখটা দেখলে যে আবার দূর্বল হয়ে পড়বে সে। আহা যৌবনকাল! আহা যৌবন-কাতর দিনগুলো!
এতকিছুর পরেও বড়মেয়েকে বিয়ে দিল প্রবাসীর কাছে। এখন ছোটোমেয়েরও একই পরিণতি! চট্টগ্রামের চিরাচরিত নিয়ম। এটাই নিয়তি। অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যটাই মূখ্য। বিশেষ করে বিয়ের ক্ষেত্রে। দারিদ্রের চেয়ে বড় অভিশাপ বোধহয় আর কিছুই নেই। যে কষ্ট মা করেছে এখন সেটাই মেয়েরা করবে।
আর শুয়ে থাকতে পারলো না নীলা। উঠে ড্রইংরুমের দিকে গেল।
পাঁচ
এতো রাতে আবার কে ফোন করলো? বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো সুমন। জগন্নাথ দা’র ফোন বলেই রিসিভ করল। অন্য কেউ হলে এতো রাতে ফোন ধরার প্রশ্নই আসে না!ও পাশ থেকে কাতর কণ্ঠ, সুমন,এক্ষুনি নীচে আসো প্লিজ!আরে! দাদা কি কাঁদছেন নাকি? প্রশ্নের উত্তর শোনার সুযোগ হলো না,লাইনটা কেটে দিলেন। বিরক্তির চেয়েও এখন বিস্ময় কাজ করছে বেশি। স্লিপিং গাউনের পাজামার পকেটে মোবাইলটা পুরে স্লিপারে পা গলাল সুমন। রাত ১টা বেজে কুড়ি। কী এমন হলো যে এতো রাতে দাদা ডাকলেন!এমনিতে খুব নিরীহ, নিপাট ভদ্রলোক জগন্নাথ দা। খুব মুশকিলে না পড়লে এভাবে ফোন করার কথা না। ফোনের শব্দে লুবনাও জেগেছে। লুবনাকে ব্যাপারটা বলেই বেরিয়ে গেল সুমন।
দাদার ফ্ল্যাটটা লেভেল সেভেনে। দারোয়ানকে লিফট ছাড়তে বলতে গিয়ে দেখে, লিফটের লাইট জ্বলছে। তার মানে আগেই কেউ ছাড়িতে বলেছে। কোনো অঘটন হলো না তো!ভাবতে ভাবতেই আবার ফোন বেজে উঠল। এবার পাল দাদা করেছেন। অনিমেষ পাল। দুই দাদাই সুমনের ডিপার্টমেন্টে। দুজনেই প্রফেসর। সুমনের অনেক সিনিয়র।অফিসে স্যার ডাকলেও,একই বিল্ডিং এ থাকার সুবাদে অফিসের বাইরে দাদাই ডাকে। লিফটে শূন্য বাটন চাপলো সুমন। পাল দাদা গ্রাউন্ড ফ্লোরেই যেতে বলল। মাথায় কিছুই আসছে না সুমনের। কী এমন ঘটল? এতো রাতে জরুরি তলব!
নীচে নেমেই দেখে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পড়া জগন্নাথ দা কাঁদো কাঁদো মুখে বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবভঙ্গিতে বিপন্ন দেখালেও এই গেট-আপে দাদাকে জোকারের মতো লাগল সুমনের। তাঁকে ঘিরে আছে পাল দাদা,সবুজ ভাই আর খায়ের ভাই। জগন্নাথ দাদা ছাড়া সবাই সিগারেট টানছে। পাল দাদা এগিয়ে এসে সুমনকে একপাশে নিয়ে এল। সিগারেটের কেস বের করে সুমনকে অফার করল।
মোটামুটিভাবে যা বোঝা গেল, তাতে দুঃখবোধ হবার কথা থাকলেও দম ফেটে হাসি পেল সুমনের! ইন্টারকোর্স করতে না-পারার দরুন নিরুপমাদি, দাদাকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। লাস্ট কয়েকবছর ধরেই নাকি ইরেকটাইল ডিসফাংশান হচ্ছিল। দিদিও মারপিট চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আজ একেবারে প্রকাশ্যে!পাল দাদা গিয়েছিলেন দিদিকে বোঝাতে। দরজা খুলছেন না কিছুতে।
কত বিচিত্র মানুষ। কত বিচিত্র তাদের মন,চিন্তা-চেতনা। কেউ চেয়ে পাচ্ছে না,আবার কেউ পেয়েও চাইছে না। মাসের পর মাস যায়,লুবনার সাথে ব্যাপারটি হয় না। কালেভদ্রে যদিও বা হয় তাও চরম অনিচ্ছা আর অপমানজনক কথাবার্তার পর। অনিচ্ছার কারণটাও জানে না সুমন। ইদানিং সাংসারিক প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলতে ইচ্ছে করে না। কথা বললেই সেটা ঝগড়ায় না গড়িয়ে কিছুতেই ছাড়ে না লুবনা। অফিস থেকে ফিরে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটায়। তাতেও লুবনার আপত্তি। বাচ্চাদের শাসন করে না। ওর প্রশ্রয়েই নাকি বেয়াড়া হয়ে উঠেছে। সারাক্ষণ শুধু খিটখিট। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে যে দিকে দুচোখ যায় চলে যেতে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস পড়ল সুমনের। গত কয়েকবছর নীলার সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর থেকে ডিপ্রেশন অনেকটা কমেছে। একজন শেয়ারিং এর মানুষ থাকা খুব দরকার। তবে,একটা ব্যাপারে একদম নিশ্চিত সুমন- পারিবারিক,সামাজিক সমালোচনা আর লোকলজ্জার ভয় না থাকলে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকলে বেশিরভাগ সংসারই টিকত না।
জগন্নাথ দা’র দুখী দুখী চেহারা দেখে মায়া হতে লাগল সুমনের। আহা! বেচারা! একটু একটু কাঁপছে বলেও মনে হলো,ঠাণ্ডায় নাকি লজ্জায়,কে জানে? সুমনকে ডেকেছে, দিদিকে কোনোভাবে পটানো যায় কিনা দেখতে! সুমনকে খুব স্নেহ করে দিদি। দেখা যাক চেষ্টা করে, লেভেল সেভেনের দরজায় বেল দিল সুমন।
ছয়
তমাদের ড্রাইভারটাও আজ ছুটিতে। ট্যাক্সি ক্যাব নিয়েই আমেনাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল তমা। রাত থেকেই নাকি পানি ভাঙতে শুরু করেছে। লেবার রুমের বাইরে তমা আর ওর রিকশাওয়ালা জামাই। অপেক্ষারত স্বজনদের সন্তান জন্মের খবর দেয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর জন্মদাত্রী মা-কে বের করে আনা হচ্ছে। সে কী আনন্দ! সে কী পরিতৃপ্তি চোখেমুখে!সন্তান জন্ম দিতে পারাই বুঝি একমাত্র গৌরব, একমাত্র প্রাপ্তি!
নার্স এসে খবর দিয়ে গেল, ছেলে হয়েছে আমেনার। ওর জামাইয়ের মেয়েসন্তানের শখ মিটল না!আমেনার ভাষ্যমতে ‘বদমাইশি’ করে ওরা কি আবারও সন্তান নিবে? তোয়ালে জড়ানো কী সুন্দর ফুটফুটে একটা পুতুলসহ হুইলচেয়ারে করে বেরিয়ে এল আমেনা। তমার হাত ধরে গভীর আবেগে কেঁদে ফেলল আমেনা,’আফা, আফনে আমার লাইগা যা করছেন, এইডা জীবন দিয়াও শোধ দিতাম পারুম না। আফনের মন চাইলে এই বাইচ্চা আফনে লইয়া লন’।
‘না, না, এসব কী বলছ আমেনা!তোমার সন্তান আমি নেব কেন?’
তৎক্ষণাৎ তমার স্বামী অতর্কিতে ছোঁ মেরে বাচ্চাটা কোলে তুলে নিল।যেন বা কেউ ছিনিয়ে নিচ্ছে ওর কাছ থেকে। দ্রুতগতিতে বারান্দা পেরিয়ে গেল।
তমা ওর যাওয়ার পথে চেয়ে রইল। ‘ভয় নেই, তোমাদের সন্তান তোমাদেরই থাকবে’,আমেনাকে আস্বস্ত করল তমা।
সাত
একঘেয়ে আর কষ্টকর জীবনে ছোটখাটো ইভেন্টগুলো এনজয় করা উচিত। মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার সময়টা উপভোগ করার চেষ্টা করে নীলা। কালো কাচের ভেতর দিয়ে চারপাশ দেখার এটাই সুবিধা,নীলা সবাইকে দেখে কিন্তু নীলাকে কেউ দেখতে পায় না। মাঝেমাঝে রাস্তাটাকে ‘জীবন’ বলে মনে হয় নীলার,বিভিন্ন ধরণের গাড়িগুলো ভিন্ন ভিন্ন মানুষের প্রতীক। কেউ নিয়ম মেনে পিছিয়ে পড়ছে, কেউ বা কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে ওভারটেক করে চলে যাচ্ছে, আবার কেউ দক্ষতার অভাবে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এগোতে পারছে না। অল্পকথায় এটাই জীবন,জীবনের আসল রূপ। জীবন চলার পথ কেউ পার হয় পায়ে হেঁটে,কেউ রিক্সায়,কেউ বাসে,কেউ জাগুয়ারে,কেউ বিএমডব্লিউতে!দিজ ইজ দ্য ফ্যাক্ট এন্ড দিজ ইজ দ্য লাইফ।
নানারকম গাড়ি,ছুটে-চলা মানুষ,সাইনবোর্ড দেখতে দেখতে পেরিয়ে যায় গন্তব্যের দূরত্ব। গাড়ির কাচের মধ্য দিয়ে মানুষের সাইকোলজি বোঝার চেষ্টা করে নীলা।প্রতিটা মানুষ ইউনিক। প্রতিটি মানুষ আলাদা।রোজই নানা ঘটনা চোখে পড়ে। সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার হচ্ছে,ছেলে পথচারীদের মেয়েদের দিকে নোংরা দৃষ্টিতে তাকানো। হেঁটে যাওয়া মেয়েদের পেছনের দিকে,সামনের দিকে লোলুপ দৃষ্টি দেয়া পুরুষদের মধ্যে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে গাড়ি হাঁকিয়ে চলা উচ্চবিত্তরাও আছে। ছেলে-ছোকরা থেকে শুরু করে প্রবীণরাও আছে। স্বাস্থ্যবতী একটা মেয়ে ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। পেছন দিকটা বেশ ভারীই বলা চলে। এক ছোকরা সিগারেটে টান দিতে দিতে গভীর সুখে চোখ দিয়ে লেহন করে চলেছে! কালো কাচের মধ্য দিয়েও ছেলেটার ভেতরকার কুৎসিত জীবটাকে দেখতে পেল নীলা। এসব দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। মাথায় আগুন ধরে যায়! মাঝেমাঝে মেজাজ এত খারাপ হয়। ইচ্ছে করে গাড়ি থেকে নেমে দুটো চড় মেরে আসতে।
নীলা স্বাধীনচেতা,এক্সট্রোভার্ট টাইপের মেয়ে। সাহসীও বলা চলে। অথচ ওর জীবনেও কিছু সময় এসেছে যখন পুরুষ নামের পশুদের ভয়ে সিটিয়ে গেছে। স্কুলে পড়াকালীন দোকানে জুতো কিনতে গিয়ে সেলসম্যান বিশ্রীভাবে ওর ঊরু স্পর্শ করে। আরেকবার অনার্স পড়ার সময় টিউশনি শেষে সিঁড়ি দিয়ে ছয়তলা থেকে নামতে গিয়ে চতুর্থতলায় আসামাত্র ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। ওর ঠিক পেছনেই একজন লোক নামছিল। ঘুটঘুটে আঁধারে পেছনের লোকটির কথা ভেবে হঠাৎ হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। একবার ফেনী থেকে ফেরার পথে কোনো গাড়ি না পেয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী এক বাসকে হাত দেখাতেই গাড়িটি থেমে যায়। ডোরলক গাড়িটার দরজা খুলে এটেনডেন্ট ‘চট্টগ্রাম যাবেন? চলুন’ বলেই নীলাকে ওঠার জায়গা করে দেয়। নীলাও উঠে পড়ে। ভেতরে তাকাতেই দেখে, তিনজন লোক আর ড্রাইভার ছাড়া গাড়িতে কেউ নেই। সবার মুখেই ভয়ংকর, অশুভ হাসি। এদিকে ড্রাইভারও গাড়ি টান দেবার তোড়জোড় করছে। প্রচণ্ড রিস্ক নিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকেই নেমে পড়ে নীলা। ঘটনাগুলো ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ও বয়সে ঘটলেও সবক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা নোংরা ও ভীতিকর। নীলার স্বাভাবিক স্মার্টনেস,শিক্ষা বা সাহস কোনো কিছুই তাকে এই ভয়ের হাত থেকে মুক্তি দিতে পারে নি। ওই সময়গুলোতে নিজেকে শুধুই একটা মেয়ে মনে বলে হয়েছে নীলার।
এই সময়টা একান্ত নিজের মতো করে ভাবতে ভালো লাগে। দেখতে দেখতে নোমান আর নীলার সংসারজীবন বাইশ বছর হতে চলল। বড় অদ্ভুত এই সংসার জীবন। অতি আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে শুরু করা সংসার কিছুদিনের মধ্যে হয়ে পড়ে আরোপিত জীবনের রোজনামচা। একসময় ফিকে হয়ে আসে সব। কিছু দায়িত্বের সমষ্টি ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। সবচে বেশি পরিবর্তন এসেছে যৌনজীবনে। অল্পদিন পর থেকেই নোমানের সাথে কিছুতেই ব্যাপারটি উপভোগ করতে পারছে না নীলা। পুরো ব্যাপারটিতে ওর ওয়ে অব এপ্রোচ,ওয়ে অব এটাচমেন্ট– কিছুই ভালো লাগে না নীলার। খুব কষ্টে ব্যাপারটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। কী অদ্ভূত! প্রতিটি মানুষ যেমন ভিন্ন,আদর দেয়ার এবং নেয়ার ভঙ্গিও ভিন্ন। কোনো নির্দিষ্ট সূত্রে বা ছকে ফেলা যায় না। জোর করে ভালো লাগার বোধও আনা যায় না।
গাড়ি থেকে নামতেই ভীষণ বিরক্ত হল নীলা। এইসব ভিক্ষুকগুলোকে যে স্কুলের সামনে কেন এলাউ করে!গেইটেই দাঁড়িয়ে ছিল তনিমা। নীলার কাছ থেকে দশ টাকা চেয়ে নিয়ে খোড়া ফকিরটাকে দিল। মনে মনে বিরক্ত হলেও কিছু বলল না নীলা।
আট
স্কুল ছুটির সময় হয়ে আসাতে খলিলকে তাগাদা দিল জমিলা। অসাড় পা নিয়ে হাতে ঠেলে চাকাটা নিজেই চালিয়ে নিল। সবেমাত্র সিগারেটটা ধরিয়ে আয়েশ করে টান দিয়েছিল খলিল। ভাঙাগাড়ি ঠেলে জমিলাকে আসতে দেখে বিরক্ত হয়। দলা পাকিয়ে থুথু ফেলে।
ল্যাংড়া মাগি -মনে মনে গালি দেয় খলিল। এখনই কুত্তার মতো ঘেউঘেউ কইরা উঠব। ভিক্ষার ব্যাপারে মাগী আবার খুব সিরিয়াস। জমিলার টাকায় চলে বলে বেশি কিছু বলতে পারে না।
বছরের এই সময়টায় রুজি-রোজগার ভালো হয়। ফাইনাল পরীক্ষার আগে মনটা নরম থাকে সবার। হাত খুলে দান-খয়রাত করে। কেউ কেউ মানতও করে। এই সময় কী অবহেলা করে দেরি করতে আছে? প্রায় দশ বছর ধরে এখানে ভিক্ষা করে জমিলা। এর মধ্যে গাড়ি ঠেলার এসিসট্যান্ট বদলেছে তিনবার। প্রথমজন তো সব টাকাপয়সা নিয়ে পালাল। দ্বিতীয়জন আরেক মেয়ের প্রেমে পড়ে ওকে ছেড়ে চলে গেছে। খলিল আছে শেষ দুই বছর ধরে। এই ব্যাটারও হাতের দোষ আছে। চোখের পলকে পয়সা গায়েব করে। ল্যাংড়া হলেও সব বুঝে জমিলা। তৃতীয়-চোখ খুব প্রখর ওর। দাগা খেয়ে খেয়ে মানুষ চিনতে শিখেছে। খলিলের ডান হাতটা নেই,কবজি পর্যন্ত কাটা। এতে ভিক্ষা পেতে সুবিধা হয়। ল্যাংড়া মহিলা ভিক্ষুকের হাতবিহীন এসিসট্যান্ট। বাড়তি করুণা পাওয়া যায়। আধখাওয়া সিগ্রেটটা পায়ের তলায় পিষে দৌড়ে যায় খলিল।
মানুষ যতই জানুক, ভিক্ষুকেরা নেশা করে, জর্দা-বিড়ি খায় কিন্তু এটা দেখতে পছন্দ করে না। এই ব্যাপারগুলো একটু কম বোঝে খলিল। এজন্যই ওর ওপর ক্ষেপে যায় জমিলা। জমিলার মেজাজ আর টাকার গরম দুটোকেই ভয় পায় খলিল। ফুটো পয়সা নেই বলে সবসময় একধরণের অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। একা একা ভিক্ষা করার চেষ্টা করে দেখেছে। সুবিধা করতে পারে নি। দিনশেষে যা হতো নেশা করতেই ফুরিয়ে যেত। ভালো করে পেট পুরে খেতেও পারত না। ডান হাত না থাকলেও খলিলের শারীরিক গড়ন বেশ মজবুত। চেহারাটাও নায়কসুলভ। ভিক্ষা পেতে হাড় জিরজিরে শরীর আর গালভাঙা চেহারা হলে সুবিধা। করুণা পেতে স্বাস্থ্য, চেহারা বা স্বভাব কোনোটাই অনুকূলে নেই খলিলের। কিছুদিন কুলিগিরিও করেছিল। তাতেও সুবিধা করতে পারে নি। জমিলার সাথে জুটে গিয়ে অন্তত তিনবেলা পেটভরে খেতে পায়। নেশার রসদও জোটে। টাকার চিন্তা করতে হয় না। সমস্যা শুধু একটাই – গরম মেজাজ। উঠতে বসতে কুকুর বেড়ালের মতো আচরণ করে খলিলের সাথে। সেটা অবশ্য ভিক্ষার সময়টুকু। ঘরে ফেরার পর জমিলা একদম অন্য মানুষ। কম করে হলেও খলিলের চেয়ে ৫/৬ বছরের বড় হবে জমিলা। বিয়ে করে একসাথেই আছে। নইলে বস্তিতে থাকা নানা ঝামেলার। নিরাপত্তার জন্য খলিলকে বিয়ে করেছে জমিলা। খলিলও খাওয়া-পরা আর নেশার লোভে লেগে আছে জমিলার সাথে। নইলে কবেই ছেড়ে যেত।
জমিলার দূর্দান্ত অভিনয়ের কারণে সামনের থালাটা নিমেষেই ভরে উঠল অজস্র টাকায়। সত্যি! এটা জমিলার একটা গুণ বটে! খলিলকে দিয়ে যেটা কোনোদিনই হল না। ব্যাংকেও টাকার পাহাড় জমিলার।
তার টাকায় খেয়েপরেও তার প্রতি যে খলিলের মন নেই, বোঝে জমিলা। খলিলের চেহারা-সুরত ভালো। অল্পবয়সী মেয়ে দেখলেই ছোকছোক করে। তবে খুব ক্ষুধাকাতর আর ভোজনপ্রিয় খলিল। এই সুযোগটাই নিচ্ছে জমিলা। জমিলা শুধু বোঝে, যত টাকাই থাকুক, মেয়েমানুষের একটা শক্তপোক্ত পুরুষমানুষ থাকা দরকার।
ভিক্ষার থালাটা দেখে খলিলের চকচক করে ওঠা চোখ দৃষ্টি এড়ায় না জমিলার। স্কুল-গেইট বন্ধ হয়ে যাবার পর হঠাৎ সুনসান নিরব হয়ে যায় চারপাশ। ট্যাকে রাখা গাঁজার পুটলিটা বের করে হাতের তালুতে নিয়ে ডলা দেয় খলিল। খলিলের সুখটান দেয়া দেখে হাসে জমিলা। মনে মনে ভাবে, পুরুষটাকে যেমন করে হোক কব্জায় রাখতে হবে। ছুটতে দেয়া যাবে না।
নয়
সারাদিন নিশ্চুপ থাকার পর সন্ধ্যা নাগাদ সরগরম হয়ে ওঠে মাতৃছায়া। যার যার কাজ সেরে ঘরে ফেরে সবাই। এক মাস হয়ে গেল মুক্তার কোনো খবর পাচ্ছে না কেউ। ফোনটাও বন্ধ পাচ্ছে। আড্ডাটাও আজকাল তেমন জমছে না। একই পরিবারের সদস্যের মতো ছিল ওরা। মুক্তাটাই ছিল সবচেয়ে শান্ত আর নিরীহ। কী ঘটেছে বেচারীর কপালে কে জানে!
এই মাসে ডাইনিং ম্যানেজার নুসরাত। বাজারের লিস্টি নিয়ে বসেছে ও। কাল শুক্রবার বলে সবাই রিল্যাক্স মুডে। শুধু ফারিয়াটা বই নিয়ে বসেছে। ক্লান্ত হয়ে ফিরে কেউই তেমন একটা পড়তে পারে না। শুধু ফারিয়া ব্যতিক্রম। রোজই কিছুটা হলেও পড়ালেখা করে। সবাইকে জ্ঞানমূলক উপদেশ দেয়। ‘এত কষ্ট করছিস পড়াশুনাটা ঠিক রাখার জন্য, তাহলে পড়িস না কেন তোরা?’
ইয়াসমিনের টিভি দেখার নেশা। মেঘনাটার আবার একটু সাহিত্যিক সাহিত্যিক ভাব। পত্রিকায় টুকটাক লেখালেখিও করে। শিউলি আর নুসরাতের রান্নাবান্নার শখ। প্রায়ই কী সব রেসিপি বানায়, যার বেশিরভাগই খাওয়া যায় না।
ক’দিন ধরে টুম্পার শরীরটা ভালো নেই। কাজেও যাচ্ছিল না। প্রায়ই মনমরা হয়ে শুয়ে থাকে।বমিও করেছিল কয়েকবার।
অনেকক্ষণ হোল বাথরুম থেকে বের হচ্ছে না দেখে সন্দেহ হয় সবার। ধাক্কাতে ধাক্কাতে দরজার নড়বড়ে ছিটকনিটা খুলে যায়।মেঝেতে পড়ে আছে টুম্পা।ধরাধরি করে বিছানায় শোয়ালো।চোখেমুখে পানি ছিটাতেই চোখ মেলল। ক্লান্ত আর দূর্বল দেখাচ্ছিল ওকে।
‘কী হয়েছে,টুম্পা?’ মুখের উপর ঝুঁকে থাকা মেঘনাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল টুম্পা।
‘কী হয়েছে বলবি তো!’ নুসরাত এগিয়ে এল। মেঘনার মুখ দেখে মনে হল, যা বোঝার বুঝে নিয়েছে যেন!
‘যা হয়েছে, হয়েছে। এখন কী করবি তাই বল’। মেঘনার কথার ঝাঁজে বাকিরাও যেন কিছুটা আঁচ করতে পারল।
-‘মৃত্যুই আমার একমাত্র পথ’।
‘বাজে কথা একদম বলবি না। মৃত্যু কখনই কোনো সমাধান নয়’। এক্ষুনি চল, তৈরি হয়ে নে, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে’।
‘কিন্তু যে এই সর্বনাশটা করল, তার কী কোনো শাস্তি হবে না’? ফারিয়ার কথার সাথে সুর মেলাল বাকিরা।
‘শুধু অন্যের দোষ দেখলেই চলবে না। আত্মসমালোচনাও করতে হবে। অ্যাডাল্ট ছেলেমেয়ে নিজ দায়িত্বে মেলামেশা করবে। নিজের সেইফটির কথাও নিজেকেই ভাবতে হবে। তাছাড়া যার সাথে এতটা ঘনিষ্ট হবি তাকে চিনে নেবার, বুঝে নেবার দায়িত্ব তো তোর নিজের’।
‘চল, উঠ। শাস্তি দেবার চিন্তা পরে। আগে নিজেকে সেইফ কর’। দেরি করলে ডাক্তার পাব না।
হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকল শিউলি। অনেকবার চেষ্টা করে মুক্তাকে ফোনে পেয়েছে। সবার সাথে কথা বলতে চায় মুক্তা।
হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এল। মুক্তার বাবা মারা গেছেন। বড় খালার সহযোগিতায় উনার শশুরবাড়ির এক আত্মীয়ের সাথে মুক্তার বিয়ে হয়ে গেছে। সেই লোকের আগের স্ত্রী ছিল। ডিভোর্স হয়ে গেছে। ছেলেমেয়ে দুজন। যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে। দ্বিতীয় বিয়ের জন্য গরীব ঘরের মেয়ে খুঁজছিল পাত্রপক্ষ। মা আর ছোট দুই ভাইবোনের কথা ভেবে রাজি হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না মুক্তার। আনিস নামের একটি ছেলের সাথে মুক্তার মন দেয়ানেয়া ছিল, জানত সবাই। ছেলেটা বেকার, টিউশনি করে চলে। অনেক বেশি ভালোবাসত মুক্তাকে। আনিসের উৎসাহ-উদ্দীপনার জন্যই মুক্তা বেশ পরিশ্রম করতে পারত। কষ্টের মধ্যেও সবসময় হাসি থাকত মুখে। ভীষণ মন খারাপ হল সবার। পরিবারের একজন সদস্যকে যেন হারিয়ে ফেলেছে ওরা।
আগামীকাল ছুটির পর আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে সবাই। ভুলে যাবে মুক্তা নামের এক পরিশ্রমী, শান্ত, অসহায় মেয়েটির অপারগতার কাছে হেরে গিয়ে জীবনের গতিপথ পরিবর্তনের কথা! জীবন তো এমনই!এমনতরো কঠিন আর রহস্যভরা।
দশ
ফিসফিস শব্দে ঘুম ভেঙে যায় জমিলার। পাশ ফিরে দেখে খলিল নেই। বাথরুমে গেছে,এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু চাপাগলার কথাবার্তায় সন্দেহ হয় জমিলার। হাতের চেটোর ওপর ভর দিয়ে চৌকি থেকে নামে। নড়বড়ে চৌকিটা একটু ক্যাঁচ করে উঠে। চোখে অন্ধকার সয়ে এলে দুটো ছায়ামুর্তি দেখতে পায়। গভীর আবেগে জড়াজড়ি করে দাঁড়ান। মাটিতে হাত ঘষটে ঘষটে সন্তর্পণে সামনে এগোয় জমিলা। চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না জমিলার। স্বামী-পরিত্যক্তা জাহান। বস্তিতে ওদের দুই ঘর পরেই থাকে। বেশ্যা মাগী। নিজের জামাইরে তো ছাড়ছেই, আরও দুই/তিনটা সংসারে আগুন ধরাইছে। অহন আইছে জমিলার সর্বনাশ করতে। চৌকির নিচে রাখা বটিটা হাতে তুলে নিল জমিলা। হাঁটু থেকে নিচ অবধি থলথলে পঙ্গু পা নিয়েই প্রচণ্ড আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছায়ামূর্তির উপর। ‘নিমকহারাম,আইজগা তরে মাইরাই ফালামু’। এলোপাথাড়ি বটি ছুড়তে থাকে জমিলা। অতর্কিত আক্রমণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় দুজনেই। দ্রুত পালিয়ে যায় জাহান। দু’একটা কোপ পড়ল খলিলের পায়ে। মাথায় রক্ত উঠে গেল খলিলের। বটিটা কেড়ে নিয়ে জমিলাকে মারতে উদ্যত হল। সাথে সাথে খলিলের পা জড়িয়ে ধরে জমিলা। চিৎকার করে বলতে থাকে,‘আমি তোমারে অনেক ভালাবাসি,আমারে তুমি মাইরা ফালাও। আমারে ভালা না বাসলে বটকি দিয়া দুই ফাল্লা কইরা ফালাও’।
বটিটা ছুড়ে ফেলে জমিলাকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে যায় খলিল। ‘শান্ত হ’ জমিলা, তরে থুইয়া আর যামু না কুনোদিন, আল্লাহর কিরা লাগে, শান্ত হ’ তুই’। খলিলকে ধরে কাঁদতে থাকে জমিলা।
ফজরের আজানের সাথে ফর্সা হতে থাকে চারপাশ।