রাত তখন আনুমানিক একটা বাজে। মাসুদ তখন রাতের খাবার খেয়ে কেবল বিছানায় গা এলিয়েছে। এলোমেলো কামরায় বিচ্ছিন্ন সব আসবাব আর কাপড়চোপড়ের মাঝেই শুয়ে পড়ে মাসুদ। আটাশ বছর বয়সী একজন ব্যাচেলরের কাছে এর চেয়ে বেশি গোছগাছের কিছু আশা করা যায় না।
গতকালের ইনভেস্টিগেশনটা শেষ করে রাত ১১ টায় বাসায় ফিরেছে। খাবার বাইরে থেকে খেয়ে আসলেও ফ্রেশ হতে হতে ১২ টা বেজে যায়। তারপর ফ্রিজ থেকে একটা বিয়ারের ক্যান খুলে নিয়ে আবার বিছানায় এসে হেলান দেয়। ল্যাপটপে জাস্টিস লিগ চালু করে দিয়ে বিয়ারে চুমুক দেয় আর সিগারেট টানে। চোখ প্রায় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল, এমন সময় ফোনের রিংটন বেজে ওঠে, ‘ও গ্লোরিয়া আই ফিল সো মাচ বেটার টুডে’। কিন্তু গ্লোরিয়ার প্রেমিক বেটার ফিল করলেও তার বেটার ফিলটা কেটে গেল।
ফোন রিসিভ করতেই বিসিআই এর ইন্সপেক্টর বরকত শেখ বলে উঠলো,
‘মাসুদ, ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটেছে।’
তন্দ্রাচ্ছন্ন মাসুদ এরকম একটা সিরিয়াস ফোন কলের জন্য প্রস্তুত ছিল না। বরকত শেখের কথা শুনেই তার তন্দ্রাভাব কেটে গেল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললো,
‘কি হয়েছে বরকত ভাই?’
‘ম্যাটারটা কোয়াইট সিরিয়াস। তুমি ওয়াজেদ স্যারকে খবর দাও। আমিই দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এতো রাতে আমি কল করলে যতোটা বিরক্ত হবেন তার চেয়ে তুমি কল করলে কম বিরক্ত হবেন। তোমার কাছের তিনি। কাইন্ডলি তাকে খবরটা দাও। বিষয়টা ফোনে বলার মতো সময় আমার হাতে নেই। আমাকে এক্ষুণি স্পটে যেতে হবে। তুমি ওয়াজেদ স্যারকে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব চলে আসো। এড্রেস আমি টেক্সট করে দিচ্ছি।’
মাসুদ বেশ বিরক্ত হলো। রাত সোয়া একটা বাজে। এমন সময় এসবের কোনো মানে হয় না। আজ সারাদিন কেটেছে একটা সিরিয়াল কিলিং এর ইনভেস্টিগেশন করতে করতে। সারাদিনের ক্লান্তি মেটাতে এখন একটা সুখের ঘুম দিতে যাবে এমন সময় আরেকটা কেস এসে মাথায় বসলো।
‘ধুর’ বলে বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মাসুদ। ওয়াজেদ স্যারকে ফোন করা ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতে ফোন করেই বসলো। কেননা বরকতের মতে বিষয়টা সিরিয়াস।
‘হ্যালো’
‘স্যার, ডিস্টার্ব করলাম নাকি?’
‘একদম না। গ্লাসে ওয়াইন ঢালছিলাম। কিছুক্ষণ রিল্যাক্সের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আরকি। তুমি এতো রাতে ফোন করলে যে! কোনো সমস্যা?’
‘কী আর বলবো স্যার! আপনাকে এতো রাতে বিরক্ত করতেও বিব্রত হচ্ছি। কিন্তু বরকত ভাই বললো বিষয়টা খুব সিরিয়াস। কথা শুনে মনে হলো হাই প্রোফাইল কেস।’
‘মাঝরাতে এসব ঝামেলা আর ভালো লাগে না। ওকে, তুমি আমার বাড়ি হয়ে এসো। আমাকে পিক করো।’
‘ওকে স্যার।’
বিসিআই এর ইন্সপেক্টর বরকত শেখ একজন ক্লিন ইমেজের মানুষ। ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি কর্মজীবনেও তিনি ক্লিয়ার-কাট এবং নির্ঝঞ্ঝাট। বাংলাদেশ পুলিশে চাকরি করার তার আট বছর হচ্ছে। এখন কর্মরত আছেন পুলিশের বিশেষায়িত শাখা ব্যুরো অব ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনে। তদন্তের হাতেখড়ি তার এসি ওয়াজেদ স্যারের কাছ থেকেই শেখা।
এমনিতে অনেক সরল মনের মানুষ হলেও প্রেশারে থাকলে মাঝেমধ্যে তার সাব-অর্ডিনেটদের হালকা ধমক দিয়ে বসেন। আর তেমনি এক বিগত ধমকের জের ধরে ওয়াজেদ সাহেবকে কিছুটা মান্য করে চলেন বরকত শেখ। তবে মান্যতার চাইতে ভয়টাই বেশি পেয়ে থাকেন।
বিসিআই এর এ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার এ.এইচ.এম ওয়াজেদ চেহারায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে গাড়ি থেকে নামেন। সাথে নামেন চৌকশ ইন্সপেক্টর মাসুদ। মাসুদকে বরকত শেখের হিংসে করার একটা কারণ হলো ওয়াজেদ সাহেবের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা এবং তার তুলনায় মাসুদ কিছু কিছু কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে। কিন্তু চাকরির বয়সের দিক থেকে বরকত শেখ মাসুদের চেয়ে বড় হওয়ায় মাসুদ তাকে বেশ সম্মান দিয়েই কথা বলে।
ওয়াজেদ সাহেব সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে একটু আরাম করবেন, এমন সময়ে তাকে বাধ্য হয়ে ক্রাইম স্পটে আসতে হলো। আর এখানে আসার পর দেখেন লাশের চারপাশ জুড়ে মাছি ভোঁ ভোঁ করছে। একটা উৎকট গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমাগত। সাথে উৎসুক লোকজনের উপচে পড়া ভীড়। বাকি অফিসাররা সেসব সামাল দিচ্ছে।
বরকত শেখ ওয়াজেদ সাহেবকে পুরো ঘটনাটা ব্রিফ করলেন। কিন্তু কোনো ক্লু ওয়াজেদ সাহেবের মাথায় খেললো না। ফরেনসিক টিম এসে বিভিন্ন ধরনের এভিডেন্স কালেক্ট করে আবার চলে গেল। লাশটা ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হলো। স্পট সিল করে ভোর হওয়া নাগাদ সবাই ফিরে গেল।
পরদিন সকালে বিসিআই এর ব্যুরোতে এসি ওয়াজেদ সাহেব তার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে এক জরুরী মিটিং কল করলেন। বরকত শেখ এবং মাসুদ ছাড়াও একজন এসআই তাদের সহযোগিতার জন্য নিয়োজিত আছেন। মিটিং এ সবাই আসার পর ওয়াজেদ সাহেব আসেন। এসে কয়েক মিনিট নিঃশব্দে মাথা নিচু করে থাকেন। তারপর এক সময় মাথা উঠিয়ে বললেন-
‘কিছু ভেবে পেলে বরকত?’
বরকত শেখ প্রস্তুত ছিল না যে ওয়াজেদ সাহেব তাকে হুট করে প্রশ্ন করে বসবেন। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বরকত না-বোধক জবাব দেয়।
‘তুমি মাসুদ?’
‘না স্যার।’
চেয়ার থেকে উঠে রুমে পায়চারি করতে থাকেন ওয়াজেদ সাহেব।
‘আমি মূলত মার্ডারের মোটিভ টা খুঁজছি। কে পারে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করতে? আর মার্ডার উইপনও তো আমরা পেলাম না।’
মাসুদ বলে, ‘স্যার, ফরেনসিক টিমের কালেক্ট করা এভিডেন্স থেকে কি কিছু পাওয়া যেতে পারে?’
‘হ্যাঁ, সেখান থেকে তো একটা কিছু বেরিয়ে আসবেই। কিন্তু প্রাইমারি এভিডেন্স হিসেবে তো কিছু পাওয়া গেল না।’
বরকত শেখ পকেট থেকে প্লাস্টিকের র্যাপিং-এ মোড়ানো একটা নিডল বের করে টেবিলে রাখে। সবার চোখ যায় সেটার দিকে।
‘এটা স্যার স্পট থেকে প্রায় বিশ ফুট দূরে পড়ে ছিল। সচরাচর রাস্তায় পড়ে থাকা সিরিঞ্জের নিডলের মতোই। কিন্তু সন্দেহ হওয়ায় এটা তুলে নিয়েছিলাম।’
‘গুড জব। কোনোকিছুই ফেলে আসা উচিত নয়। একটা মার্ডারের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল আলামত সাথে রাখা উচিত। এটা টেস্টের জন্য পাঠাও। কিছু বের হয়ে এলে সামনে এগােনো যাবে।’
পূর্বের পর্ব : নিশাচর নৈরাজ্য (১)