রশিদ আলীকে ব্যুরোতে ডেকে আনা হলো। তার অনেক অনুরোধের তোয়াক্কা না করে ভোর পর্যন্ত তাকে আটকে রাখা হয়েছিল এবং আজ সকালে তাকে আবার ডেকে আনা হয়েছে। এতে করে রশিদ আলী প্রায় অসহায়ের মতো কাঁদতে শুরু করে। থানাপুলিশের ঝামেলায় আগে কখনো সে জড়ায়নি এবং জড়িয়ে যখন গেছেই, তাও আবার একটা হাই প্রোফাইল মার্ডার কেসের ফাস্ট আই উইটনেস তিনি, তাকে তো আর এতো সহজে ছাড়ার নয়। ব্যাপারগুলো রশিদ আলীকে বোঝাতে চেষ্টা করে মাসুদ। এটাও বোঝায় যে, তাদের কাজে সহযোগিতা করলে এবং মার্ডারারকে ধরতে পারলে রশিদ আলী কিছু অর্থ রিওয়ার্ড হিসেবেও পাবে। কিন্তু সন্তোষজনক কোনো উত্তর তার কাছে থেকে পায় না মাসুদ।
‘আপনি ঠিক রাত ১ টা ১০ এ আমাদের হেল্পলাইনে কল করেছেন। তার কতোক্ষণ আগে আপনি লাশটা দেখেছেন?’
‘হইবো স্যার দুই তিন মিনিট আগে। লাশ তো বস্তাত মোড়ানো আছিল। এক্কেবারে রাস্তার সাইডে ল্যাম্পপোস্টের নিচে। আমি দেইখা কিছু মনে করিনাই। সোজা রিক্সা চালায়া চইলা আসবার চাইছিলাম। কিন্তু তখনি চোখটা বস্তার বাঁধনির দিকে যায়। তখন ওইহানে দেহি স্যার…’
‘কী? কী দেখো?’
‘দেহি স্যার রক্ত। বুকটা ছ্যাত কইরা উঠলো। তহন যে আমার কী অইলো স্যার নিজেও কইবার পারি না। জ্বীন-ভূতে ধরছিল বোধহয় আমারে। নাইলে কি কেউ সাহস পায় ওই অবস্থায় বস্তা খুলার?’
‘বস্তা খুলে কি দেখলে?’
‘আপনারা যা দেখছেন স্যার, তাই। দেইখা তো আমার গলা একদম শুকায়া গেছে। পেটের নাড়ীভুঁড়ি একদম উগলায়া ফেলবার মন চাইতাছিল। এমন বিশ্রী গন্ধ! কোনো মানুষে পারে এমন কইরা মানুষ মারতে?’
‘তখন কি করলে?’
‘আমি তো স্যার দৌঁড়ায়া রিক্সা হাতে নিছি চইলা যাবো বইলা। কিন্তু তহনি মনটা কেমন আনচান কইরা উঠলো। এমন পিশাচের মতো যেই ব্যাডায় খুন করবার পারে, তার কঠিনতম শাস্তি হওয়া উচিত। সে বাঁইচা গেলে নিজেরেই মাফ করবার পারতাম না আমি। তহনি আপনোগে কল করছিলাম।’
ডেস্ক থেকে উঠে গিয়ে চিন্তিতভাবে পায়চারি করতে থাকে মাসুদ। রশিদ আলীর গলা আবার শুকিয়ে যায়। সে ডেস্কে রাখা একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি এক নিমিষে পান করে ফেলে। মাসুদ কিছু বলছেনা দেখে রশিদ আলী বলে,
‘আমাকে আর কতক্ষণ আটকায়া রাখবেন স্যার? ভাড়া ঠিকমতো মাইরবার না পারলে আবার ডেগচিত ভাত উঠবে না।’
‘আচ্ছা তুমি যাও এখন। প্রয়োজন হলে কল করবো, চলে এসো।’
‘আইচ্ছা স্যার।’, বলে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে রশিদ আলী।
ফরেনসিক টিম যে আলামতগুলো সংগ্রহ করেছিল তার মধ্যে একটা আধ-খাওয়া সিগারেট ছিল এবং সেটার ফিঙ্গারপ্রিন্ট চেক করে দেখা গেল যে সেটা ভিকটিমেরই। অন্য কারো ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেখানে পাওয়া যায়নি। ভিকটিমের দামী ঘড়িটা থেকে বিশেষ কিছু জানা যায়নি, সেটা এখনও চলছে। ভিকটিমের বাম হাতের অনামিকা আঙুল থেকে গোল্ডেন রিং টা বের করা হয়েছে। লাশটা যে জায়গায় পাওয়া গেছে তার আশেপাশে কোনো পোলে কিংবা ল্যাম্পপোস্টে সিসি ক্যামেরা নেই। ১০০ গজ সামনে যদিও একটা প্রিন্টিং প্রেসের দোকানে সিসি ক্যামেরা আছে, কিন্তু সেটা নষ্ট। সুতরাং আরও কিছু খোঁজ করতে হয় এবং ১৫০ গজ পেছনের একটা শপিং মলের সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায়। বরকত শেখ যদিও এসআই জাফরকে ফুটেজটি কালেক্ট করে সম্পূর্ণটা দেখার কথা বলেছিল, কিন্তু জাফর কিছু বের করতে পারেনি। কেননা ফুটেজের টার্গেট ম্যাটার কী, সে সম্পর্কেই তারা এখনো অবগত না। জাফর কেবল ভিকটিমের মতো স্যুট পরা কাউকে দেখতে পাচ্ছে কিনা এই আশায় মনিটরে চোখ বুলাচ্ছিল।
এসি ওয়াজেদ ততক্ষণে রুমে ঢুকেছেন। জাফর স্যারকে দেখেই প্রস্তুত হয়ে স্যালুট করলো।
‘আপডেট কি?’
‘সিসিটিভি ফুটেজ দেখছিলাম স্যার।’
‘কোথাকার? ‘
‘ইনসিডেন্টের প্লেস থেকে পূর্বের দিকে একটা শপিং মলের। যদিও ক্লিয়ার ভিউ পাওয়া যাচ্ছে না, তবে দেখা যাচ্ছে। আশপাশের ফুটেজ পাইনি।’
‘বরকত কোথায়?’
‘উনি আসছেন, জানালেন কিছুক্ষণ আগে।’
‘আর মাসুদ?’
‘তা বলতে পারছি না স্যার।’
‘ফুটেজে সন্দেহ করার মতো কিছু পেলে?’
‘এখনো পাইনি স্যার। আমাদের ডেফিনিট কোনো টার্গেট নেই। ভিকটিমের স্যুটটাই কেবল সহায়ক। চেহারা তো দেখার মতো কিছু অবশিষ্ট ছিল না। আর স্পটের আশেপাশে কোনো গাড়িও ছিল না। আমার মনে হয় স্যার খুনটা অন্য কোথাও করে লাশটা এখানে এনে ফেলা হয়েছে।’
‘তা হতে পারে। কোনোকিছুকেই ফেলে দেয়া যাবে না। তুমি বাকি ফুটেজটুকু দেখে শেষ করো। কিছু না পাওয়া গেলে অন্য একটা ক্লু ধরে এগোতে হবে।’
লাঞ্চ টাইমের পরে জাফর এসি ওয়াজেদের চেম্বারে গেল এবং জানালো যে ফুটেজগুলো থেকে বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি। সুতরাং তদন্ত এগোনোর মতো আলামত কী কী থাকতে পারে তা আবার দেখতে চাইলেন এ.এইচ.এম ওয়াজেদ।
‘এই কেসের যতগুলো এভিডেন্স ক্রাইম সিন থেকে কালেক্ট করা হয়েছে সবগুলো নিয়ে এসো। ঢালাওভাবে সাজাতে হবে সব।’
‘আচ্ছা স্যার।’ বলে জাফর রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
আর কোন কোন সম্ভাব্য পথ ধরে হাঁটা যায় তা ভাবতে ভাবতে ওয়াজেদ সাহেবের টেলিফোনে একটা কল এলো। কলটা করেছে এই কেসে নিয়োজিত ফরেনসিক হেড শরাফত হোসেন।
‘স্যার একটু ল্যাবে আসতে পারবেন?’
‘কেন? কী হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন ও কৌতূহল মিশ্রিত কণ্ঠে ওয়াজেদ সাহেব উত্তর করলো।
‘আগে আসুন স্যার, তারপর খোলাসা করে বলছি। আই থিংক, উই হ্যাভ গট অ্যা লিড।’
ফরেনসিক ল্যাব বিসিআই হেডকোয়ার্টাস এর সেকেন্ড ফ্লোরে। এসি ওয়াজেদ ফোর্থ ফ্লোরে বসেন। ফরেনসিক হেড শরাফত হোসেনের কণ্ঠে কাঁপা আবেগ লক্ষ্য করে দ্রুত বের হয়েছেন। এলিভেটর ধরে সোজা সেকেন্ড ফ্লোরে এসে থামলেন। একটা লিড অনেক জরুরী এই কেসটার জন্যে। ইতোমধ্যে মিডিয়াতেও খবর হয়ে গেছে এবং সাংবাদিকরা ক্রাইম স্পটের চারপাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আশেপাশে যাকেই পাচ্ছে তার দিকে ক্যামেরা ও মাইক ধরে রাখছে। বেশিরভাগ চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচারও করছে। যেন পুলিশের থেকে তাদের তাগাদা বেশি। এমনটা করলে ওরা নিজেরাই ইনভেস্টিগেশন করুক না! আমাদের কী প্রয়োজন? মনে মনে গজগজ করতে থাকেন এসি ওয়াজেদ। লাঞ্চ টাইমে মাসুদ এসব খবর তাকে দিলো। মাসুদ এখনো ক্রাইম স্পটেই আছে বলে ওয়াজেদ সাহেব যদিও তাকে ধমক দিয়েছেন, কিন্তু মাসুদ একটা কিছু বের করে আনবে, এমন আশ্বাস দিয়েছে। ওয়াজেদ সাহেবও জানেন মাসুদ কাজের ছেলে। একটা কিছু তো ডিস্কভার করবেই। সুতরাং কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেেন এসি ওয়াজেদ। এদিকে আবার ফরেনসিক হেড জরুরী তলব করেছে। সেকেন্ড ফ্লোরে নেমেই সোজা ল্যাবে ঢুকে পড়লেন এসি ওয়াজেদ।