: আপনি ডালিমের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলেছিলেন ম্যডাম, কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা গেছে সে আত্মহত্যা করেনি।
ফোনের এপাশে মধ্যবয়সী বিধবা রোকেয়া রাহমান নিঃশব্দে ছোটো করে ঢোঁক গেলেন, নিশ্বাসটাও ছাড়েন খুব সন্তপর্ণে। কন্ঠে যথেষ্ট দৃঢ়তা নিয়েই বলেন,
: দেখুন ডালিম আত্মহত্যা করেছে বলেছি আমি নিতান্ত আন্দাজ থেকে। একজন মৃত মানুষের মুখ দেখে আমার পক্ষে কী বা বোঝা সম্ভব?
জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পার করেছেন। কিন্তু এমন করে পুলিশি জটিলতায় জড়িয়ে পড়বেন কখনও দুঃস্বপ্নেও ছিলো না তার।
: ম্যাডাম আপনি কিন্তু প্রথম দিন এই কথাও গোপন করেছেন যে ডালিম একজন ট্রান্সজেন্ডার।
: মিস্টার আদনান সেদিন আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম আপনি তো নিজেই দেখেছেন। ডালিমকে আমি প্রথম থেকে একজন ছেলে হিসেবে জেনেই ঘর ভাড়া দিয়েছিলাম। এবং সবসময় ছেলে হিসেবেই এখানে থেকেছে। এ বাড়ির অন্য ভাড়াটেরা এমনকি দারোয়ানও জানে না ওর এই ব্যাপারটা।
কথা গুলো বলতে বলতে টকটকে ফর্সা ডালিমের মৃত ফ্যাকাশে ধুসর মুখটা মনে পড়ে। পুলিশ এসে, ভেতর থেকে বন্ধ, দরজা ভেঙে যখন ঘরে ঢোকে তখন তিনি বাইরে থেকেই দেখতে পান বিছানায় বেঁকেচুড়ে পড়ে আছে। পরনে ট্রাউজার আর কুর্তি। সামান্য স্ফীত হয়েছিল কী বুক? মাথাটা খাটের বাইরের দিকে একটু ঝুলে। মুখটা হা হয়ে আছে। কালো কালো বেশ কিছু মাছি আর পিপড়ার ভীড়। সবচেয়ে অসুস্থ করল যেটা তা হলো ঘরের দরজা খোলার সাথে সাথে একটা বিকট গন্ধ। নাড়িভুঁড়ি উলটে আসছিলো তার। নাকে মুখে ওড়না চাপা দিয়েও বমি আটকাতে পারলেন না তিনি। মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন যখন নিচতলার ভাড়াটে মহিলা তাকে ধরে ফেলে। পুলিশদের মধ্যে তখন এই আদনান বা অন্য একজন বলেছিল, উনি তো বাড়িওয়ালা? ওনাকে দোতলায় নিজের ফ্লাটে নিয়ে যান। এখানে ডিউটি সেরে ওনার সাথে কথা বলতে হবে। নিয়ে যান, নিয়ে যান।’ তাড়া লাগায় সে।
নিজের ফ্লাটে থাকতেই ওরা ডালিমের লাশ নিয়ে যায়। মাত্র কয়েক মুহুর্ত তিনি দেখেছেন। ওই টুকু না দেখলেই ভালো হতো। তবুও ওইটুকু দেখে তো যা মনে হয়েছে তাতে আত্মহত্যাই মনে হয়েছে। কত যে দুঃখ ছিলো বাছার। দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখতে পারেন না রোকেয়া।
: ম্যাডাম আপনি তো জানতেন।
: জী জানতাম, ওকে আমি নিজের সন্তানের মতোই দেখেছি। সন্তানের ক্ষেত্রে ছেলে কী আর মেয়ে কী? তিন বছর ধরে ও আমার উপর তলায় থেকেছে। নিজের মা’য়ের মতোই সম্মান শ্রদ্ধা করছে।
: কিন্তু ম্যাডাম নিজের মা তো নন, তাই না?
রোকেয়া রাহমান এর কন্ঠ এবার শীতল কঠিন ও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।
: ঠিক কী বলতে চাইছেন খোলসা করে বলুন তো মিস্টার আদনান।
: না ম্যাডাম, পুলিশ অফিসার হিসেবে ঠিক কিছুই বলার কথা না আমার। সাধারণ রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ করেছি মাত্র। বাকিটা দেখবে গোয়েন্দা বিভাগ। আমি শুধু এটুকু জানানোর জন্য আপনাকে ফোন দিয়েছিলাম। আচ্ছা রাখি তাহলে এখন। আশাকরি দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাদের সাহায্য করবেন।
রোকেয়া একটুও নরম না হয়ে বরং আরো একটু কড়া করে বলে,
: আমার অসুস্থতায় এই তদন্তের কিছু সমস্যা হবে না। আমিও সঠিক তথ্য জানতে চাই।
: জী ম্যাডাম সময় মতো সব জানবেন। শীঘ্রই আবার আপনার কাছে আসতে হতে পারে, বোঝেনই তো অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু মানে অনেক দায় পুলিশের। আচ্ছা রাখি তবে, ভালো থাকবেন ম্যাডাম।
: আপনিও।
ফোনের লাইন কেটে দিয়ে খেয়াল করে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে জলি।
পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে জলি কেবল এটুকুই শুনতে পায়। আরেকটু আগে এলে প্রথম থেকে কী কী কথা হয়েছে শুনতে পেতো। তার আফসোস হয়।
জলির হাতে চায়ের কাপ। হঠাৎ রোকেয়ার তাকানোর ভঙ্গি দেখে জলি আমতা আমতা বলতে থাকে
: ফুপাম্মা আপনার জন্য চা আনছিলাম।
: তো ঘরে ঢুকিসনি কেন? বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলি কেন?
: আপনি ফোনে কথা বলতেছিলেন। কে ফোন করছিলো ফুপাম্মা?
: থানা থেকে।
রোকেয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জলির দিকে তাকিয়ে থাকেন। সেটা বুঝতে পেরে জলি অস্বস্তি নিয়ে চায়ের কাপটা রোকেয়ার হাতে দেয়।
রোকেয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অবাক হন। চা প্রায় ঠান্ডা। তার অর্থ জলি চা হাতে নিয়ে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে ছিল পর্দার আড়ালে। মুখে কিছু বলেন না তিনি। ঠান্ডা চায়েই চুমুক দেন। বেশ অন্যমনস্ক এখন তিনি।
দূরসম্পর্কের ভাইয়ের মেয়ে জলি তার কাছেই থাকে কয়েক বছর যাবৎ। স্বামী তালাক দিয়েছে। গ্রামের মানুষ নানা ভাবে জ্বালায়। স্বামী বিতাড়িত এমন জোয়ান মেয়েকে ঘরের মানুষ, বাইরের মানুষ উঠতে বসতে নানা খোঁটা দেয়।
স্বামীর মৃত্যুর পর রোকেয়া একবার ভাইবোনের সাথে গ্রামে গিয়েছিলেন। তখন চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে, জলি, এসে ‘ফুপাম্মা গো আমাকে নিয়ে যান, এখানে থাকলে আমি মরে যাব।’ বলে হাত ধরে কেঁদে ফেলে। ঢাকায় আসতে চায়। সবাই একযোগে সেই কথাতেই সায় দেয়। রোকেয়া ঢাকায় একা থাকেন। স্বামী নেই, একমাত্র ছেলেও দেশে নেই। ছয় বছর ধরে লন্ডনে আছে। বাবার মৃত্যুর সময়ও কাগজপত্রের জটিলতার কারণে দেশে আসতে পারেনি। এমন অবস্থায় একজন অসহায় আত্মীয় মেয়ে সাথে থাকলে ভালোই হবে।
জলি দেখতে ভালো। কথাবার্তা, কাজেকর্মেও ভালো। তবুও ওর ভেতর কিছু একটা আছে যা রোকেয়া রাহমানের ভালো লাগে না। তবে প্রত্যক্ষ কোনো দোষ নেই বরং গুণই বেশি তাই তিনি জলিকে রাখছেন নিজের স্বার্থেই। বয়স হচ্ছে তার। একা ঘরে ভালো লাগে না। জলির কারণে সময়টা কেটে যায়। দুজনেই দুজনের অবলম্বন হয়ে উঠেছেন এই ক’বছরে।
একটু সময় চুপ থেকে জলি নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, কী বলল পুলিশ?
রোকেয়া বললেন, আবার আসবে বললো।
জলি যে ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলো। তা ধরতে পারলেন না রোকেয়া।
ডালিম যেদিন বাসা ভাড়া নিতে আসে রোকেয়া পরিষ্কার বলে দিলেন ব্যাচেলর ভাড়া দেন না। খুব বেশি কাকতি মিনতি করেনি ডালিম। শুধু অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল, আমার নিজের মা আমাকে ভালোবাসতে পারেনি তাই অন্য কোনো মায়ের কাছে ভালোবাসা খোঁজার সাহস হয়না। কিন্তু আপনি দেখতে অনেকটা আমার মায়ের মতো।
সেই মুহূর্তে রোকেয়ার নিজের ছেলের কথা মনে পড়লো। একা একা তার ছেলে বিদেশ বাড়িতে থাকে। মায়ের আদর ভালোবাসাহীন। মায়া হলো তার ডালিমের জন্য। এতো সুন্দর একটা ছেলেকে তার মা ভালোবাসে না! এটা কেমন কথা!
ডালিম ফোনে নিজের মায়ের ছবি দেখালো। রোকেয়ার চেয়ে কম বয়সী একজন মায়ের ছবি। মিল আছে হয়তো। অথবা ছেলেটা বাসা পাবার জন্যই এমন গল্প ফেঁদেছে।
এক পর্যায়ে রোকেয়ার কাছে দুই হাত জোড় করে বললো, ‘এক বার সুযোগ দিয়ে দেখুন মা, আমার দ্বারা আপনার সম্মানের কোনো হানী বা অমর্যাদা হবে না। ‘
ছেলে রোকেয়ার নিজেরও আছে, ভাইবোনদের ছেলে আছে, পাড়াপ্রতিবেশি সবার ঘরেই ছেলে আছে কিন্তু এমন সুন্দর ছেলে, এতো অমায়িক ব্যবহারের কোনো ছেলে রোকেয়া এই অবধি দেখেননি। তবুও মা ভালোবাসে না – ব্যাপারটা জানার জন্যই হয়তো সেদিন ভাড়া দিতে রাজি হয়ে যান রোকেয়া।
একটা এনজিও তে চাকরি করে ডালিম। ভালো বেতন পায়। আগের ভাড়াটে পাঁচ মাসের ভাড়া না দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তাই রোকেয়া শিওর হয়ে নেন ডালিমের আর্থিক অবস্থার কেমন।
ডালিম ছাদের ছোটো দেড় রুমের ফ্ল্যাটে ওঠার পর পর রোকেয়া খেয়াল করেন জলির ভেতর এক অদ্ভুত পরিবর্তন। কোনো ভাবে খারাপ কিছু তিনি বের করতে পারেননি জলির আচরণে।
কিন্তু ছয় মাসের ভেতর ডালিমের গোপন ব্যাপারটা তার কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। একদিন ভাড়া দেবার সময় তিনি সরাসরি ডালিমকে প্রশ্ন করেন, ডালিম কিছুই গোপন করে না। তার জন্ম, তার বেড়ে ওঠা, তার অসামঞ্জস্যপূর্ণ দেহ ও মনের কথা। বলে আর অঝোরে কাঁদে। রোকেয়ার মায়া হয়। এতো সুন্দর একটা সন্তান জন্ম দিয়ে যে মা তাকে দূরে ঠেলে রাখে তার বুকের ব্যাথাও আচ্ছন্ন করে রোকেয়াকে। এই সব কথার সময় জলি ঘরে ছিল না। বাজারে গিয়েছিল। ফলে গত তিন বছর ধরে শুধুমাত্র রোকেয়া ছাড়া ডালিমের বিষয়টা আর সবার কাছে অজ্ঞাত ছিল।
ডালিমের মৃত্যুর সাথে সাথে তারা টের পাননি। দুইদিন পর দারোয়ান এসে জানায় ছাদের ঘরের থেকে কেমন গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আর ডালিমের ঘরের দরজায় শব্দ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। রোকেয়া জোর গলায় বলেন, আগে বলিসনি কেন? কী হয়েছে?
সে-ই দুইদিন রোকেয়াও ব্যস্ত ছিলেন। তার বড় ভাই হাসপাতালে আছেন। সেখানে যেতে আসতে হয়। নানান টেনশনে তিনিও ডালিমের কথা ভুলেছিলেন।
দারোয়ান বললো, ‘খালাম্মা দিনকাল খারাপ। পোলাডা আবার গলাত দড়িঠড়ি দেয়নাই তো?’
এই কথা শেষ হতে না হতেই রান্নাঘর থেকে জলির চিৎকার আর সব নিয়ে পড়ার হুড়মুড় শব্দে রোকেয়া অবাক হয়ে যান। কী করবেন কিছু বুঝে ওঠেন না।