জাল দেওয়া চায়ের লিকারের মতো ঘন আর তেতো রাত গাবতলীতে। যত আগুন তত আরো গাঢ় হতে থাকা লিকারে অনেক দুধ আর চিনি মেশালেও যেমন কষ কষ স্বাদটা যায় না, গাবতলীর রাতগুলো তেমন। আমিন বরাবরই এটা দেখেছে। আগের সেই গাবতলী জীর্ণ-শীর্ণ দুপাশের দুই সড়ক নিয়ে শুয়ে থাকে রোগাক্রান্ত বুড়োর মতো। এত রাত তবু কত যন্ত্রণা তার শরীরে যে শুধু রাত বলে শরীরটা গুটিয়ে শুয়ে থাকাই, ঘুম আর আসে না। এখন কিছু হোটেল হয়েছে, আলো, ল্যাম্পপোস্ট, আর গাড়িও তো বেড়েছে। কিন্তু এসবের ফাঁক গলে গলে সেই একই গভীর রাত।
তবু এখানে আসতে হয় তাকে, আর সেই রাতের বেলাটাতেই। লালমনিরহাট থেকে যাত্রী তুলে গাবতলী আসতে আসতে রাত হয়ে যায়। নাইট কোচে আমিনের ডিউটি পড়ে খুব কম। নাইট কোচগুলা গাবতলীতে আসতে আসতে ভোর হয়ে যায়। ভোরের ক্লান্ত, অবসন্ন গাবতলী তাও ভালো। কিন্তু রাতের এই নিকষ কালো আঁধার, চোখের ওপর তীব্র হয়ে আছড়ে পড়ে গাড়ির হেডলাইট-এসব একদমই সে মানিয়ে নিতে পারে না।
আজো তেমনি বিষণ্ন মনে যাত্রীদের নেমে যাওয়া দেখছিল। বাসের লাগেজ বক্স থেকে মানুষের মালামাল নামানো দেখছিল। মাছুম আছে তার সহযোগী। সে কুপনের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে যাত্রীদের ব্যাগগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আছে আমিন। কিছু একটা খচ খচ করছে তার চিন্তায়। বুঝে উঠতে পারছে না কী সেটা। নিশ্চয় এই গাবতলীর রাত। সব সময় আমিনের মনে হয় কিছু একটা বুঝি তুরাগ নদীর ভেতর থেকে উঠে আসবে। এখন রাত পৌনে দুইটা। ভোর হতে অনেক দেরি। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। মাঝে মাঝে উটকো গন্ধের বাতাস এসে গায়ের গরমটাকে আরো কুটকুটে করে তুলছে। তবে তারপরও মনে হচ্ছে, অন্য কিছু একটা আছে।
আজ বাসে যাত্রী পাঁচ আসন খালি ছিল। এর মধ্যে টিকিট কাটলেও দুজন ওঠে নাই আর বাসে। একজনের কথা ছিল বড়খেদা থেকে উঠবে। আরেকজন রংপুর। কিছু সময় অপেক্ষা করে এ দুই স্টেশন থেকে তাদের না নিয়েই বাস ছেড়ে দিতে হয়েছে। একজনের টিকিট লালমনিরহাট থেকেই আমিনের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর রংপুরের কাউন্টার থেকে একজনের ওঠার কথা থাকলেও সে আর ওঠে নাই। বাকি তিনটা সিটের টিকিট বিক্রি হয় নাই।
লালমনিরহাট মেইন স্ট্যান্ড থেকে যিনি টিকিটটা আমিনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেছেন, তাকে আগে কখনো দেখে নাই সে। পরিচিত কেউ না। বাসে পরিচিত যাত্রী থাকে। এ রুটে বাসের সংখ্যাও কম। মাত্র দুইটা কোম্পানির বাস চলে দিন-রাত মিলায়ে। যাত্রীদের চেহারা, পরিবার অনেক কিছু আমিন বলে দিতে পারে চাইলে। যে কারণে তার মনে হয়েছে পরিচিত কেউ উঠবে। কিন্তু বড়খেদা থেকে যখন কেউ উঠল না তখন থেকে তার মনে খচ খচ শুরু হলো। এমন যে হয় নাই তা না। টিকিট কেটে যাত্রী ওঠে নাই, এমন ঘটনা আরো আছে। তবে প্রত্যেক ক্ষেত্রে আগে-পরে যাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। এবার যে লোকটা টিকিট ধরিয়ে দিয়ে গেল সে লালমনিরহাটের লোক না, অন্য এলাকার। কথা শুনে মনে হয়েছে। লোকটার আচরণে কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না। সোজা এসে বলল, ‘আমার যাত্রী উঠবে বড়খেদা থেকে, তুলে নিয়েন। বয়স্ক যাত্রী। তারে গাবতলী থেকে অন্যজনে আবার রিসিভ করবে নে…।’
তখন আমিনও ছিল ব্যস্ত। রাতের বেলা গাবতলীতে নামতে হবে, তারপর কোথায় রাতটা কাটাবে সে টেনশন তো ছিলই। জার্নিরও তো ধকল থাকে একটা। টিকিট, আসন, যাত্রী, তাদের মাল-সামালা–সব মিলায়ে তখন অত খেয়াল করে নাই। যত সে ঢাকার দিকে আসতে থাকল তত চিন্তাটা বাড়ল কেন যেন। একবার মাছুমকে জিজ্ঞেসও করেছে যে ওই লোক কোনো ব্যাগ দিয়েছে কি না বাকসে। মাছুম বলল একটা ট্রাঙ্ক দিয়েছে। ট্রাঙ্কটা মনে হলো বেশ ভারী। তা এখন লোকটা যদি বাসেই না উঠল, তাহলে এ ট্রাঙ্ক নিয়ে কী করবে তারা! ব্যাগ ফেলে যদি যায় কেউ তবে কাউন্টারে রেখে যাওয়া নিয়ম। যাত্রী কাউন্টার থেকে তার ব্যাগ কালেক্ট করে নেবে। এ ট্রাঙ্কটাকেও তাহলে সেভাবে রেখে যাবে–ভাবল আমিন।
ভাবতে ভাবতে মাছুমের দিকেই আগাল আমিন। ওস্তাদ এখনো ড্রাইভিং সিটেই বসে আছে। মোটাসোটা দেহ নিয়ে খুব বেশি নড়াচড়া তার ধাতে নাই। তার সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। মাছুমকে দেখল লাগেজ বক্সের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে কিছু একটা টেনে বের করার চেষ্টায় আছে। এরপর বক্স থেকে মাথাটা বের করে আমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই অনেক ওজন।
মাছুমকে বক্সের ভেতর উঠিয়ে নিজেসহ কোনোরকমে ট্রাঙ্কটা নামাল। এত বড় ট্রাঙ্ক আগে কখনো দেখেছে কি না মনে করতে পারল না আমিন। আর ওজনও এত বেশি যে বলার মতো না। মনে হয় লোহা ঢুকিয়ে নিয়েছে। এই ট্রাঙ্কের সঙ্গে যে রিসিট দেওয়া ছিল তা মাছুমের পকেটেই পাওয়া গেল। টিকিট ছিল আমিনের পকেটে। টিকিটে নাম লেখা মি. নাসির আর দাম এবং তারিখ লেখা। এ থেকে কী উদ্ধার করবে আমিন ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারল না। পরে ওস্তাদকে ডাকল। ওস্তাদের নাম শামছু। সুযোগ পেলে ঘুমায়ে পড়েন। কিন্তু ড্রাইভিং সিটে বসলে তার চোখ-কান সব খাড়া। কড়া মসলার পান মুখে পুরে গাড়িতে যে টান সে তোলে তা খুব মসৃণ। রাস্তা খারাপ না থাকলে তার গাড়ি ঝাঁকি খায় না, কখনো কড়া ব্রেক করেন না আর অযথা হর্ন দেন না। কিন্তু গাড়ি থেকে নামলে তার চোখ ঘুমে বুজে আসতে চায়। কথাও বলেন কম। পান খাওয়ার কারণে জিভ কিছুটা ভারী হয়ে থাকে। কী বলেন যারা সারাক্ষণ তার সঙ্গে থাকেন তাই সহজে বুঝতে পারেন। নতুনরা কনফিউজড হয়ে যান। তবে লোকটা ভালো, অমায়িক। পান খাওয়া লোকরা ভালো হয়েছে আমিন দেখেছে।
আমিনের ডাক শুনে সহসা সাড়া দিলেন না ওস্তাদ শামছু। তিনি বাসের স্টিয়ারিং হুইলে দুই হাত দিয়ে সামনে ঝুঁকে আছেন। বয়স হয়েছে, দেখলে বুঝা যায়। মানুষের বয়স হুট করে শরীরে ধরা দেয়। শীত আসলে যেমন জলা শুকায়ে যায় কখন যে, বুঝা যায় না তেমন। মানুষের শরীরেও হঠাৎ টান পড়ে। শামছু ওস্তাদকেও তেমন দেখছে আমিন। বয়স ষাট হবে হয়তো। কিন্তু প্রথম যখন তাকে দেখেছিল তখন একটা তাগড়া ভাব ছিল। যদিও মোটাই ছিল শরীর, কিন্তু এভাবে এলায়ে থাকতেন না তিনি। ডাকলেও সাড়া দিতে এখন তার দেরি হয়। বারবার ডাকে তিনি ঘাড় ঘুরায়ে আমিনকে দেখেন। আমিনের চোখেমুখে উদ্বেগ টের করলেন। বুঝতে পারলেন কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। ড্রাইভিং সিট থেকে ভারী শরীরটা টেনে নামাতে তার কিছু কসরত করতে হলো। গামছা দিয়ে ঘাড়, মুখ মুছতে মুছতে, ‘কী অইছে, অ্যা, কী অইছে’ বলতে বলতে নামলেন।
নেমে মাছুমকে দেখলেন এক হাত কোমরে, আরেক হাত দিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে। তার সামনে আতিকায় এক ট্রাঙ্ক। আমি বুঝাতে থাকল শামছুকে, ‘এই ট্রাঙ্কডা যে ব্যাডায় টিকিট দিয়া গেছিল না কাউন্টারে, মাছুমে কইল হের। হেভি ভারী। হে লোক তো ওডে নাই আর বাসে। এহন কী করুম কন’।
‘পুলিশে খবর দে’।
‘পুলিশ’!
বলেই অবাক হয়ে শামছু ওস্তাদের দিকে তাকাল আমিন। তার প্রথমেই মনে হলো লোকটা দিল থেকেই ভালো। ভালো লোক ছাড়া কেউ সহজে পুলিশ ডাকতে চায় না। কারণ এ ট্রাঙ্কে তো টাকাপয়সা, মালসামালা, কত কিছু থাকতে পারত। ওরা তো এমন কিছুও পাইতে পারত যে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাইত। কারণ এ রুটে ফেনসিডিলের চালান আসে। কিন্তু সেগুলা শামছুর ট্রিপে চলে না। লোকটা বাস চালানি পছন্দ করে। নিজের বাসে কোনো অনিয়ম সে করতে চায় না। অথবা বড় ঝামেলায় পড়তে চায় না। মাঝ রাস্তায় লোক নেয় যদি সঙ্গে বড় ব্যাগ-ট্যাগ না থাকে। ছোট ব্যাগও চেক করতে হয় মাছুমকে দিয়ে। সব ঠিক থাকলে মাঝ রাস্তায় লোক তোলে। তাতে আর কয় টাকা। সেগুলাও ঠিকঠাক ভাগ করে নেয় তিনজনে। অবশ্য মাছুমের ট্রিপ চেঞ্জ হয়। আমিনও অন্য ট্রিপে যায় মাঝে মাঝে। আরো দু-চারজন ড্রাইভারকে সে চেনে। তাদের মধ্যে যে গাঁজা-ফেনসিডিল পাচার করে কিছু টাকা কামাইয়ের স্বভাব আছে। সেটা এই শামছুর নাই।
এখন যদি এ ট্রাঙ্কে এসব থাকে বা সোনাদানাও থাকতে পারে। লালমনিরহাট খুব বদখত জায়গা। ওখানে সন্ধ্যা নামলে ফেনসিডিলের গন্ধে ম ম করে পুরা শহর। সুনসান রাতের বুক চিরে সীমান্ত এলাকায় ছুরির মতো মোটরসাইকেলের হেডলাইটের আলো জ্বলে। বর্ডার এলাকায় রিকশা-সাইকেলের টুং টাং, দূরে কোন জমির খেতের আলে হঠাৎ লাইটার জ্বলে উঠবে। কেউ ভাববে জোনাকি, আসলে তো সব মালখোর। ইন্ডিয়া থেকে মাল আসবে সেগুলা পাচার হবে এ রকম ট্রাঙ্কে করে। তবে একটা জিনিস বাংলাদেশ হয়ে ইন্ডিয়া যায়, সেটা হল সোনা। এয়ারপোর্ট থকে বাংলাদেশের সোনা দেশের বিভিন্ন এলাকার সীমানায় যায়। তার একটা লালমনিরহাট। এ এলাকার সব দিকে ইন্ডিয়া, খালি একদিকে বাংলাদেশ। এখন যদি এমন হয় যে কেউ কোনো সোনা চোরাচালান করতে পারল না, তাইলে হয়তো ফিরায়া নিয়া আসল ঢাকায়। আর ফিরায়া যদি আনলই, তাহলে এখন লোক কই সে মালের?
তার মানে কি এ না যে এ মাল তামাদি হয়ে গেছে। এসব সোনার আর কোনো মালিক নাই। এগুলা এখন যে পাবে, সে-ই মালিক। হতেই তো পারে, পারে না? এমন দেখছে না আমিন তার এলাকায়? এখানে-সেখানে হঠাৎ দু-চারটা বস্তা পড়ে আছে যার ভেতর পুরাটা ফেনসিডিল। হয়তো বিডিআর দাবড়ানি দিছে বা বিএসএফ–তখন সব ফেলে দৌড় দিতে গিয়ে কি তারা ফেনসিডিলের বস্তা রেখে গেছে না? আবার এমনও আছে যে পরে নিয়ে যাবে ভেবে লুকায়ে রেখে গেল, কিন্তু সেই বস্তা নিয়ে গেল আরেকজনে।
এ কারবারে এসব ঘটনা স্বাভাবিক। এখন যদি ট্রাঙ্কটা খুলে দেখা যায় যে আসলেই সোনাদানা আছে, তাহলে কাউকে কিছু না জানায়ে তারা ভাগাভাগি করে ফেললেই তো আর এই লোহালক্কড়, ভাঙাচোরা রাস্তার ওপর, ধুলার ভেতর জীবনটাকে পার করে দিতে হবে না। তখন কোথায় এসব সোনাদানা, কিছু কিছু করে লুকায়ে, ভাঙায়ে, বিক্রি করে জীবনটা আরামেই পার করে দেওয়া একটা তুড়ি মারার মতোই ব্যাপার।
শামছু ওস্তাদ জীবনেও এসবের ধার ধারবে না। তার কোনো লোভ নাই। খাবে, ঘুমাবে বাস চালাবে আর বউকে লাগাবে। জীবনের সাধ-আহ্লাদ তার এটুকুই। মেনি মাছের মতো মুখটা করে রাখবে সারা দিন। লাল লাল চোখ। মাঝে মাঝে মদ খায় মনে হয়। যখন গাড়ি নিয়ে গিয়ে লালমনিরহাট থাকা লাগে। তখন মদও খায় নিশ্চয়। আমিন এও শুনছে যে সেখানে তার আরেকটা বউ আছে। যা ঢাকার বউয়ে জানে না। শামছুর বাড়ি আসলে রংপুর। তা ওই রুটেই গাড়ি চালাত সে। পরে কোন এমপি ঢাকা-লালমনিরহাট রুটে গাড়ি তুলল, তার ম্যানেজার শামছুর পুরানা লোক। তারে নিয়ে গেল। সেই থেকে একই চাকায় আমিন আর শামছুর কপাল বাঁধা পড়ল।
কিন্তু লোকটার সঙ্গে কাজ করে কোনো চার্ম নাই। কাজটাই কেবল। কথাও বলে কম, রসকষ নাই। তার কাজ জগতে ওই গাড়ি চালানো আর ঘুমানো। তার পক্ষেই সম্ভব শুরুতেই পুলিশ ডাকা। যার জীবনে কোনো রোমাঞ্চ নাই, সে পুলিশকেই স্মরণ করবে এ রকম একটা মালিকানাহীন বেঢপ ট্রাঙ্ক চোখের সামনে দেখার পর।
কী আর করা। আমিন পুলিশকেই ফোন করতে চলল কাউন্টারে। সেখানে একটা লাইনের ফোন আছে। থানার নাম্বারও আছে নিশ্চয় কাউন্টারে। আর বসে আছে কনক। কনক কান্তি দাস। ছোটখাটো একটা মানুষ। ঘুরে ঘুরে এই বাস কাউন্টারে এসে কাজ নিয়েছে। নিরীহ, গোবেচারা, দাস পরিবারের মানুষ। ঢাকায় আসতেই অনেক হিম্মত করতে হয়েছে। সবার সঙ্গে তার সদ্ভাব। খারাপের মধ্যে শুধু গাঁজা খায়। গাঁজা খেয়ে এসে চোখ লাল করে একটানা কাজ করে যায় কোনো ভুল ছাড়াই। আর পুলিশকে খুব ভয় পায়।
তার কাছে গিয়ে পুলিশকে ফোন করার কথা বলতেই কেঁপে উঠল। খুব সন্দেহ আর করুণার মিশেলে একটা চোখ করে তাকাল। আমিনের ফাজলামির মুড ছিল না। বলল, একটা ট্রাঙ্ক, মালিক নাই বহুত ভারী ওস্তাদে বলল পুলিশ ডাকতে।
ফোন করল আমিন দারুস সালাম থানায়। পুলিশ জানাল বৃত্তান্ত। তারপর আবার ফিরে এল ট্রাঙ্কের কাছে। কালো ট্রাঙ্ক। নিয়ন আলোয় আবছা বুঝা যায় ফুল-পাখি আঁকা। নিশ্চয় লাল, সাদা বা গোলাপি রং দিয়ে। নীলও থাকতে পারে সঙ্গে। এমন এক ট্রাঙ্ক সবার কাছেই থাকে। প্রচুর মশা গাবতলীতে। দাঁড়ায়ে থাকা যায় না। একটু পর পর ঠাস ঠাস করে মারতে হয়, গা হাত-পা নাড়াতে হয়। মাছুম আর আমিন এসবই করছিল। শরীরের ভেতরেও যেন মশা ঢুকে গেছে। মনে হচ্ছে এখান থেকে দৌড় দেয়। এর মধ্যে শামছু ওস্তাদ ফোনে কথা বলল কার সঙ্গে। কাছে এসে বলল, ম্যানেজাররে জানাইলাম। কোত্থেকে কী কেস হয়ে যায়, বলা যায় না।
বাংলাদেশের পুলিশ, তাও আসে না। খালি লেট করে। এদের শরীর নাড়াতে খুব অনীহা। তারওপর রাত হয়েছে। হয়তো ফোর্স জোগাড় করতে করতেই ওসি সময় লেগে যাচ্ছে। বা চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, এখন শরীর তুলতে ইচ্ছা করছে না আর। অথবা কে জানে, লুঙ্গি পরে শুয়েই ছিলেন তিনি থানায়। পুলিশকে খুব কম চেনে আমিন। মাঝে মাঝে বাস থামায়, তখন তাদের চাঁদা দিতে হয়। তাদের চাঁদা না দিলে ডাকাতে ধরে। ডাকাত খুব ভয়ংকর, তারা যাত্রীদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ সে তুলনায় ভালো, তাদের হাতে কিছু ধরিয়ে দিলে আর ঝামেলা নাই। এর বাইরে পুলিশ কেস আমিনের কখনো হয় নাই।
পেটে ক্ষুধা আর বাইরে মশার কামড়ের যন্ত্রণা নিয়ে তাদের সময় যেন কাটতেই চায় না। হাতের ঘড়িতে রাত দুইটা সায়ত্রিশ। পুলিশকে ফোন করেছিল প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা আগে। এখনো আসছে না তারা। ইচ্ছা করছে ট্রাঙ্কটার গায়ে দুম দুম লাথি মারে। শামছু ওস্তাদ এর মধ্যেই বাসে উঠে ঘুম দিচ্ছে মনে হয়। জগৎ নিয়ে তার কোনো ভাবনা নাই। চোখের সামনে মানুষ খুন হয়ে যেতে দেখলেও যেন সে নির্বিকার থাকবে। কোনো হেলদোল ঘটে না। টেনশন কখনো তার ভেতর কাজ করে না। কাজ করলেও আমিনের চোখে পড়ে নাই। লোকটা রহস্যজনক–এটা ঠিক।
আরো প্রায় পঁচিশ মিনিট পর একটা টেম্পো আসলো। গাবতলী-ফার্মগেট রুটের টেম্পো। তাতে পুলিশ বসা। গোলগাল পেটমোটা, মুখে গোঁফ একটা লোক সবার সামনের সিট থেকে নামল। মনে হয় সে-ই ওসি। আমিন ওসি-এসআই চেনে না। তার কাছে সবাই সমান। পেটমোটা, গোঁফওয়ালা পুলিশর সঙ্গে আরো দুই পুলিশ। তাদের হাতে গদা বন্দুক। নেতা পুলিশটার হাতে লাঠি। সেটা ঘুরাতে ঘুরাতে সে এসে দাঁড়াল আমিন আর মাছুমের সামনে। তাদের দিকে তাকাল ভালো করে। কুঁত কুঁতে চোখ, চোখের নিচে মেদ, মুখে চুইঙ্গাম চাবাচ্ছে হয়তো, বা কোনো মসলা। এরপর মোটা লাঠি দিয়ে ট্রাঙ্কের ওপর বাড়ি দিল। বাড়ির শব্দে শামছু ওস্তাদের ঘুম ভাঙল। তার নেমে থাকার দিকেও তাকায়ে থাকল নেতা পুলিশ। তিনি যা করেন তার দুই সঙ্গীও তা করেন। তবে একটু পর পর নেতা পুলিশের মতো তারা পিচিক পিচিক করে থু থু ফেলে না।
ওস্তাদকে নেমে আসতে দেখে ইশারায় জানতে চাইলেন নেতা পুলিশ কী ব্যাপার। ওস্তাদও ইশারায় ট্রাঙ্ক দেখালেন। নেতা পুলিশ মাথা দিয়ে ইশারা করে তার শাগরেদদের টেম্পোর কাছে যেতে বললেন। কেউ কোনো কথা বলছে না। মাঝে মাঝে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে শুধু। পুলিশ আসার পর মশাও কমে গেছে। কিছুটা স্বস্তি লাগছে। তবে ট্রাঙ্কের টেনশনে কাছে সেসব কিছু না। পুলিশের ছুঁলে নাকি অজস্র ঘা, আকাশে যত তারা পুলিশের তত ধারা। এ অবস্থায় নিজেকে অসহায় মনে হলো আমিনের।
শাগরেদ দুই পুলিশ হাতুড়ি আর ছেনি নিয়ে এল। তা দিয়ে তালা ভাঙা হলো ট্রাঙ্কের। কী আছে ভেতরে দেখার জন্য সবাই ঝুঁকে এল সামনে। আশপাশ থেকে আরো কিছু লোক জুটেছে পুলিশ দেখে। পুলিশ মানেই তামাশা, কোনো না কোনো ঘটনা, কিছু একটা সাসপিশাস ব্যাপার। ফলে লোক জুটবেই।
দুই শাগরেদ পুলিশ এক বাড়িতেই তালা ভেঙে ফেলল। তবে ডালা খুলতে পারল না সহজে। ভালোভাবেই এঁটে আছে। তাদের হাতে গ্লাভস। একজন ধরে, আরেকজন টেনে নানা কায়দায় ট্রাঙ্কের ডালা খুলল তারা। কেমন একটা বোটকা গন্ধ পেল যেন আমিন। ডালা খুলতেই হা হয়ে গেল তার মুখ।
ট্রাঙ্কের ভেতর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে একটা মেয়ে–যেন ঘুমাচ্ছে।