নিশাচর নৈরাজ্য (১)

     এখানে আসার পর থেকে এ.এইচ.এম ওয়াজেদের মনটা আগের মতো স্থির ও শান্ত নেই। কীসের এক অজ্ঞাত অবিচলতা যেন তাকে গ্রাস করে রেখেছে। আর সেই বিচলিত ভাবটা কাটাতেই তিনি বারবার সিগারেট ধরাচ্ছেন।

     সহকর্মী মাসুদ একজন কিঞ্চিৎ বোকা স্বভাবের লোক। কাকে কখন কী বলতে হবে বা কোন সময়ে কথা বলা বাঞ্ছনীয় তা তার বোধ হয় জানা নেই। ওয়াজেদ সাহেবকে দেখলেই বোঝা যায় যে তিনি কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত। তাকে এখন বিরক্ত করা মোটেই ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না। কিন্তু মাসুদ এসে বিনয়ী ভাবটা বোকার মতো ধরে রাখার চেষ্টা করে বললো,
‘স্যার, ভিকটিমের স্ত্রী একেবারে কোনো কথা বলছে না। কী করা যায়?’

     কী আর করা যাবে? স্বামীর মৃত্যুতে এমনিতেই ভদ্রমহিলা বড় একটা ট্রমার মধ্যে আছেন। এমন সময় তার নিশ্চুপ মৌনশোক পালন করাই স্বাভাবিক। মাসুদের কথায় ভালোই বিরক্ত হলেন এ.এইচ.এম ওয়াজেদ। কিন্তু সেটা মুখের কথায় কিংবা চেহারায় প্রকাশ করলেন না। কেবল তৃতীয় আরেকটা সিগারেট ধরালেন।

     মাসুদ বেকুবের মতো ভুল একটা কথা বলে ফেলেছে দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পরে দাঁড়িয়ে থাকাটাও একটা বোকামি ভেবে সেখান থেকে আস্তে কেটে পড়লো মাসুদ।

     ওয়াজেদ সাহেব একটা বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তা করতে করতে তৃতীয় সিগারেটটা শেষ করলেন। তারপর ফিল্টারটা মাটিতে ফেলে কালো পলিশ করা চকচকে বুট দিয়ে পিষে সরাসরি ক্রাইম স্পটের দিকে হাঁটা দিলেন।

     ভিকটিমের লাশ ডিস্কভার করার জায়গায় অর্থাৎ ডেড স্পটের চারপাশটা আগেই ব্রাঞ্চ অব ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন (বিসিআই) এর রেস্ট্রিকটেড ব্যারিয়ার ফিতা দ্বারা ঘেরাও করা ছিল। বিসিআই টিম লাশ প্রত্যক্ষদর্শীর কলের কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয়। প্রত্যক্ষদর্শী রশিদ আলী রাত আনুমানিক একটার সময় রিক্সা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে লাশটা প্রথম দেখতে পায়। দেখতে পেয়ে আর কয়েকটা স্বাভাবিক মানুষের মতো সেও প্রথমে ভীষণ ঘাবড়ে যায়। লাশের এমন অবস্থা ছিল যে, যে কারোই টনক নড়িয়ে দিতে পারে। এমনকি দুর্বল চিত্তের মানুষের ক্ষেত্রে সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু না।

     ‘সেই জায়গায় যে রিকশা পুলার রশিদ আলী ঘটনাটিতে ধাতস্থ হয়ে সাহস করে বিসিআই এর হটলাইনে ফোন করেছে, এটাই অনেক।’ মনে মনে সিগারেট টানতে টানতে এ কথাই ভাবছিলেন ওয়াজেদ সাহেব। আরো কিছু সন্দেহের আভাস তার মনে দেখা দিচ্ছিলো। রশিদ আলী দিন এনে দিন খাওয়া নির্ঝঞ্ঝাট একজন রিক্সা পুলার। সে প্রত্যক্ষদর্শী হলেও পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারতো। এতো রাতে পুলিশের সাথে নিজেকে জড়াতে চাইলো কেন? নিজের অপরাধটা ঢাকা দিতেই কি প্রত্যক্ষদর্শী সাজা? যাতে সে সহজেই বেঁচে যেতে পারে! অবশ্য এই পন্থা না অবলম্বন করলেও কিছু যায় আসতো না। অপরাধী হিসেবে সে সহজে এমনিতেই ধাতব্য হতো না। একজন সিম্পল রিকশা পুলার কেন একজন হাইক্লাস ব্যক্তিকে মার্ডার করতে যাবে?

     লাশটাকে দেখে হাইক্লাসের কোনো ব্যক্তিই মনে হয়। হাতে সিলভার কালারের রোলেক্স ওয়াচ, স্যুট ও টাই পরা, পায়ে বিদেশী কোনো এক ব্রান্ডের জুতো, চুলগুলো সম্ভবত ব্যাক ব্রাশই করা ছিল। একটা সৌখিন ভাব ছিল সম্ভবত চেহারায়। যদিও সেটা পুরোপুরি স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না। বাকি বডিটার অবস্থা দেখে অনুমান করতে হয়। কেননা ভিকটিমের কপাল থেকে থুঁতনি পর্যন্ত পুরোটাই ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে। গুঁড়ো বললেও ভুল হবে।

     অবয়ব বলে যে আকৃতি মানুষের থাকে, তার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বলা চলে, বোঝার কিছুই নেই। শুধু লাল রক্ত জমে জমে একটা অব্যাখ্যেয় ভৌতিক আকার ধারণ করেছে। ব্যক্তিটির পকেট সার্চ করে রুমাল, অরিজিনাল একটা জিপ্পো লাইটার ও সিগারেটের কেসে মার্লবোরো রেড সিগারেট পাওয়া গেলেও পেছন পকেটে মানিব্যাগটা পাওয়া যায় না। সেটা পাওয়া গেলে অবশ্য আইডেন্টিটি কার্ড দেখে ভিকটিমের পরিচয় শনাক্ত করা যেতো। ওয়াজেদ সাহেব ভাবলেন, খুনটা কি শুধু ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যেই?

     রশিদ আলী স্পটের পাশের একটা টি-স্টলে বসে চা খাচ্ছে আর ডার্বি সিগারেট টানছে। তার মাথায় এখন অজ্ঞাত লাশের আতঙ্ক উবে গিয়ে বাসা ফেরার তাড়না ভর করেছে। কৌটার কৃত্রিম দুধের চায়ের সাথে তার মনটাও এক কৃত্রিমতার সন্দেহে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সেটা তাকে কোনোমতেই স্বস্তি দিচ্ছে না।

     সদ্য বিয়ে করা জোয়ান রিক্সাচালক রশিদ আলীর বয়স পঁচিশ কী ছাব্বিশ হবে। বউ নিয়ে থাকে ভাঙা একটা বাসায়। বাসা নয়, সেটাকে একটা পরিত্যক্ত স্টোররুমইও বলা যায়। বাড়ির মালিক রশিদের পরিচিত আরেক রিক্সাচালক বন্ধুর সো কলড পরিচিত যাত্রীভাই বলে ভাগ্যের জোরে নামমাত্র মাসিক ভাড়ায় একটা ঘর পেয়েছে। নইলে এটাও জুটতো না। রশিদের রিক্সাচালক বন্ধু তার বড়লোক যাত্রীভাইয়ের সৌজন্যে দুই রুমের একটা বাসায় থাকে। সেও নামমাত্র ভাড়া দেয়। রশিদ একটা রুম পেয়েই খুশি। তার বন্ধুকে ও তার বন্ধুর যাত্রীভাইকে সে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়েছে। কেননা এই শহরে রিকশা চালিয়ে হাই রেটের বাসা ভাড়া দেয়া কোনো রিক্সাচালকের পক্ষেই সম্ভব নয়। বাকি রিক্সসাচালকেরা সবাই বস্তিতেই থাকে। রশিদ আলীর বাসাটা ম্যানেজ করা জরুরী হয়ে পড়েছিল কেননা তখন তার বিয়ের দুই মাস। নতুন বউ বাসা নেয়ার জন্য তাড়া দিতে শুরু করেছে। বস্তির জীবন তার ভালো লাগে না। তাই বন্ধুকে বলে এক রুমের এই বাসাটা, বাসা বললে ভুল হবে, গ্রাউন্ডফ্লোরে দারোয়ানের ওয়াচরুমের পাশে কাঠের পার্টিশন দেয়া স্টোররুমের মতো ঘরটা ম্যানেজ করে রশিদ।

     বউ রান্না করে ওখানেই ছোট একটা স্টোভ বসিয়ে। বাথরুমের ব্যবস্থা গ্রাউন্ড ফ্লোরের কোণার দিকে। যেখানে রশিদ আলী, তার সদ্য বিয়ে করা বউ ও দারোয়ান প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়।

     কয়েকদিন ধরেই রশিদ খেয়াল করে আসছে দারোয়ানের সাথে তার বউ বিনা কারণে হেসে হেসে কথা বলে। এই বিষয়টা তার মনে সন্দেহ জাগাতে শুরু করেছে। রশিদ প্রতিদিন চেষ্টা করে আগেভাগে বাড়ি ফেরার। কিন্তু টাকা আর পেটের দায়ে আগে ফেরা হয়ে ওঠে না। রাত বারোটা একটার সময় নিভৃতচারী কিছু শহরবাসীর কাছ থেকে সে বড় রকমের ভাড়া মারে। যেটা বাড়িভাড়া দেয়ার পাশাপাশি দুয়েকটা ভালোমন্দ খেতেও সাহায্য করে। রাত করে ভাড়া না মারলে বাড়তি টাকাটা পকেটে ঢুকবে না। তাতে তাদের দুজনের অসুবিধে হবে সংসার চালিয়ে নিতে। কিন্তু তার দেরীতে ফেরার সুযোগ সম্ভবত কাজে লাগায় তার স্ত্রী ও দারোয়ান জয়নব।

     কটু ও কৃত্রিম স্বাদের দুধ চা’টা অর্ধেক খেয়ে ফেলে দেয় রশিদ আলী। সিগারেটের শেষ টান দিয়ে ফেলে দেয়। এমনিতেই দেরী করতে চায় না, কিন্তু আজ অন্যদিনের চেয়ে আরো দেরী হয়ে গেল। না জানি তার বউ শারমিন আর দারোয়ান জয়নব তার অনুপস্থিতিতে হেসে হেসে কোন কথাই বা বলছে! কী দরকার ছিল লাশটা দেখে পুলিশে খবর দেয়ার! খবর অবশ্য সে পুলিশের ইমার্জেন্সি হটলাইন নাম্বারেই দিয়েছে। সেখান থেকে পুলিশের বিশেষায়িত ব্রাঞ্চ বিসিআই এর একটা টিম পাঠানো হয়েছে। তারা আসার পর রশিদ আলীকে সাধারণ কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে তাকে বসিয়ে রেখেছে। যাবার কথা বললে তারা জানায়, এখনি যাওয়া যাবে না। আরো কিছু ফর্মালিটিস-এ রশিদকে লাগতে পারে।
লাশের কথা মনে করে আবার আঁতকে ওঠে রশিদ। বউয়ের চিন্তা তখন মাথা থেকে সরে যায়।

     এ.এইচ.এম ওয়াজেদ চতুর্থ সিগারেটটা ধরালেন। তার আর ভিকটিমের ব্রান্ড একই। মার্লবোরো রেড। যদিও ভিকটিম তার চেয়ে সৌখিন ও উচ্চবিলাসী ছিলেন; যা তার ডেডবডির এক্সটার্নাল প্রোপার্টিস দেখেই বোঝা যায়। ওয়াজেদ সাহেব শখ করে মার্লবোরো স্মোক করেন। তার পছন্দের ব্রান্ড কিন্তু গোল্ডলিফ। বেশ কয়েকমাস হলো তিনি মার্লবোরো শুরু করেছেন। হাইলি পেইড একজন ডিটেকটিভকে গোল্ডলিফ স্মোক করা মানায় না। তার সাব-অর্ডিনেট মাসুদ অবশ্য কোন ব্রান্ডের সিগারেট স্মোক করে তা ওয়াজেদ সাহেব জানেন না।

পরবর্তী পর্ব : নিশাচর নৈরাজ্য (২)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত