বনবিবির খোঁজে

মোটরবাইকের শব্দ মিলিয়ে যেতেই চারদিকে নেমে এলো ভয়াল নিরবতা। সূর্য ডুবে গেছে, কিন্তু আঁধার নামেনি। রক্তিম আকাশ এখনো ছড়িয়ে যাচ্ছে কনে দেখা আলোর আভা। পাখিরা ফিরে গেছে নীড়ে। সমৃদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার ছয়শত ফুট উচ্চতার পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে আমাদের মুখেও কোনো কথা নেই। প্রকৃতির অপূর্ব রূপ দেখে সবাই হতবিহ্বল, ভাষাহীন। এমন রূপ কি জীবনে কখনো দেখেছি? কিংবা এমন নীরবতা? বাতাস বইছে। প্রেয়সীর চুল উড়িয়ে নেওয়া প্রবল বাতাস। প্রাণভরে শ্বাস নিচ্ছি, ফুসফুস পাচ্ছে তাজা অক্সিজেন। এর মাঝেই খবর এলো, তাবু খাটানো হয়ে গেছে। পাহাড়ের দক্ষিণে ঝোপ জঙ্গলে ঘেরা আরেকটি চূড়ায় পাশাপাশি তিনটি তাবু। সাময়িকভাবে পাহাড়ে তাবু খাটানো নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন। তাই আমাদের লুকিয়ে রাখা হচ্ছে্। বিষয়টা আমরা জানতাম না। যখন জানলাম, তখন বুঝতে পারলাম এই অভূতপূর্ব নির্জনতার রহস্য। ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেওয়ার লোভে আমরা হাঁটতে লাগলাম সেদিকে। ততক্ষণে অন্ধকার নেমে গেছে। টর্চের আলোয় ঝোঁপঝাড় ডিঙিয়ে আমরা এগুচ্ছি। চারদিক থেকে ঝিঝি পোকার দল তীব্র চিৎকারে আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। একপাশে গভীর খাদ। পা একটু বেকায়দায় পড়লেই সোজা নিচে। সাঈদের ভাষায় ‘সোজা ওপরে’। পাহাড় থেকে নিচে পড়ে গেলে তো ‘ওপরে’ যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। সেই ভয়কে জয় করে আমরা পৌঁছে গেলাম তাবুর কাছে। হঠাৎ রনি ভাই প্রবল উত্তেজনা নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভাই ওপরে তাকান’!

আকাশের দিকে তাকাতেই সবার মুখ থেকে একইসঙ্গে বেরিয়ে এলো বিস্ময় আর আনন্দ মিশ্রিত চিৎকার! আমাদের জন্য কোটি তারার পসরা সাজিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। ধুলোহীন, ধোঁয়াহীন আকাশে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তারাদের মিটিমিটি হাসি। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে উড়ন্ত ঘোড়ার মতো নক্ষত্রপুঞ্জ, যাকে বলে ‘পেগাসাস’। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মিল্কিওয়ে। মহাকাশে ৮৮টি নক্ষত্রপুঞ্জ আলাদা করেছেন বিজ্ঞানীরা। এদের মধ্যে ৪২টির আকার বিভিন্ন প্রাণীর মতো, ২৯টির আকার বিভিন্ন জড় বস্তুর মতো এবং ১৭টির আকার পৌরাণিক প্রাণীর মতো। আমরা তার কয়টাই বা জানি? সেই সূর্য ডোবা সন্ধ্যা থেকে বেশ কয়েকবার বলে ফেলেছি, ‘ইটস মাই ড্রিম নাইট’। নিম্ম মধ্যবিত্তের জীবনে এমন স্বপ্নের রাত বারেবারে আসে না। দিনের পর দিন মনে মনে শুধু স্বপ্নের জাল বোনা হয়, একদিন পাহাড়ে যাব। তাবু খাটিয়ে থাকব। উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সূর্যোদয় দেখব। পূর্ণচন্দ্রের রাতে নির্জন পাহাড়ে জোছনায় গা ভেজাব। দূর থেকে ভেসে আসবে পাহাড়ী গানের সুর। পাহাড়ী ঝিরিপথ ধরে হাঁটব, ঝর্ণার জলে জুড়োবে শরীর। কিন্তু দিনশেষে আর হয়ে ওঠে না।

জীবন একটাই, কিন্তু সংকট অসংখ্য। ভ্রমণের জন্য টাকার জোগার হয় না, টাকা জোগার হলে সংসারে তৈরি হয় সংকট। মায়ের চিকিৎসা, সংসারের খরচ, সন্তানের পড়াশোনা, আত্মীয়স্বজনের বিপদ…. আরও কতকিছু। তবু মধ্যবিত্তের জীবনে কখনো সখনো স্বপ্ন পূরণের সুযোগ আসে। অফিসের বসও এক কথায় ছুটি দিয়ে দেন, সঙ্গে টাকাভর্তি খাম। রাতের অন্ধকার ভেদ করে দ্রুতগামী তূর্ণা নিশিথা আমাদের নিয়ে ছুটে চলে লাল পাহাড়ের দেশে। চকরিয়া বাসস্ট্যান্ডে ফোন আসে, ওমুক আত্মীয় হাসপাতালে ভর্তি। তাকে বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতেও বাধে না। জীবন থেকে প্রকৃতির কাছে শুধু তিনটি দিন চেয়েছি। যাই ঘটুক না কেন, আমরা যাবই লাল পাহাড়ের দেশে। আজ আর কেউ আটকে রাখতে পারবে না। মারায়ং তন পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে দেখি, প্রকৃতিও আমাদের জন্য সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে প্রস্তুত। নেই কোনো পর্যটক, নেই কোনো কোলাহল। প্রকৃতির আনন্দযজ্ঞে অতিথি শুধু আমরাই।

তাবু থেকে মাদুর বের করা হচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে বিছানো হলো। কিন্তু পাহাড় চূড়ার প্রবল বাতাসে সেই মাদুর জায়গামতো রাখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। এক ঢিলে দুই পাখি মারার লক্ষ্যে আমরা আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লাম। একটু পর পর উল্কাপাত হচ্ছে। আমরা পাহাড় চূড়ায় শুয়ে উপভোগ করছি সেই মহাজাগতিক দৃশ্য। রানা বেশ করিৎকর্মা ছেলে। এই প্রবল বাতাসের মাঝেই সে আগুন জ্বালাতে সক্ষম হয়েছে, যার পোশাকী নাম ‘ক্যাম্পফায়ার’। পাহাড় থেকে শুকনো ডালপালা এনে সেই আগুনে ফেলা হচ্ছে। আগুনে কাঠ পোড়ার আওয়াজ হচ্ছে, আর আমরা আকাশপানে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছি পেছনে ফেলে আসা বিষাক্ত নগরজীবন।

রনি ভাই গান গাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। তাবু থেকে গিটারটা নিয়ে বাইরে এলাম। কিন্তু গান-বাজনার চেষ্টা করতেই রানা এবং আরেকজন ট্যুর গাইডের পাগলামিতে দ্রুতই ভণ্ডুল হয়ে গেল! গাঁজা সেবন করে ওরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। রনি ভাই আমাকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বলল, কাল নাফাখুম ঝর্ণার ওপর বসে গান হবে। সেই গান ভিডিও করা হবে। আমি রনি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম। আমাদের হাসি-ঠাট্টা ছাপিয়ে শোনা গেল বাইকের শব্দ। নির্জন পাহাড়ে বাইকের বিকট আওয়াজ ভয় উদ্রেক করতে যথেষ্ট। নিজের মাতৃভূমিতে সবার আগে চিন্তা আসে নিরাপত্তার। তাছাড়া এখানে তাবু খাটানো নিষেধ, তাই প্রশাসনের লোকজন এলো কিনা তা ভেবে আমরা শংকিত হয়ে উঠলাম।

বাইকের ঘটঘট শব্দ এগিয়ে আসছে, আমরা উঠে বসে তাকিয়ে আছি সেদিকে। এতক্ষণ যেভাবে পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে প্রকৃতি উপভোগ করছিলাম, সেটা ভণ্ডুল হয়ে গেছে। বাইকের শব্দ আর তীব্র আলো জন্ম দিয়েছে একরাশ বিরক্তির। রানা আমাদের আশ্বস্ত করছে, পুলিশ এলে নাকি সেই সব ব্যবস্থা করে ফেলবে! চিন্তার কোনো কারণ নেই। যাই হোক, পুলিশ এলো না। এলো আমাদের যারা বাইকযোগে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন, তাদেরই একজন। অন্য কোনো উদ্দেশ্য নয়, আমাদের খোঁজ নিতে এসেছেন। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে তিনি চলে গেলেন। আড্ডা যেহেতু ভেঙে গেছে, তাই সাঈদ প্রস্তাব করল অন্ধকার পাহাড়ের চূড়ায় হেঁটে বেড়ানোর। বেশ লোভনীয় প্রস্তাব হওয়ায় আপত্তির প্রশ্নই আসে না। উঠে পড়লাম তিনজন।

পাহাড়ের মূল চূড়ায় যেতে আবারও পেরোতে হবে সেই জঙ্গলে ঘেরা সরু পথ। টর্চের আলোয় অতি সন্তর্পণে আমরা হাঁটছি। সাঈদ হাঁটছে সবার আগে। লিকলিকে চেহারার ছেলেটির প্রাণশক্তি আর সাহস দুর্দান্ত। গভীর খাদ বামে রেখে আমরা এগুচ্ছি। আমার আবার সাপের ভয়। খুব দেখে দেখে পা ফেলছি বিধায় পড়ে গেছি সবার শেষে। হঠাৎ নিচ থেকে ডেকে উঠল কোনো রাতের পাখি, যা ওই পরিবেশে যে কাউকে চমকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমরা চমকে গেলাম; সামলেও নিলাম। কয়েক মিনিটের মাঝেই আমাদের রুদ্ধশ্বাস যাত্রার সমাপ্তি হলো। সামনেই পাহাড় চূড়া। জঙ্গল কেটে পরিস্কার করে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও আজ আমরা ছাড়া আর কেউ নেই এই পাহাড়ে। সত্যিই কি তাই? পাহাড়ের কোনো একপাশ থেকে আসছে ঘুঙ্গুরের শব্দ! এই অন্ধকার রাতে ঘুঙ্গুর পায়ে কে আসছে পাহাড়ে?

‘যে আসছে আসুক না, আমাদের কী? আমরা উপভোগ করি।’-  রনি ভাইয়ের বক্তব্যে যথেষ্ট যুক্তি ছিল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পর সেই যুক্তি টিকল না। মনে হলো, ঘুঙুর পরে কেউ দৌড়াচ্ছে! সেইসঙ্গে শোনা যাচ্ছে পায়ের চাপে গাছের পাতা ভেঙে যাওয়ার মর্মর শব্দ। আকাশে তারার আলো ছাড়া আর কিছু নেই। ঠাহর করে বুঝলাম, শব্দটা আসছে পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্ত থেকে। ওখানে একটা দোলনা রাখা আছে। আমারা যেটায় বসে সূর্যাস্ত দেখছিলাম। রহস্য উদঘাটনে দ্রুতপায়ে যেতে লাগলাম সেদিকে। ঘুঙুরের শব্দও দ্রুতলয়ে বাজতে লাগল। সাঈদ দৌড়াতে শুরু করেছে! পেছন থেকে আমরা ডেকে যাচ্ছি, সে থামছে না। দৌড়াতে দৌড়াতে সাইদ পৌঁছে গেছে পাহাড়ের কিনারে! আর দুই পা এগুলেই  দেড় হাজার ফুট নিচে পড়ে যাবে ও। রনি ভাই ছুটে গিয়ে ওকে ধরে ফেলল। ঘুঙুরের আওয়াজ আর নেই। সাঈদকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘কাউকে দেখলেন’? সাঈদ বলল- ‘বনবিবি’!

রাত সাড়ে ৯টা বেজে গেছে। রানাকে দেখলাম মাটির ওপর শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাবুতে থাকা মাদুরের একটা অংশ তার গায়ের নিচে, আরেক অংশ দিয়ে কাঁথা বানিয়েছে। নিচের রেস্টুরেন্ট থেকে আমাদের জন্য রাত কাটানোর সরঞ্জামাদি নিয়ে আসা ছেলেটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বারবিকিউ করতে। সাঈদ শুয়ে পড়েছে খোলা আকাশের নিচে। আমি আর রনি ভাই সিগারেট টেনে যাচ্ছি। না চাইলেও মাথায় চেপে বসেছে ঘুঙুরের শব্দ আর সাঈদের ‘বনবিবি’। তাবুতে ফিরে সাঈদ কিছু বলছে না। বনবিবি সুন্দরবনের দেবী বলে জানি। ওখানকার কাঠুরে, মৌয়ালরা মাঘের প্রথম দিনে বনবিবির পূজা করে। সুন্দরবনের বনবিবিকে বান্দরবানের পাহাড়ের চূড়ায় সাঈদ কীভাবে দেখে ফেলল সেটা ভেবে বেশ মজাই পাচ্ছিলাম। সাঈদ চুপচাপ আছে দেখে ওকে আর বিরক্তও করছি না। তবে ওকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ ভয় পেয়েছে! সম্ভবত পরিবেশের কারণে ওর হ্যালুসিনেশন হয়েছে। তাবুতে ফেরার পথে ওর হাঁটা স্বাভাবিক ছিল না। ও এমন নেতিয়ে পড়লে ট্যুরটাই ভণ্ডুল হয়ে যাবে। কথায় বলে, সমস্যা থাকলে নাকি সমাধানও থাকে। আমাদের সমাধান এখন রনি ভাই। চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন বুকে বয়ে বেড়ানো ছেলেটির মাঝে মানুষকে মোটিভেশন দেওয়ার দারুণ একটা গুণ আছে। আমরা এই যাত্রাপথে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার তার প্রমাণ পেয়ে গেছি। তাই সাঈদকে চাঙ্গা করতে রনি ভাই আসরে নামলেন। তাতে বিশেষ সুবিধা না হওয়ায় মোটিভেশনে ক্ষান্ত দিয়ে তিনি তারার ছবি তুলতে লাগলেন।

হাতের সিগারেটটা শেষ হয়ে গেছে। প্রবল বাতাসের মাঝে অনেক কসরৎ করে আরেকটি ধরিয়ে ফেললাম। হুট করেই যেন চারদিকে নেমে এলো নিরবতা। কারও মুখে কোনো কথা নেই। রানার ঘুম ভেঙে গেছে। সে উঠে এসে বসেছে আমাদের পাশে। নেশার প্রভাব কেটে যাওয়ায় পাগলামি করছে না। বরং আমার মুঠোফোন চেয়ে নিয়েছে বাড়িতে যোগাযোগ করবে বলে। বারবার লাইন কেটে যাচ্ছে। রানা স্থানীয় ভাষায় ফোনে কথা বলছে, যার এক বর্ণও বুঝতে পারছি না। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর রানা তৃপ্তির হাসি হাসল। মানে সে যোগাযোগ করতে পেরেছে। কিছুক্ষণ আগেই আমার সঙ্গীতচর্চার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া রানা হঠাৎ বেসুরো গলায় গান ধরে। ওর কণ্ঠনিঃসৃত বিকট আওয়াজে যেন পাহাড়ও চমকে ওঠে। রানাকে পাওয়ার ঘটনাও কম চমকপ্রদ নয়। ওর পুরো নাম মাসুদ রানা। ১৫-১৬ বছরের ছেলেটি আমাদের দলের কেউ নয়। তাকে আমরা আলীর গুহা থেকে তুলে এনেছি! এমন চটপটে আর বুদ্ধিমান ছেলে বেশ কমই দেখা যায়। রানাকে খুঁজে পাওয়ার পেছনে বড় অবদান আরিফ নামের এক অটোরিকশা চালকের। সেই অটোরিকশা চালক আবার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আলীকদম বাসস্ট্যান্ডে নামতেই সে আমাদের কাছে এসে জানতে চায়, কোথায় যাব? আলীর গুহা বলতেই রাজি হয়ে যায়। আমরাও চেপে বসি তার গাড়িতে। 

আমার সঙ্গে গিটার দেখে সে খুব উৎসাহী হয়ে জানায়, সে নিজে একজন কবি। গানটানও লিখে। আমরাও বেশ উৎসাহী হই এই ভেবে যে, একজন পাহাড়ী কবির সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। কিন্তু সে যখন গান আর কবিতা শুরু করল, সাথে সাথে বুঝলাম বিপদে পড়েছি! সে তার দলের জীবিত, মৃত এবং পলাতক নেতৃবৃন্দের স্তুতি করে গান লিখেছে এবং সুর করেছে। অনেকটা গণসঙ্গীত ঘরানার সুর। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা এসব স্তুতি পছন্দ করেন। তাদের উৎসাহ পেয়ে আরিফের মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রক্ষালিত হয়ে গেছে। এসব স্তুতিমূলক গানের জন্য নাকি তাকে জেলও খাটতে হয়েছে! জেল থেকে বেরিয়ে অটোরিকশা চালাচ্ছে আর গান লিখছে। আরিফ একনাগারে কথা বলে যাচ্ছিল। সঙ্গে কান ঝালাপালা করা গান। কোনো থামাথামি নেই। তার কথা এবং গান আমরা শুনতে চাই কিনা- সে ব্যাপারেও তার কোনো আগ্রহ নেই। নিজের থেকেই সমানে বকবক করে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, জেলের লোকজন বোধহয় এর বকবকানিতে অতিষ্ঠ হয়ে জেল থেকে বের করে দিয়েছে! শুরু থেকে আরিফকে ব্যাপক উৎসাহ দিয়ে যাওয়া রনি ভাইকেও দেখলাম মাথা চুলকাচ্ছে। সাঈদের কোনো ভাবান্তর নেই। সে সারাক্ষণ টেনশনে আছে, আমরা দেরি করে ফেলছি না তো? পরের স্পটে ঠিক সময় যাওয়া যাবে তো?

কিছুক্ষণ পর আলীর গুহার সামনের রাস্তায় এসে পড়লাম। আরিফের গান ও কবিতার ঝড়ে আমাদের তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। হুড়মুড় করে অটো থেকে বের হলাম। অটোচালক আরিফ কথা বলেই যাচ্ছে। পারলে আমাদের সঙ্গে গুহায় ঢুকে পড়ে! বিপদ বুঝে রনি ভাই তাকে নিবৃত্ত করলেন। গুহার প্রবেশ পথের সামনে একটা ব্রিজ। সেই ব্রিজের ওপরেই দাঁড়িয়ে ছিল মাসুদ রানা। আরিফের মাধ্যমে আলীর গুহার গাইড হিসেবে মাসুদ রানাকে ঠিক করা হলো। সেই থেকে মাসুদ রানা আমাদের সঙ্গী। এই ছেলেটা এতটাই বুদ্ধিমান যে, যে কোনো কিছুই দ্রুত শিখে নেয়। যেমন ক্যামেরা চালানো। ভ্রমণে এসে ছবি তোলার কাউকে পেয়ে গেলে শহুরে লোকেদের আনন্দ ধরে না। তাছাড়া অন্য গাইডদের সঙ্গে রানার পার্থক্য হলো, তার কোনো তাড়াহুড়া নেই। আমরা যতক্ষণ চেয়েছি, ততক্ষণই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখিয়েছে। দীর্ঘ ঝিরিপথ ধরে হেঁটে আলীর গুহায় মাথা গলিয়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল। এক ধরনের ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। ভেতরে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। অক্সিজেনের স্বল্পতা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রথমে কিছুদূর দাঁড়ানো যাচ্ছিল না। উবু হয়ে ছিলাম। বদ্ধ জায়গায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। গুহার ভেতরে বেশ ঠাণ্ডা। এর মাঝেও আমি ঘামছিলাম। এক পর্যায়ে বাইরে বেরোতে চাইলাম। রানা কিছুতেই বেরোতে দেবে না। বাংলা এবং স্থানীয় ভাষা মিশিয়ে সে বলে উঠল, ‘আপনার সব দায়িত্ব আমার। চলেন তো দেখি!’

ওর হাত ধরে আমি এগিয়ে চললাম। গুহা একসময় বড় হলো। দাঁড়াতে পারলাম। ফোবিয়া কেটে গেল। কিছুক্ষণ ছবিটবি তুলে গুহার অন্যপ্রান্ত দিয়ে বেরোতেই ঝলসে উঠল চোখ। চারদিকে পাহাড়, মাঝে ছোট্ট এক চিলতে জায়গা, ওপর থেকে স্পটলাইটের মতো আসছে সূর্যালোক! নিচে গভীর খাদ। সেই খাদের ধারে পাথরের ওপর বসে আমরা যেন ভাষা হারালাম। ঘোর কিছুতেই কাটছিল না। আরও ছোট ছোট পর্যটকের দল সেখানে আসছিল। ছবি তুলে চলে যাচ্ছিল। আমরা বসেই ছিলাম খাদের ধারে বিশাল পাথরটির ওপর। রানারও কোনো তাড়া নেই। বসে বসে এই অপার্থিব দৃশ্য দেখলাম অনেক্ষণ। আমাদের ঘোর কাটল সাঈদের তাড়া খেয়ে। সে শুরু থেকেই আমাদের তাড়া দিয়ে আসছে সবকিছু দ্রুত শেষ করতে। এজন্য তাকে আমরা ‘তাড়াতাতড়ি মন্ত্রণালয়’ এর মন্ত্রীর দায়িত্বও দিয়েছি। আমরা গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। সেইসঙ্গে সিদ্ধান্ত হলো, রানাকেও মারায়ং তন পাহাড়ে নিয়ে যাব। রানাও এক কথায় রাজি। সে কখনো মারায়ং তন পাহাড়ে যায়নি। তাকে শর্ত দিলাম, বাড়িতে জানিয়ে যেতে হবে। 

মারায়ং তন পাহাড়ে রাত গভীর হচ্ছে। আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে আছি আকাশপানে তাকিয়ে। বাতাস থেমে গেছে। ফিরে এসেছে সেই ভয়াল নিরবতা। পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে তারাদের দল সরে গেছে, আমরা থেকে গেছি আগের জায়গাতেই। রানা আর সেই ছেলেটাকে একটা তাবুতে পাঠিয়ে দিয়েছি ঘুমোতে। সিগারেট ধরাব বলে ম্যাচটা খুঁজছিলাম, এর মাঝেই রাতের নীরবতা ভেঙে সাঈদ স্পষ্ট কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘ভাই, বিয়ে যদি করি পাহাড়ী মেয়েকেই করব। ঘরজামাই হয়ে থাকব পাহাড়ে’। 

ওর এই কথায় আমাদের হো হো হাসি পাহাড়ের গা ছুঁয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো। রনি ভাই বলল, ‘সাঈদকে তাহলে বনবিবি ধরেছে? কবিরাজ ডাকব? ঝাঁড়ফুক দিয়ে যাক…’ 

তার এই কথায় আবার হাসি। আমাদের লাগামহীন হাসির বিকট শব্দ শুনে রানা তাবু থেকে বেরিয়ে এলো। তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ময়লা হয়ে যাওয়া সাদা চাদরে মোড়ানো। নেশার প্রভাবে টলতে টলতে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। আবছা আলোয় দেখে বোঝার উপায় নেই এটা মানুষ না কোনো প্রেতাত্মা! কাছে এসে জড়ানো কণ্ঠে সে জানতে চাইল হাসির কারণ। ওকে বলা হলো, সাঈদ একটা পাহাড়ী মেয়ে বিয়ে করতে চায় এবং এখানেই থেকে যেতে চায়।

‘কিন্তু আদিবাসীরা তো নিজ গোত্রের বাইরে বিয়ে করে না। কেউ এমনটা করলে তাকে সমাজচ্যুত করা হয়। একটা সময় মেরেও ফেলা হতো!’

আমার এই কথা শুনে সাঈদ কিছুটা দমে যায়, ‘তাহলে কী হবে?’

সাঈদের দুশ্চিন্তা দূর করতে চায় রানা। যে ইতোমধ্যেই আমাদের বেশ কিছু সমস্যার সমাধান করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তার থেকে জানা গেল, এখন অনেক আদিবাসীরাই ধর্মান্তরিত হচ্ছে। কিংবা তাদের ধর্মান্তরে বাধ্য করা হচ্ছে। পাহাড়িদের ওপর বাঙালি সেটেলারদের অত্যাচারের গল্প পুরনো। এখনও সবার অলক্ষ্যে চলছে সেই মধ্যযুগীয় নির্যাতন। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে আদিবাসীদের জায়গা-জমি। সেখানে গড়ে উঠছে শহুরে বাবুদের জন্য বিলাসবহুল রিসোর্ট। মাঝেমধ্যেই ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আদিবাসী নারীদের। দুদিন পর কোনো পাহাড়ের কোলে পড়ে থাকে ক্ষতবিক্ষত লাশ! পত্রিকার পাতায় ছবি দেখে আমরা হা-হুতাশ করি। তারপর সবাই ভুলে যায়। স্বাধীন দেশের পাহাড়ে এখনো চলে বন্দুকের আইন। পাহাড় ঘিরে থাকা জলপাই বন ভেদ করে বাইরে পৌঁছায় না আদিবাসীদের প্রতিবাদের আওয়াজ।

একটা ঘটনা শুনেছিলাম। কয়েক বছর আগে সাংবাদিকদের একটা দল গিয়েছিল খাগড়াছড়ির পাহাড়ে বনভোজন করতে। সেই দলের কেউ একজন পাহাড়ী নারীদের সঙ্গে যৌন হয়রানিমূলক আচরণ করে। প্রতিবাদে দলে দলে পাহাড়ীরা এসে জড়ো হয় তাদের কটেজের কাছে। অবস্থা বেগতিক দেখে সাংবাদিকের দল খবর দেয় জলপাই বনে। তারা এসে প্রতিবাদী আদিবাসীদের পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়! পাহাড় চূড়ায় শুয়ে সাঈদ স্বপ্ন দেখছে সেই নিপীড়িত আদিবাসীদের একজনকে আপন করে নিতে। হয়তো প্রকৃতি দেখে ওর মনে এমন ভাবের সৃষ্টি হয়েছে। সকাল হলে কি সেটা থাকবে?

আমাদের হাসি-ঠাট্টার মাঝেই আবারও ফিরে এলো সেই ঘুঙুরের আওয়াজ! ধীরে ধীরে নিকটবর্তী হচ্ছে সেটা। টর্চের আলোয় যতটা দেখা যাচ্ছে, কিছুই নেই। কিন্তু আওয়াজ আসছে। রানা দোয়া-দরুদ পড়তে শুরু করেছে। আমরাও বেশ শংকিত এবং ততোধিক বিরক্ত। সাঈদের কোনো ভাবান্তর নেই। সে মাদুরে শুয়ে আছে। রনি ভাই চারদিকে টর্চ জ্বলে দেখছে কিছু দেখা যায় কিনা। এমন সময় তাবুর একপাশে জ্বলজ্বল করে উঠল একজোড়া চোখ, যা দেখে রানা ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল! রনি ভাইয়ের হাতে থাকা টর্চটা কাঁপছে। ঘুঙুরের শব্দ একদম কাছে চলে এসেছে। আমরা উঠে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি, সাঈদ শুয়েই আছে। এমন সময় টর্চের আলোয় যা দেখা গেল, তাতে আরও একবার হাসির ঝড় উঠল পাহাড়ে। বিশাল সাইজের একটা সাদা রংয়ের গরু খস খস শব্দ করে হাঁটছে, তার গলায় থাকা ঘণ্টা বাজছে ঘুঙুরের মতো। এই গরুটা সন্ধ্যা থেকে আমাদের বোকা বানিয়েছে, আর সাঈদ বলছে বনবিবি! সাঈদ শুয়ে শুয়েই আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ও, এইটা একটা ছোট বাছুর’! সাঈদের কথায় ভয় কেটে গিয়ে ফের হাসির রোল উঠল। এত বড় একটা গরুকে সাঈদ ছোট বাছুর বলছে- এর চেয়ে হাস্যকর কী হতে পারে! গরুটা কিছুক্ষণ আমাদের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে চলে গেল। ঘুঙুরের শব্দও মিলিয়ে গেল। আমাদের হাসাহাসি কিংবা সেই ‘ছোট বাছুরের’ সৌজন্যেই হয়তো শেষ পর্যন্ত মুড ফিরে পেল সাঈদ। তার মুখে দেখা গেল হাসি। তাবুর ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু আগামীকাল আমরা ট্রেকিং করে দীর্ঘপথ পাড়ি দেব। তাই ঘুমাতে হবে। আমরা তাবুর ভেতর ঘুমাতে গেলাম। সাঈদ আলাদা তাবুতে একলা শুয়েছে। শরীর এলিয়ে দিতেই চোখে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম। তাবুর চারপাশে শোনা যেতে লাগল ঘুঙুরের শব্দ।

মারায়ংতন পাহাড়ে রাতে দারুণ ঘুম হওয়ায় সবাই বেশ তরতাজা। ভোরে উঠে আমরা সূর্যোদয় দেখেছি। এরপর ফ্রেশ হয়ে পাহাড় থেকে নেমে এসেছি পদব্রজে। তবে পাহাড় থেকে নামা যতটা সহজ ভেবেছিলাম ততটা নয়। মারায়ংতন থেকে নেমে আসতে আমাদের পাক্কা দুই ঘণ্টার মতো লাগল। দিনের আলোয় রাতের রহস্যের যবনিকা ঘটে। তাই তিনজনই ছিলাম ফুরফুরে মেজাজে। নামতে নামতে দেখছিলাম আদিবাসীদের জীবনযাত্রা, তাদের কৃষিকাজ, পশুপালন। কোনো গরু চোখে পড়লেই সাঈদকে ডাক দিচ্ছি। বেচারা হাসিমুখে এই অত্যচার সহ্য করছে। একবার রনি ভাই বিকট চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, ‘সাঈদ, ওই যে আপনার বনবিবি’! আমরা ডানে তাকিয়ে দেখলাম, এক বয়োবৃদ্ধ নারী গাছ থেকে শুকনো ডাল ভাঙার চেষ্টা করছেন। রনি ভাইয়ের চিৎকারে তিনি সচকিত হয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। তারপর ফোকলা দাঁতে দুর্দান্ত এক হাসি দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। আমরাও হাত নেড়ে তার জবাব দিলাম। অর্ধেক পথ নেমে আমরা হাঁফাচ্ছিলাম। এসময় চোখে পড়ল এক আদিবাসী বৃদ্ধের দোকান। তিনি মাত্র ৫০ টাকায় আমাদের অনেকগুলো কলা দিয়ে দিলেন। সেইসঙ্গে পাহাড়ের পেপে আর জল খেয়ে আমরা চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। অবশেষে পথের শেষ হলো। সমতলে নেমে আমরা নাস্তা করে চললাম আলীকদম বাসস্ট্যান্ডে। রানাকে বিদায় দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল আগে থেকেই। তাই একদফা বিদায় দেওয়া হয়ে গেছে। আমরা বাইকযোগে থানচি যাব। রানা বাইক ঠিক করার চেষ্টা করছে। এর মাঝেই পেছন থেকে ডাক। তাকিয়ে দেখি সেই অটোচালক আরিফ! সে জানত আমরা আজ থানচি যাব। তাই এখানে এসে বসে আছে আমাদের সাক্ষাত পেতে! রনি ভাইকে বললাম, ‘যে করেই হোক এই পাগল বিদায় করেন। ওকে নিয়ে থানচি গেলে ট্যুরটাই মাটি হয়ে যাবে!’

আরিফকে বিদায় করতে তবু ১৫ মিনিট লেগে গেল। রানা বাইক পেয়ে গেছে। ওকে এখন বিদায় দিতে হবে। কিন্তু মন মানছিল না। বাইকে ওঠার আগমুহূর্তে রনি ভাই আমাদের মনের কথাটাই বলল, ‘ওরে নিয়ে যাই.. কী বলেন’? আমাদের মুখে হাসি ফুটল। রানা উঠে বসল বাইকে। পাহাড়ের গা বেয়ে ভয়াবহ উঁচু নিচু রাস্তা বেয়ে আমরা এলাম থানচি। এমন ভয়ংকর রাস্তায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। প্রায় ৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বাইক যখন ঢালে নামছিল, কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছিল আমাদের। বাইকে যেতে যেতে আমার মাথার হ্যাট উড়ে গেল। প্রচণ্ড গতির মাঝে সেটা কোথায় উড়ে গেছে কে জানে? চালকও আর বাইক থামাতে রাজি হলো না। আমরা পৌঁছে গেলাম থানচি।

থানচিতেই আমাদের গাইড জ্যাকবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। ছোটখাট গড়নের শান্তশিষ্ট মানুষ জ্যাকব। এখন আমাদের কিছু ফর্মালিটিজ পালন করতে হবে। গাইড সমিতির অফিসে কাগজপত্র সাক্ষর করতে করতে রনি ভাই আর সাঈদকে হ্যাট হারানোর দুঃখের কথা জানালাম। তারা পরামর্শ দিল একটা কিনে নিতে। সামনেই একটা দোকানে অনেক ধরনের টুপি ঝুলছে। একশত পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে একটা হ্যাট কিনে যেই এসেছি, ওরা অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল! পরে জানলাম, আমার হ্যাট উড়ে যেতে দেখে রনি ভাই বাইক থামায়। সাঈদকে পাঠানো হয় হ্যাট উদ্ধারে। বেশ চমকপ্রদ ঘটনা। রনি ভাই নিজেই গিয়ে সদ্য কেনা টুপিটা ফেরত দিয়ে আসে। কাগজপত্র সাক্ষর শেষে আমাদের যেতে হবে থানায়। ছোট্ট একটা পাহাড়ের ওপর বড় জায়গা নিয়ে থানচি থানা নির্মিত হয়েছে। খাড়াই বেয়ে উঠতে আমরা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। থানায় ঢুকেই দেখি ফ্রন্টডেস্কে এক সুন্দরী অফিসার বসা। তিনি আমাদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদ করে ফর্মালিটিজ পূরণ করছিলেন। সমস্যা বাঁধল রানাকে নিয়ে। রানা যেহেতু আমাদের দলের কেউ নয়, তাই সেই অফিসার তাকে নাফাখুম যেতে দেবেন না! আমরা যদি রানাকে নিয়ে মেরে টেরে ফেলি- এমন কথাও বলছিলেন! মহা মুশকিল। অফিসারের যুক্তিও অবশ্য অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। এই যুগে আমাদের মতো শিশুতোষ ভাবনা কেউ ভাবে কি? এমন পরিস্থিতিতে আবার ত্রাণকর্তা রনি ভাই। তিনি সানগ্লাসটা মুছে নিয়ে ফের চোখে পরে অফিসারকে বোঝাতে শুরু করলেন। একপর্যায়ে অফিসার আমাদের পেশা জানতে চাইলেন। সব শুনে একটু রাগ করেই হয়তো অফিসার রানাকে বললেন, ‘ইউ মে গো, বাট অ্যাট ইউর ওউন রিস্ক’। রানা কিছু না বুঝেই দাঁত বের করে হাসতে লাগল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

আসলে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্যই প্রশাসন এমন কড়াকড়ি আরোপ করেছে। থানচি থেকেই কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। আমাদের মুঠোফোনগুলো আকেজো হয়ে গেছে। দুর্গম এই জনপদে হারিয়ে যাওয়া সহজ, খুঁজে পাওয়া কঠিন। খবর পাঠানো আরও দুরূহ কাজ। অফিসার নরম কণ্ঠে আমাদের কথাগুলো বোঝাতে চাইলেন। আমরা যে বুঝছি না সেটা কিন্তু নয়; আসলে মানবিক আবেগের কাছে হার মেনেছে নিয়ম। রানা এখন আমাদের একজন হয়ে গেছে। বিদায় নেওয়ার সময় পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, ওপাশে জলের ব্যবস্থা আছে আপনারা হাত মুখ ধুতে চাইলে যান। বোতলে করে জল নিয়েও যেতে পারেন। তিনি বাইরে এসে জায়গাটা দেখিয়েও দিলেন। আমরা উনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বিদায় নিলাম। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে নতুন রোমাঞ্চ।

মাইলসের একটা বিখ্যাত গান আছে- পাথুরে নদীর জলে, পাহাড়ী মেয়ে নামে….। আমরা এখন সেই পাথুরে নদীতে ইঞ্জিনচালিত নৌকায়। পাহাড়ী মেয়ের খোঁজে থাকা সাঈদ নৌকার একদম সামনে গিয়ে বসল। মাঝি তো তাকে বসতে দেবে না। এ নিয়ে মাঝির সঙ্গে তার একচোট হয়েও গেল। জ্যাকব যতটা শান্ত, মাঝি ততটাই বদমেজাজী। মাঝির ব্যাপারটা বাদ দিলে শঙ্খর বুকে এই নৌকাভ্রমণ দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। নৌকা যতই এগোচ্ছে দুই পাশে দৃশ্যমান হচ্ছে উঁচু উঁচু সব পাহাড়। অনেকগুলোয় জুম চাষ হচ্ছে। আমাদের গন্তব্য রেমাক্রি। শঙ্খ নদীর তলদেশ পুরোটাই পাথুরে। ফাল্গুন মাস হওয়ায় গভীর স্থানেও পানি সর্বোচ্চ হাঁটু পর্যন্ত। তাই নৌকাচালক আর আমাদের গাইড জ্যাকবকে বেশ কসরৎ করে নৌকা চালাতে হচ্ছে। পাথরের আঘাতে নৌকার প্রপেলার বেঁকে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যেই নৌকা থামিয়ে প্রপেলার মেরামত করছেন মাঝি। আমাদেরও নামতে হচ্ছে বারবার। এভাবেই থানচি থেকে রেমাক্রি গিয়ে আমরা শঙ্খ নদীর কুল ঘেষে পাহাড়ী ঝোপ জঙ্গল দিয়ে নাফাখুমের উদ্দেশ্যে ট্রেকিং করব। ‘তাড়াতাড়ি মন্ত্রণালয়’ এর মন্ত্রী সাঈদের তাড়াহুড়ায় আমাদের দুপুরের খাওয়া হয়নি। তার ওপর রনি ভাই মুরগির কষা মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার কথা বলে ক্ষুধা বাড়িয়ে দিলেন। মাঝনদীতে ভাত-মুরগির মাংস কোথায় পাব? তাই প্রকৃতি দেখেই মনের ক্ষুধা মেটাতে হচ্ছে। সাঈদ অবশ্য সীমিত পরিসরে পেটের ক্ষুধা মেটানোর ব্যবস্থা করে ফেলল। ওর ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এলো কিছু শুকনো খাবার। সেইসঙ্গে একটা ব্যাগ। ট্যুরের শুরু থেকেই আমাদের প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো এই ব্যাগে জড়ো করে রেখেছি। একটাও বাইরে ফেলিনি। বিষয়টি লক্ষ্য করে জ্যাকব বলল, “আপনাদের ধন্যবাদ দাদা। বেশিরভাগ পর্যটককে হাতে পায়ে ধরলেও যেখানে সেখানে প্লাস্টিক ফেলে পরিবেশ দূষণ করে।” শঙ্খ নদীতে ভাসতে থাকা প্লাস্টিক দেখে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস- আমরা জাতি হিসেবে এমন কেন?

নৌকায় ভাসতে ভাসতে চলে এলাম পাথরের অরণ্যে। চারদিকে বিশালাকায় সব কালো রংয়ের পাথর। রানা আবিস্কার করল, একটি পাথর দেখতে ঠিক ডুবন্ত টাইটানিকের মতো। আরেকটি পাথর দেখিয়ে জ্যাকব জানাল সেটির নাম রাজা পাথর। নদীর দুপাশে বিশাল বিশাল সব পাহাড়। আমরা যেন সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া বালকের মতো পরম বিস্ময়ে আমর বোঝার চেষ্টা করছি প্রকৃতির খেয়াল। রেমাক্রির আগে বাঘের মুখ নামে একটা জায়গা আছে। যেখানে বর্ষাকাল ছাড়া নৌকায় যাওয়া যায় না। মাঝি একাই টেনে হিঁচড়ে নৌকা পার করে। এই সুযোগে পর্যটকেরা বিশ্রামের সুযোগ পায়। দ্বীপের মতো জায়গাটিতে বেশ কয়েকটি দোকান। সবগুলোই পরিচালনা করছেন আদিবাসী নারীরা। পরবর্তীতে যতটা পথ গিয়েছি, নারীদেরকেই দেখেছি দোকান পরিচালনায়। চা খেতে বড্ড ইচ্ছে করছে। তাই  একটি দোকানে আমরা ঢুকে পড়লাম। দোকানগুলোয় ভাত-মাংসের ব্যবস্থা নেই। তবে চা, হালকা খাবারের পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে পাহাড়ী মদ আর গাঁজা। ওসবে আমাদের আগ্রহ না থাকায় চায়ের অর্ডার হলো।

রনি ভাই কেমন যেন উসখুস করছিলেন। জিজ্ঞেস করতেই ইঙ্গিত করলেন পাশের দোকানে। তাকিয়ে দেখি, সেই দোকানে বসে আছে অনিন্দ্য সুন্দরী এক আদিবাসী তরুণী। পরনে ঐতিহ্যবাহী পোশাক, হাসিতে যেন মুক্তো ঝরছে। রনি ভাইকে বললাম, ‘সাঈদের বনবিবি’। শুনে বেচারার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। সে হয়তো আশা করেছিল, তাকে নিয়েই কিছু বলব। চা খেতে খেতে রনি ভাই বারবার আফসোস করছিল, পাশের দোকানটায় কেন আমরা বসলাম না। তাকে বোঝালাম, ফেরার পথে অবশ্যই সেই সুন্দরীর দোকানেই আমরা চা পান করব। তবু রনি ভাইয়ের মন ভালো করা গেল না। সে উদাস হয়ে সিগারেট টানতে লাগল। ভেবেচিন্তে একটা উপায় বের করলাম। গাইড জ্যাকবকে বলে সেই সুন্দরীর জিম্মায় আমাদের ব্যাগপত্রগুলো রেখে দিলাম। যেহেতু দীর্ঘ পথ ট্রেকিং করতে হবে, তাই জরুরি জিনিসগুলো নিয়ে বাড়তি বোঝা রেখে যাওয়াই উত্তম। আদিবাসী সুন্দরী সহাস্যে আমাদের বোচকা বুচকি গ্রহণ করল। রনি ভাইয়ের মনও ভালো হয়ে গেল। এদিকে সাঈদ আর জ্যাকব তাড়া দিচ্ছে, ফুরিয়ে আসছে দিনের আলো। আমাদের বেরোতে হবে। ফের নৌকায় উঠে ১০ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম রেমাক্রি। বসন্তেও রেমাক্রির ছোট্ট জলপ্রপাতটিতে অঝোরে জল ঝরছে। চোখে পড়তেই স্নান করার প্রবল বাসনা জেগে উঠল। কিন্তু ‘সময় নেই’ বলে বাধা দেওয়ার জন্য সাঈদ তো আছেই! ওই জলপ্রপাতটি বাদে রেমাক্রির বর্তমান রূপ যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে এসে উপনীত হয়েছে। জায়গাটার সৌন্দর্য বিনষ্ট করেছে পাহাড়ের ওপর বস্তির মতো কিছু রিসোর্ট। সেগুলোর কোনো একটায় বিকট স্বরে মাইক বাজছে। মানুষের অপরিণামদর্শী কাজের খেসারত হিসেবে প্রকৃতি হারিয়েছে রূপ। তাই রেমাক্রি আমাদের মন ভরাতে পারেনি। শেষ বিকেলের আলোয় চারদিকে একটু নজর বুলিয়ে আমরা শঙ্খ নদীর কুল ঘেষে ট্রেকিং শুরু করলাম। 

শঙ্খ অববাহিকা ধরে পায়ে হেঁটে রেমাক্রি থেকে নাফাখুম যেতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লাগবে। সেখানেই আমরা রাত্রিযাপন করব। দ্রুত দিনের আলো কমে আসছে। পাহাড়ের কোলে চাষ হচ্ছে কলা, বাদাম, তরমুজ আরও কত কী। রানা বেশ বিজ্ঞের মতো জিজ্ঞেস করল, ‘তরমুজ গাছ চিনেন?’ মাথা নাড়তেই সে আমাদের দেখাল তরমুজের ক্ষেত। লতানো গাছে ছোট ছোট তরমুজ ফলেছে। পথের ধারে ফুটে আছে কত ধরনের পাহাড়ী ফুল। সূর্য যখন ডুবি ডুবি করছে, তখন আমরা একটি অদ্ভুত স্থানে এসে পৌঁছলাম। পাহাড়ের মাঝে বড় একটি ফাটল। মনে হচ্ছে পাহাড়টিকে কেউ ভেঙে দু’টুকরো করে দিয়েছে! পাহাড়ের ফাটল দিয়ে অঝোরে ঝরছে ঝিরির জল। সেইসঙ্গে আসছে প্রাণ জুড়ানো ঠাণ্ডা বাতাস। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থেকে যেমন শীতল বাতাস আসে, তার চেয়েও ঠাণ্ডা আর স্নিগ্ধ সেই পাহাড়ী বাতাস। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত দেহে আমরা ঝিরির পাশে থাকা পাথরের ওপর বসে পড়লাম। গাইড জ্যাকবের কাছে ঝিরির জল খেতে চাইতেই সে বোতল হতে নেমে গেল। ঝিরির নিচটা বেশ গভীর। জ্যাকব অনেক কায়দা করে পাশ ঘেষে ঝিরির কাছে পৌঁছে জল নিয়ে এলো। ভারী মিষ্টি সেই জল। ঠাণ্ডা বাতাস আর ঠাণ্ডা ঝিরির জলে শরীর-মনে প্রশান্তি এনে ফের শুরু হলো আমাদের যাত্রা।

চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। টর্চের আলোয় আমরা পাহাড়ের কোল ঘেষে এগিয়ে যাচ্ছি। ঝি ঝি পোকার তীব্র আর্তচিৎকারে কান পাতা দায়। সাঈদ জ্যকবের সঙ্গী হয়ে সবার আগে গটগট করে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা তিনজন এগোচ্ছি বেশ ধীরে সুস্থে। যেহেতু রানা আমাদের সঙ্গে আছে, তাই কোনো সমস্যই নেই। জ্যাকব বারবার তাড়া দিচ্ছে আমাদের। কখনো পাথরের ওপর আবার কখনো ঝুড়ঝুড়ে মাটিতে সন্তর্পণে পা ফেলে আমরা হাঁটছি। এক পর্যায়ে জ্যাকব জানাল, আমাদের নদী পার হতে হবে। ফাল্গুন মাস হওয়ায় গোঁড়ালি পর্যন্ত জল, কোনো চিন্তা নেই। শুধু দেখে শুনে এগুতে হবে। নদীর তলদেশের পুরোটাই নিরেট পাথুরে। দেখলে মনে হবে কেউ ঢালাই করে রেখেছে। শ্যাওলা জমায় সেই পাথরগুলো ভীষণ পিচ্ছিল। গাইড সাবধান করে বলল, শুধু সাদা পাথরগুলোতেই যেন আমরা পা রাখি। সাঈদ গাইডের সঙ্গী হয়ে সহজেই নদী পার হয়ে গেল। রনি ভাইয়ের পিছু পিছু আমি এগুচ্ছি। কিন্তু নদীর জলে টর্চের আলো পড়তেই আমার চোখে এক ধরণের ইল্যুশন তৈরি হচ্ছিল।  টর্চের আলো ছাড়া কিছুই দেখতে পারছিলাম না। এভাবেই নদীর মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে এসেছি। প্রবল স্রোতে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। রনি ভাইকে ডাকলাম। তিনি সাড়া দিয়ে আমাকে সাহায্য করার জন্য ফিরে আসতে লাগলেন। হঠাৎ একটি হাত এগিয়ে এলো আমার দিকে! লাল চুড়ি পরা হাত।

পেশায় আমরা তিনজনই ক্রীড়া সাংবাদিক। রাজধানী ঢাকার মিরপুরে আমাদের অফিস। সেই সুত্রেই রনি ভাই আর সাঈদের সঙ্গে পরিচয় আর ঘনিষ্ঠতা। ওরা দুজন ব্যাচেলর, আর আমি বিবাহিত ব্যাচেলর। তাই ব্যাচেলরদের সঙ্গে ট্যুরে যাওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি। যে যাই বলুক, ফ্যামিলি ট্যুর, কাপল ট্যুর আর ব্যাচেলর ট্যুরের মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। রানা ছেলেটাও বেশ অদ্ভুতভাবে জুটে গেছে আমাদের সঙ্গে। এইমাত্র সে প্রকাণ্ড একটা থাপ্পড় হজম করেছে। যে তাকে থাপ্পড়টা মেরেছে তাকে স্পষ্ট দেখতে পারছি না। মশাল জ্বলছে। আমরা নিলডাউন হয়ে বসে আছি নদীর পাশেই পাহাড় ঘেরা এক জায়গায়। আমাদের মাথায় রাইফেল ঠেকানো আছে। অন্তত পাঁচজন আমাদের বন্দি করেছে। সবার পরনে সামরিক পোশাক, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। যে চুড়ি পরা মেয়েটা আমাকে নদী পার করে এপাড়ে এনেছিল, তার কোমরে রাখা ছুরিতে মশালের আলো পড়ে ঝকমকিয়ে উঠছে। গাইড স্থানীয় ভাষায় লাল চুড়ি পরা অস্ত্রধারীর সঙ্গে কথা বলছে। তাকে মোটেও চিন্তিত মনে হচ্ছে না। এই লোকটাই কি আমাদের এনে বিপদে ফেলল! রনি ভাই কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই গাইড ঠোঁটে আঙুল দিয়ে কথা বলতে নিষেধ করল। রনি ভাই তবু ফিসফিসিয়ে আমাকে বলল, ‘সঙ্গে যা আছে নিয়ে আমাদের ছেড়ে দিক’! কিন্তু আমার মনে হলো, এটা ছিনতাই কেস নয়। ছিনতাইয়ের ঘটনা হলে আমাদের আটকে রাখত না। সাঈদ জল খেতে চাইল, জবাবে রাইফেলের নলটা আরও শক্তভাবে সেঁটে গেল ওর মাথায়।

সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা একইভাবে বসে আছি। লোকে নাকি এমন সময় পরিবারের কথা, বাবা মায়ের কথা ভাবে। আমার কোনো কিছুই ভাবনায় আসছে না। শুধু ভাবছি, কারা আমাদের পাকড়াও করল? কেনই বা করল? পাহাড়ে অনেক বিদ্রোহী গোষ্ঠী আছে। তারা মাঝেমধ্যে পর্যটকদের ওপর হামলা করে বলে শোনা যায়। এরা যদি তাই করত তবে আমাদের আটকে রেখেছে কেন? মুক্তিপণ? হতে পারে ওরা আমাদের জিম্মি করেছে! শরীর ঘামছে। একটু নড়লেই মাথা ঠোক্কর খাচ্ছে রাইফেলের নলে। আনুমানিক পনের মিনিট পর হঠাৎ একটি শিষের আওয়াজ শোনা গেল। অস্ত্রধারীদের মাঝে সৃষ্টি হলো চাঞ্চল্যের। নিজেদের ভাষায় ওরা কিছু বলছিল। এক পর্যায়ে আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে বলা হলো। ‘গুলি করবে নাকি?’- বিড়বিড় করে বলল সাঈদ। তখন গাইড জ্যাকব বলল, ‘আমাদের কিছুটা হেঁটে তারপর পাহাড়ের ওপরে যেতে হবে’। তাকে বললাম, ‘কিছুই তো বুঝছি না, কী হচ্ছে এসব?’ জ্যাকব চুপ থাকার ইশারা করে তাকে অনুসরণ করতে বলল। রাতের অন্ধকারে মশালের আলোয় আমরা হাঁটতে লাগলাম। পালানোর কোনো উপায় নেই। পাহাড়ী পথ আমাদের কাছে একদমই অচেনা, আর ওদের কাছে হাতের তালুর মতোই চেনা। আমাদের মুঠোফোন এবং টর্চগুলো ওরা নিয়ে নিয়েছে। কোথায় যাচ্ছি জানি না। নদীর কূল ছাড়িয়ে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে আমাদের হাঁটতে হচ্ছে। অন্ধকারে দিক নির্ণয় করারও সুযোগ নেই।

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর  সামনে এলো খাড়া পাহাড়। পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠছি। হাত পায়ে যেন সব জোর চলে গেছে। পা সঠিক জায়গায় পড়ছে না। হড়কে যাচ্ছি বারবার। রনি ভাই আর সাঈদের অবস্থাও তাই। শুধু রানার কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। সে পাহাড় বেয়ে অভ্যস্ত। গাইড জ্যাকব অতি সতর্কতার সঙ্গে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এবং অস্ত্রধারীদের সঙ্গে কথা বলছে। বেশ কিছুটা পথ চড়াই ডিঙিয়ে আমরা বসে পড়লাম। জ্যাকব ওদের কিছু একটা বোঝাল, তাতে ওরা আপত্তি করেনি। পকেট থেকে সিগারেট বের করলাম। কিন্তু ম্যাচ কোথায়? রানা আর রনি ভাইয়ের কাছে কখনো ম্যাচ থাকে না। আমার ম্যাচটাই ভাগাভাগি করা হয়। কিন্তু এখন উত্তেজনার মুহূর্তে সেটাও খুঁজে পাচ্ছি না। ব্যর্থ মনোরথে সিগারেটটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখতে যাব, এমন সময় রাইফেলের একটা নল আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। চমকে গেলাম! তবে বন্দুক থেকে গুলি বের হওয়ার বদলে একটা লাইটার এগিয়ে এলো আমার দিকে। কোনোমতে সিগারেট ধরিয়ে সেই লাল চুড়ি পরা অস্ত্রধারীকে সেটি ফেরত দিলাম। মনে জোর আনার চেষ্টা করলাম। নিজেকে বোঝালাম, ভয় পেয়ে লাভ নেই। কারণ আমাদের অন্য কোনো বিকল্প নেই। সিগারেট শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। আরও অনেক পথ চড়াই ভাঙতে হবে।

পাহাড়ের চূড়াটা বেশ বড়। এমন দুর্গম স্থানেও প্রযুক্তির ছোঁয়া আছে। বেশ কিছু বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছে। পাহাড়ে পৌঁছে গেছে সৌর বিদ্যুৎ। সেসব বাল্বের আলোয় দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু ঘর। চারদিকে ঝোপঝাড়ে ভর্তি। বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই মাঝখানে এমন একটা ছোট্ট গ্রাম আছে।  আমাদের একটা পাথরের ওপর বসতে বলে জ্যাকব ভেতরে চলে গেল। তারপর গেল সেই লাল চুড়ি পরা মেয়েটি। অস্ত্রধারীরা রয়ে গেল আমাদের পাহারায়। আবার অপেক্ষার পালা শুরু। এছাড়া কিছু করারও নেই। মশার দল ছেঁকে ধরছে। এখান থেকে যদি বেঁচে ফিরি, ম্যালেরিয়া হয়ে মরার চান্স বেড়ে যাচ্ছে। সাঈদের কাছে ওডোমস আছে। সেটা ফেলেই সে ট্রেন ধরতে বের হয়েছিল। আমি মনে করাতে আবার গিয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু সেই বস্তুটা ব্যবহার করার মতো পরিবেশ নেই। চারদিক কেমন নীরব, শান্ত। মাঝেমধ্যে চাপা স্বরে কিছু কথাবার্তা কানে আসছে, কিন্তু স্পষ্ট নয়। চারজন অস্ত্রধারী মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। রনি ভাই অধৈর্য হয়ে বলে উঠল ‘আচ্ছা আমি কি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’

  • শাট আপ

জবাবটা এলে সোজা সামনে থেকে। আবছায়া থেকে ভেসে উঠল অসম্ভব রূপবতী এক নারীর অবয়ব। পরনে সামরিক পোশাক, কাঁধে ঝুলছে রাইফেল। কোমরে উঁকি দিচ্ছে চকচকে ভোজালি। গলায় মালার মতো ঝুলছে বুলেটভর্তি অ্যামুনিশন বেল্ট। হাসিমুখে তিনি এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালেন। ডানহাত বাড়িয়ে দিয়ে স্পষ্ট ইংরেজিতে বললেন, ‘ওয়েলকাম জার্নালিস্টস। ওয়েলকাম টু হিল। আই অ্যাম আনুচিং। কমান্ডার অব দ্য ফ্রিডম ফ্রন্টিয়ার।’

আমাদের মুখ হা হয়ে গেছে। চোখের সামনে যেন কোনো হলিউড মুভির দৃশ্য দেখছি। আনুচিং হাত বাড়িয়ে আছে, আমরা হয়ে গেছি স্থির। বেড়াতে এসে অপহরণের শিকার হয়েছি। আমাদের পেশাগত পরিচয়ও তারা জানে। এখন মনে হচ্ছে, আমরা এখানে আসব এটাও হয়তো তারা জানত। কিন্তু কীভাবে? ভ্রমণে এসে থানচি থানা ছাড়া আমরা নিজেদের পেশাগত পরিচয় আর কোথাও দিয়েছি বলেও মনে পড়ে না। অবশ্য দ্রুতই সম্ভাব্য জবাবটাও মাথায় এসে গেল। গাইড জ্যাকবের সঙ্গে ঢাকা থেকে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে। সুতরাং সে আমাদের পেশা সম্পর্কে তার জানাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু জ্যকব ট্যুর গাইডের মতো প্রকাশ্য একটা পেশা বেছে নেওয়ার পরও এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে কাজ করছে কীভাবে? আমরা ফিরে গিয়ে তো প্রশাসনকে বলেও দিতে পারি। নাকি আমরা আর কখনই ফিরতে পারব না? পাহাড়ের কোনো খাদে পড়ে থাকবে আমাদের লাশ!

ভাবনায় ছেদ পড়ে আনুচিংয়ের কথায়। এবার স্পষ্ট বাংলায় কমান্ডার বলে উঠলেন, ‘আপনারা কি ভয় পাচ্ছেন? ভয়ের কিছু নেই। আপনাদের বিশেষ কারণে এখানে আনা হয়েছে। সেটা মিটে গেলেই আপনারা মুক্ত। তবে প্রশ্ন কম করাটাই আপনাদের জন্য ভালো হবে। আমি বেশি প্রশ্ন পছন্দ করি না। সময়মতো সবকিছু জানতে পারবেন।’

আনুচিংয়ের কথায় আমরা যে খুব আশ্বস্ত হলাম তা নয়। তবে হাত বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে। পরিচয় বিনিময় হলো। হ্যান্ডশেক করতে করতেই রানাকে দেখিয়ে আনুচিং জানতে চাইল, ‘এই বাচ্চাটি কে?’ রনি ভাই সুন্দর করে বুঝিয়ে বলল রানার পরিচয়।

শুনে মাথা নাড়তে নাড়তে আনুচিং বলল- ‘কাজটা ঠিক করেননি। এত সহজ সরল চিন্তা করা উচিত নয়। ওর কোনো বিপদ হলে আপনারা আরও বড় বিপদে পড়বেন। সবকিছু আবেগ দিয়ে বিচার করা উচিত নয়। আমাদের দেশে তো নয়ই।’

আলাপে আলাপে দক্ষ সংগঠকের মতো আনুচিং দ্রুতই পরিবেশটা স্বাভাবিক করে তুলল। রনি ভাই এই সুযোগ বললেন, ‘পাহাড়ে এসে সহজ সরল মানুষদের দেখে আমরাও সেভাবে চিন্তা করছিলাম। তাই রানাকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে আসি।’

শুনে আনুচিং হাসল। আমরা কয়েকটি পাথরের ওপর বসে কথা বলছি। আনুচিং আমাদের পরিবারের খোঁজ খবর নিল। কথায় কথায় জানালাম, সে উচ্চশিক্ষিত মেয়ে। অবশ্য সেটা তার বাচনভঙ্গিতেই প্রমাণিত হয়ে গেছে। উন্নত জীবনের সকল সুযোগ থাকলেও তিনি তার শেকড়ে ফিরে এসেছেন। সর্বগ্রাসী সেটেলারদের থেকে পাহাড়কে বাঁচাতে হাতে তুলে নিয়েছেন অস্ত্র।

রানা এর মধ্যে হুট করে বলে ফেলল, ‘সাঈদ ভাই তো পাহাড়ী বিয়ে করতে চায়। পাহাড়ে থেকে যেতে চায়। সে বনবিবি খুঁজতেছে।’

শুনে ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে আনুচিং মৃদু ধমক দিল ‘শাট আপ’। তারপর আমাদের দিকে ফিরে বলল, ‘এসব রোমান্টিসিজম এক-দুই দিন থাকে। তারপর হারিয়ে যায়। আপনাদের মতো শহুরে দুলাল আর যাই হোক পাহাড়ে থাকতে পারবে না।’

ব্যাগে আর জল অবশিষ্ট নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ। আনুচিংয়ের কাছে চাইতেই সে একজনকে নির্দেশ দিল জল দিতে। বড় অ্যালুমিনিয়ামের জগে ভরা ঝিরির জলের পুরোটাই চারজনে সাবাড় করে দিলাম। আনুচিং একদিকে আঙুল নির্দেশ করে বলল, ‘ওদিকে বাথরুম আছে। আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিন। তারপর খাবেন। মুরগির মাংস রান্না করা হয়েছে।’

মুরগির মাংসের কথা শুনে রনি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। বেচারা সেই থানচি থেকে একটু পর পর বলে আসছে মুরগির মাংস খাওয়ার কথা। তার সেই আশা যে এভাবে পূরণ হতে যাচ্ছে সেটাই বা কে জানত? রনি ভাই, সাঈদ আর রানাও বুঝতে পেরেছে ঘটনা। তাদের মুখেও হাসি খেলে গেল। হাত মুখ ধুতে গিয়ে আবারও প্রযুক্তির খোঁজ পেলাম। পানি তুলতে বসানো হয়েছে মোটর, যেটা চালানো হয় একটি জেনারেটরের মাধ্যমে। পাইপের মাধ্যমে পাহাড়ের নিচে থাকা কোনো উৎস থেকে পানি তুলে আনা হয়। একে একে চারজনই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। মনে হচ্ছে, কপালে যাই থাকুক না কেন, একটু খাবার প্রয়োজন। আনুচিং তার দলের লোকজনের সঙ্গে গল্প করছিল। আমাদের দেখে বলল, ‘রেডি’? আমরা সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই সে বলল, ‘চলুন’।

নিভু নিভু মশালের আবছা আলোয় আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। আনুচিং সামনে চলছে। আমাদের পেছনে অস্ত্র হতে কয়েকজন। এতক্ষণ অন্ধকারে তেমন বোঝা না গেলেও এখন দেখছি বেশ বড় একটা পাড়া। অনেকেই ঘরের দাওয়ায় বসে গল্পগুজব করছেন। কাঠের তৈরি অনেকগুলো ঘর বাড়ি। কোনো কোনোটা দোতলা। তেমনই একটা দোতলা বাড়ি কেমন যেন কাঁপছিল। ভেতর থেকে ভেসে আসছিল নারী কণ্ঠের শীৎকার। অনেক্ষণ ধরেই গাইড জ্যাকব আর লাল চুড়ি পরা মেয়েটিকে কোথাও দেখছি না। সাঈদ আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসল। ওর ভয় কেটে গেছে দেখে ভালোই লাগছে। আনুচিং কোনো কিছু ভ্রুক্ষেপ না করেই এগিয়ে চলল, সঙ্গে আমরাও। উঁচু নিচু সরু পথ বেয়ে দু-তিন মিনিটের এই যাত্রা শেষ হলো একটি মাটির ঘরের সামনে। আনুচিং আমাদের বসতে বলে কাউকে নির্দেশ দিল নিজেদের ভাষায়। মশাল নিয়ে অস্ত্রধারীরা চলে গেল। আমরা ঘরের মেঝেতে বিছানো শীতল পাটিতে বসলাম। কেরোসিনের কুপিবাতি জ্বলছে। শীঘ্রই নাকে এলো খাবারের ঘ্রাণ। ক্ষুধাটা যেন দশগুণ বেড়ে গেল। দুজন নারী এসে আমাদের খাবার পরিবেশন করলেন। পাহাড়ি মোটা চালের ভাতের সঙ্গে মুরগির মাংস। জিভে জল চলে এলো। বিপদের কথা ভুলে হালুম হুলুম করে খাচ্ছি আমরা। সাঈদ সাধারণত পাখির আহার করে, সেও এখন জোরেশোরে খেয়ে যাচ্ছে।

ঘরের বাইরে একটা মোড়ার ওপর বসে আমাদের খাওয়া দেখছে আনুচিং। কুপির আলোয় তার মুখটা রাজরাণীর মতো লাগছিল। একজন যোদ্ধার ভয়ংকর সুন্দর রূপ দেখতে মুখে খাবার নিয়ে এক পলক তাকিয়েছিলাম তার দিকে। বিষয়টি বুঝতে পেরে মুখে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে আনুচিং বলে বসল, ‘মনোযোগটা খাবারে দিলে ভালো হয়।’

তার এমন গা জ্বালা ধরা মন্তব্যে রাগ হলেও সামলে নিলাম। তারা আমাদের কী উদ্দেশ্যে ধরে এনেছে এখনও জানি না। তবে এই দলনেত্রী সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে। আনুচিং জানতে চাইল- ’কেমন হয়েছে রান্না’? রানা এক কথায় বলে দিল, জীবনে সে এত সুন্দর রান্না খায়নি। তবে রনি ভাই বেশ আয়োজন করেই জবাবটা দিল। মুখে ‘অসাধারণ’ বলার সঙ্গে শরীরী ভাষাতেও ফুটিয়ে তুলল তার তৃপ্তির কথা। সেইসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাদের রেখে বসে পড়াটা উচিত হয়নি। আসলে খুব ক্ষুধা লাগছিল। আপনারা খাবেন না’?

আনুচিং সেই আগের মতোই মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘বেশি ভদ্রতা দেখাতে হবে না। খাওয়া শেষ করেন দ্রুত। আপনাদের জন্য একটা গিফট আছে। খাওয়ার আগে সেই গিফট দিলে খেতে পারতেন না।’

আমাদের খাওয়া তখন প্রায় শেষের পথে। আনুচিংয়ের এমন কথা শুনে খাওয়া যেন আর শেষ হচ্ছিল না। ভাত-মাংস গলা দিয়ে নিচে নামছিল না। তাহলে খাওয়ার পরেই কি…..? রানা ফিসফিস করে বলল, ‘মনে হইতেছে শেষ খাওয়া’।

আনুচিং সাথে সাথে বলল, ‘এই পিচ্চি কী বললি তুই? বল, আবার বল’।

আমি বিষয়টা ম্যানেজ করার চেষ্টায় হাসতে হাসতে বললাম, ‘আপনার কথায় মনে হচ্ছে ফাঁসির আগে শেষ খাওয়া খাচ্ছি! খাওয়ার পর কি আমাদের ফাঁসি দেবেন নাকি গুলি করবেন?’

আনুচিং মুখ শক্ত করে বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার কথামতো চললে বাড়ি ফিরে বাকি জীবন ভাত খেয়ে কাটাতে পারবেন। আর না শুনলে এটাই শেষ খাওয়া।’

রনি ভাই হাত ধুতে ধুতে বলল, ‘ঘটনা যেটাই হোক, দেখব চলুন। এই মানসিক চাপ আর নিতে পারছি না। মরতে হলে মরব। নো প্রবলেম। চলুন কোথায় যেতে হবে?’

আনুচিং কয়েক মুহূর্ত কটমট করে রনি ভাইয়ের দিকে তাকাল, তারপর বলল, ‘ফলো মি। তবে আপনাদের এই বাচ্চা ছেলেটাকে রেখে যান। ওকে আমি আপনাদের থাকার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি’।

রানাকে একজনের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আমরা শুরু করলাম হাঁটা। তিন-চার মিনিট হাঁটতেই কানে এল গোঙানির আওয়াজ। যতই এগোচ্ছি আওয়াজটা বাড়ছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণাগ্রস্ত কোনো পুরুষ এভাবে গোঙাচ্ছে। সেই ঘরটির সামনে গিয়ে আনুচিং কিছু বলতেই দুজন ঢুকে গেল ঘরের ভেতরে। সাথে সাথেই যেন গোঙানি পরিণত হলো চিৎকারে। আনুচিংকে অনুসরণ করে আমরা পাহাড় থেকে নিচে নামছি। পেটে খাবার পড়ায় বেশ শক্তি পাচ্ছি, কিন্তু শরীর ভীষণ ক্লান্ত। না গিয়েও উপায় নেই। আনুচিংয়ের নির্দেশ মানতেই হবে। আবারও ঝোপঝাড় পেরিয়ে এগোতে হচ্ছে। কোনদিকে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ নিচে নামার পর ছোট্ট একটা সমতল জায়গায় পৌঁছলাম। যদিও সেটা পাহাড় থেকে অনেক ওপরে। হাঁফ ছাড়ার সাথে সাথেই ওপর থেকে শব্দ। কাউকে যেন টেনে হিঁচড়ে নামানো হচ্ছে। ভেসে আসছে গোঙানি। মশালের আলোয় দেখা গেল, মাঝবয়সী এক ব্যক্তিকে অনেকটা টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনছে দুজন অস্ত্রধারী। কাছে আসতেই দেখা গেল লোকটি বাঙালি। সমতলে এসে অস্ত্রধারিরা তাকে ছুড়ে ফেলে দিল আনুচিংয়ের পায়ের কাছে।

আনুচিং নির্দেশ করল লোকটাকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলতে। যদিও লোকটার যে অবস্থা, তাতে না বাঁধলেও চলত। নড়াচড়ার ক্ষমতাও নেই। বোঝাই যাচ্ছে, তাকে বেদম মারধর করা হয়েছে। চোখের পলকে লোকটাকে বেঁধে ফেলা হলো গাছের সঙ্গে। আমরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। লোকটা বহু কষ্টে আনুচিংয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বর বের হলো না। আনুচিং অত্যন্ত শান্তভাবে এগিয়ে গেল তার দিকে। লোকটার চুলের মুঠি ধরে ঘাড় কাত করে দিল পেছনের দিকে। মশালের আলোয় রূপবতী আনুচিংয়ের চেহারায় প্রচণ্ড ক্রোধ ফুটে উঠেছে। অগ্নিদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে চোখের পলকে কোমর থেকে ভোজালি বের করে লোকটার গলায় বসিয়ে দিল! আমরা আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠলাম- ‘এটা কী করছেন? কী করছেন এটা?’

অস্ত্রধারী দুজন আমাদের দিকে তেড়ে এলো। নির্দেশ দিল চুপ থাকার। আমরা চুপসে গেলাম। রনি ভাই মাটিতে বসে পড়েছে। আমার গা ঘামছে। আনুচিং একটু একটু করে ভোজালি বসিয়ে দিচ্ছে লোকটার গলায়। হাড় আর মাংস কাটার কড়কড় আওয়াজ হচ্ছে। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে গলা থেকে। জামা-কাপড় ভিজে যাচ্ছে রক্তে। লোকটার শ্বাসনালীতে রক্ত ঢুকে গিয়ে অদ্ভুত ধরনের গোঙানি বের হচ্ছিল। একসময় সেটাও বন্ধ হয়ে গেল! সাঈদ এই দৃশ্য দেখে সইতে পারেনি। বমি করতে করতে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল!  আমার শরীর প্রচণ্ড ঘামছে। রনি ভাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল সাঈদকে সামলাতে। আনুচিং আমার দিকে তাকিয়ে হিংস্র একটা হাসি দিল। তার ফর্সা মুখের ওপর রক্তের ছিটা পড়ায় দেখতে ভয়ংকর লাগছিল। হাতে তখনও ধরা আছে রক্তাক্ত ভোজালি। ওকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘এটা কী করলেন? কেন করলেন’?

আনুচিং চোখমুখ কঠিন করে বলল, ‘প্রশ্ন নয়। আগেই বলেছি, এখন কোনো প্রশ্ন নয়। এবার গিয়ে ঘুমান। আপনাদের জন্য বিছানা প্রস্তুত করা আছে।’

রনি ভাই যেন মরিয়া হয়েই জিজ্ঞেস করে বসল, ‘আমাদের মারবেন না?’

জবাব এলো, ‘ইয়ার্কি করবেন না। যেটা বলেছি সেটা করুন।’

রনি ভাই ক্ষেপে গেছে। গলা চড়িয়ে বলল, ‘আমি ইয়ার্কি করছি না। এখন পর্যন্ত যেসব কাজ করছেন আমাদের সঙ্গে, তার চেয়ে মেরে ফেলা ভালো। এভাবে টর্চার করছেন কেন? আপনাদের কী ক্ষতি করেছি?’

আনুচিং দুই অস্ত্রধারীকে আদেশ করল, ‘এদেরকে নিয়ে ওপরে যাও। যেটা মাটিতে শুয়ে পড়েছে, ওটাকে তোলার ব্যবস্থা কর।’

এটুকু বলেই আনুচিং পাহাড়ে উঠতে শুরু করল। দুই অস্ত্রধারীর সহায়তায় সাঈদকে টেনে তুলে আমরাও ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম পাহাড়ে। বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিতেই ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো। কিন্তু ঘুম এলো না সহজে। চোখের সামনে ভাসতে লাগল ওই লোকটার কাটা গলা থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসার দৃশ্য!

ফাল্গুন মাসের রৌদ্রজ্জ্বল এক দুপুর। পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। জুম চাষের জন্য এভাবেই পাহাড়ের ঢালে বন-জঙ্গল পরিষ্কার করেন চাষীরা। বৈশাখে বৃষ্টি এলেই সেই পাহাড়ের ঢালে শুরু হয় জুম চাষ। ধান, তুলা, তিল, তিসি, কাউন, ভুট্টা, ফুটি, চিনার, যব, হলুদ, আদা ইত্যাদি ফসলের বীজ রোপন করা হয়। নুসাই মারমা সদ্যই বাড়িতে এসেছেন সবার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে যেতে। এমন সময় কয়েকজন স্যুট টাই পরা হোমরা চোমড়া বাবু এলেন পাহাড়ে। সঙ্গে দুজন পুলিশও আছে। তারা পাহাড়ে জমি চায় রিসোর্ট বানানোর জন্য। ইদানিং দেশ-বিদেশ থেকে অনেক পর্যটক আসছেন সেই পাহাড়ের নিচে। তাদের থাকা খাওয়ার জন্য রিসোর্ট বানানো হবে। সরকারি অনুমতি পাওয়া গেছে। মোটা অংকের ঘুষ দিতে হয়েছে মন্ত্রীমশাইকে। সেই ঘুষের টাকা নিয়ে অবশ্য বাবুরা চিন্তিত না। রিসোর্ট বানাতে পারলে পর্যটকদের গলা কেটে বছর ঘুরতেই লাভের মুখ দেখা যাবে। পর্যটকেরা এসি রুমে বসে জানালা দিয়ে পাহাড় দেখবে আর ফেসবুকে ছবি আপলোড করবে। সমস্যা হলো, এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর জন্য সরকার এসব এলাকায় অতি সতর্কতা জারি রাখে সবসময়। তবে রিসোর্ট একবার বানাতে পারলে মন্ত্রীমশাইকে ধরে মোবাইল নেটওয়ার্কের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এতে সাহেব পর্যটক পাওয়া সহজ হয়ে যাবে। রিসোর্টের জন্য যে স্থানটা তাদের পছন্দ হয়েছে, সেটা পাহাড়ের ওপর আদিবাসীদের ছোট্ট একটা পাড়া। পাহাড়টি খুব বড় নয়, তার ওপর রিসোর্ট বানালে চারদিকেই সুন্দর ভিউ পাওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো, আদিবাসীরা তাদের গ্রাম ছেড়ে যেতে রাজি নয়। বাসযোগ্য জমি এমনকী টাকার লোভ দেখিয়েও তাদের গ্রামছাড়া করা যাচ্ছে না। এ কারণেই ওদের ভয় দেখাতে সাহেব আজ পুলিশ নিয়ে এসেছেন। পুলিশেও কাজ না হলে অন্য পথ ধরতে হবে।

নুসাই তাদের কথা বোঝে না। সে উঁচু গলায় কয়েকজনের নাম ধরে ডাক দেয়। অল্প সময়ের মাঝেই আরও কয়েকজন চলে আসে। কিন্তু তারাও বাংলা বুঝতে পারছিল না। তখন একজন পুলিশ ভাঙা ভাঙা আরাকানি ভাষায় ওদের বোঝাতে থাকে, এখানে রিসোর্ট হলে অনেক লোকজন আসবে। এলাকার উন্নতি হবে। সবার পকেটে তখন অনেক টাকা থাকবে। আদিবাসীদের জন্য পাশের পাহাড়েই ঘর বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে। জমি দেওয়ার বিনিময়ে তাদেরকে টাকাও দেওয়া হবে। তাদের সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু প্রকৃতির সন্তানেরা চায় না তাদের এই শান্তির পাহাড়ে অশান্তির আনাগোনা শুরু হোক। তাছাড়া নিজেদের ভিটা তারা কেন ছেড়ে দেবে সাহেবদের জন্য? লম্বা সময় ধরে মিটিং চলে, কোনো সুরাহা হয় না। সাহেবের দল রেগেমেগে চলে যায়। হুমকি দিয়ে যায়, দেখে নেওয়ার। নুসাই তার ছোট ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরে বুকের মাঝে। তার ১০ বছর বয়সী মেয়েটাও এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। ওর ছোট্ট মুখটা মলিন হয়ে গেছে সাহেবদের হুমকি-ধামকিতে। ইতোমধ্যেই হেড ম্যান বা গ্রাম প্রধান চলে এসেছেন। সবাই মিলে পরামর্শ সভা চলছে। গ্রামের নারীরাও অংশ নিয়েছেন সেই পরামর্শ সভায়। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই পাহাড়ে সেটেলারদের নির্যাতন নিপীড়ন চলে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বেড়েই চলছে। দখল হচ্ছে জমি-জমা, জোর করে চলছে ধর্মান্তর। এবারও কি তেমনই কিছু হবে?

গ্রামের মানুষের দিন কাটতে থাকে নানা শংকায়। যুবকরা আশু আক্রমণ প্রতিরোধে তীর-ধনুক, লাঠি, বল্লম তৈরিতে মনযোগ দেয়। থমথমে পরিস্থিতর মাঝে হঠাৎ চলে আসে যুদ্ধের দিন। পড়ন্ত বিকেলে মুখে কাপড় বেঁধে একদল বাঙালি হামলা চালায় নুসাইদের গ্রামে। তাদের হাতে থাকা আধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে পাহাড়ীদের প্রতিরোধ দ্রুতই ভেঙে পড়ে। আবার জ্বলে ওঠে পাহাড়। পেট্রল ঢেলে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় ওরা। দূর থেকে দেখে লোকে ভাবে, জুম চাষের জন্য জমি প্রস্তুতের কাজ চলছে। কতজনের গুলিবিদ্ধ লাশ পাহাড়ের খাদে পড়ে থাকে, তার খোঁজ কেউ পায় না। শুধু জমি দখল নয়, সন্ত্রাসীদের নজর পড়ে আদিবাসী নারীদের ওপর। নুসাই, কিংবা তার দশ বছরের মেয়ে- কেউ রেহাই পায় না! মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় একটি ঝোপের পাশে। তারপর একদল হায়েনা ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। পাশবিক নির্যাতন শেষে অর্ধমৃত মেয়েটিকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয় পাহাড়ের নিচে। ঝোপ ঝাড় লতাপাতায় আটকে ছোট্ট মেয়েটি প্রাণে বেঁচে যায়। রাত গভীর হলে হায়নাদের তাণ্ডব থামে। বাড়ি-ঘর সব পুড়িয়ে নিভে যায় আগুন। এ খবর সংবাদমাধ্যমে আসে না। যারা জানে, তারাও চেপে যায়। 

পরদিন সকাল হয়। ভোরের আলো ফোটে। পাহাড় চূড়ায় ছাইচাপা আগুন থেকে তখনো ধোঁয়া বের হচ্ছিল। আশেপাশের গ্রাম থেকে অনেক আদিবাসীরা ছুটে এসেছে। কেউ মাতম করছে, কেউ করছে লাশগুলোর সৎকারের ব্যবস্থা। যিনি এই হৃদয়বিদারক কর্মযজ্ঞের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তার নাম মাইকেল। মাঝবয়সী মানুষটি ছলছল চোখে ছুটে বেড়াচ্ছেন এপাশ থেকে ওপাশ। একটি ঝোপের পাশে আসতেই হঠাৎ তার কানে আসে গোঙানির আওয়াজ। রক্তাক্ত মেয়েটির গায়ে কাপড় জড়িয়ে দেয় মাইকেল। তারপর তুলে নেয় কাঁধে। মাইকেল থাকে বান্দরবান শহরে। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি ট্যুরিস্ট গাইডের কাজও করে। সে প্রথমে মেয়েটিকে কয়েকজন বিশ্বস্ত লোক দিয়ে হাসপাতালে পাঠায়। এরপর মেয়েটির বাবা-মায়ের খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারে, দুজনেই সে রাতে সেটেলারদের আক্রমণে মারা যান। ছোট্ট ভাইটির খোঁজ কেউ দিতে পারেনি। একদিন হাসপাতাল থেকে মেয়েটি ছুটি পায়। যেতে চায় বাড়িতে, বাবা-মায়ের কাছে। মাইকেল ও তার স্ত্রী একদিন কঠিন সত্যটা তাকে জানিয়ে দেন। একইসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেন, ওকে লালন পালন করে বড় করার। মেয়েটির নাম আনুচিং। একরাশ বিষন্নতা নিয়ে মাইকেলের বাড়িতে তার নতুন জীবন শুরু হয়। মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে সেই ভয়াল রাতের কথা। আতঙ্কে সে প্রায়ই ঘুমের মাঝে কেঁদে ওঠে। মাইকেলের স্ত্রী তাকে পরম যত্নে আগলে রাখেন। একটু স্বাভাবিক হলে তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে থাকে আনুচিং। তবে ছোট ভাইটির কথা সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। বাইরে ছোট কোনো বাচ্চা দেখলেই তাকিয়ে থাকে, চোখ বেয়ে নামে অশ্রু। বাকি দিনটা কারও সঙ্গে কথা বলে না, কিছু খায় না। ঘরের এক কোণে সঁপে দেয় নিজেকে।  অবশ্য খুব দ্রুতই তার ভাইয়ের অভাবও পূরণ হয়ে যায়। মাইকেলের ছেলে জ্যাকব হয়ে ওঠে আনুচিংয়ের খেলার সাথী।

সকালের রোদে বসে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে আনুচিংয়ের কাছে শুনছিলাম সেই ভয়াল সেই রাত্রির গল্প। যদিও চায়ের কাপে দু-তিনবারের বেশি চুমুক দেওয়া হয়নি। আমাদের সামনে পাহাড়ী কলা আর কিছু রুটিও রাখা আছে। একটা-দুটোর বেশি কেউ খায়নি। সবাই হতবাক হয়ে শুনছিলাম, স্বাধীন দেশে একটি জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে কত বড় অন্যায় হয়েছিল! আনুচিংয়ের পাশে বসে আছে জ্যাকব। তার পাশে আগের রাতের সেই লাল চুড়ি পরা মেয়েটি বসে ধুমপান করছিল, যার নাম অংম্রাচিং। খুবই কম কথা বলে।  প্রয়োজন ছাড়া সম্ভবত সে কথাই বলে না। সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে আছে। কয়েক বছর আগে অংম্রাচিংকেও তুলে নিয়ে গিয়েছিল একদল হায়েনা। বিধ্বস্ত হয়ে ফেরার পর সমাজে সে আশ্রয় পায়নি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। আনুচিং তাকে পথের ধারে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় খুঁজে পায়। একপর্যায়ে অংম্রাচিং হয়ে ওঠেন দলের অন্যতম যোদ্ধা। আমাদের নদীর পাড় থেকে ধরে আনার দায়িত্ব ছিল তার কাঁধেই। আনুচিং যুদ্ধের পাঠ নিয়েছিলেন তার পালক পিতা মাইকেলের থেকে। পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি মাইকেল তাকে শিখিয়েছিলেন অস্ত্র চালনা। অসীম সাহস আর অসাধারণ নেতৃত্বগুণের জন্য মাইকেলের অবর্তমানে আনুচিংকে দলনেতা হিসেবে মেনে নেয় সবাই। 

আনুচিং বলছিল, তারা ভিন্ন কোনো জাতিগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর কাজ করে না। তারা শুধু তাদেরকেই শাস্তি দেয়, যারা ভয়ানক সব অন্যায় করেছিল আদিবাসীদের সঙ্গে। তাদের আশা, একদিন পাহাড়ে বন্ধ হবে নির্যাতন নিপীড়ন। বন্ধ হবে হত্যা, লুটপাট, জমি দখল, ধর্মান্তর, প্রকৃতি ধ্বংস। আনুচিংরা অস্ত্র ফেলে ফিরে যাবে স্বাভাবিক জীবনে। নিজেদের জীবন ও সম্পদ বাঁচাতেই তারা বাধ্য হয়ে হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। তাই আনুচিংরা আজ তথাকথিত সভ্য জগতে পরিচিত হয় ‘সন্ত্রাসী’ কিংবা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ নামে। তাদেরকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশও দেওয়া আছে।

ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের কথা বলতে গিয়ে আনুচিংয়ের চোখদুটো চকচক করে ওঠে। ওর দিকে তাকিয়ে ভাবি, মেয়েটা সুশিক্ষিত। সে চাইলেই অতীত ভুলে নিরিবিলি স্বচ্ছন্দ্যের জীবন কাটাতে পারত। সেটা সে করেনি। বেছে নিয়েছে বন্ধুর পথ, যে পথের প্রতি পদক্ষেপে বিপদ ওঁৎ পেতে থাকে। এই পৃথিবীতে এখনো সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে না। কেউ কেউ ভাবে অন্যের কথাও। সবাইকে নিয়ে তারা সুখী থাকতে চায়। অন্যের অধিকারের জন্য জীবনও দিতে পারে। আনুচিং তাদেরই একজন।

রানা বেশ খোশ মেজাজে আছে। আমাদের সঙ্গে যা যা ঘটে চলেছে, সেসব তাকে স্পর্শ করছে না। ছোট হওয়ায় ওদের থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। শুধু একটু বন্দি হয়ে আছে এই যা। আমাদের গল্পে তার খুব একটা মনোযোগ ছিল বলে মনে হয়নি। সে নিজের মতো এদিক ওদিক ঘুরছে। কোন ফাঁকে যেন সিগারেটের মধ্যে গাঁজা ভরে ফেলেছে। কারও থেকে ম্যাচ চেয়ে নিয়ে সেটায় আগুন দিতেই আনুচিং ওর দিকে তাকাল। তারপর হেসে বলল, ‘তুই তো বেশ সেয়ানা। তোকে আরও বাচ্চা ভেবে ছাড় দিচ্ছি!’

আমরা হেসে উঠলাম। সাঈদের মুখেও দিনের প্রথম হাসি দেখতে পেলাম। গতকালের ওই বীভৎস দৃশ্য দেখে বমি করে সে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। রাতে প্রলাপও বকেছে। ওর স্বাভাবিক হওয়াটা জরুরি ছিল। এই সুযোগে আনুচিংকে  জিজ্ঞেস করি, ‘এবার বলুন তো কাল ওই লোকটাকে কেন মারলেন? আমাদেরকেই বা কেন ধরে এনেছেন?’

আনুচিং এবার রানাকে সরিয়ে দিল। তারপর গম্ভীর মুখ করে বলল, ‘ওই লোকটা ছিল রিসোর্ট কাণ্ডের হোতা। আমার ওপর যারা নির্যাতন করেছিল, আমার পালক পিতা তাদের শেষ করেছেন। এই লোকটা বেশ ক্ষমতাবান হওয়ায় এতদিন কিছু করা যায়নি। কিন্তু সব ক্ষমতারই একদিন শেষ আছে।’

এটুকু বলে থামল আনুচিং। ওর থেকে আরও জানতে পারলাম, তাদের গ্রামটি পুড়িয়ে দেওয়ার পর সেখানে রিসোর্ট নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এই পাহাড় থেকে একটু দূরেই সেই রিসোর্ট। মাইকেল তখন থেকেই সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। আনুচিংয়ের থেকে সব শুনে সে প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একদিন মাইকেলের দল সশস্ত্র হামলা চালায় সেই রিসোর্টে। সাহেবরা তখন মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ছিল। তাদের ধরে ফেলা সহজ হয়। বেদম পিটুনির মুখে তারা অপরাধ স্বীকার করে। মাইকেল তাদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। সেদিন ৬ জনকে মেরেছিল মাইকেলরা। পত্রিকায় খবর বেরোয় ‘চাঁদা না পেয়ে পাহাড়ে বাঙালি হত্যা’।

এর প্রতিক্রিয়াও আসে খুব দ্রুতই। পাহাড় ছেয়ে যায় জলাপাই রঙে। ঝরে যায় কত প্রাণ। মাইকেল প্রাণে বেঁচে গেলেও মৃত্যুবরণ করে তার দলের কয়েকজন। বছর না ঘুরতেই কড়া পাহারায় আবারও সেই রিসোর্ট নির্মাণ শুরু হয়। একসময় পর্যটকে ভরে ওঠে সেই রিসোর্ট। রঙিন পানীয়তে ভরে ওঠে স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাস। কত হাসি, আনন্দ আর উপভোগের মন্ত্র শোনা যায় প্রতিদিন। তারা জানতে পারে না, কত মানুষের লাশের ওপর নির্মিত সেই রিসোর্টে বসেই তারা উদ্দাম আনন্দে মেতেছে। পাহাড়ে এসেও তারা শুনতে পায় না পাহাড়ের কান্না।

দুই বছর আগে রোগে ভূগে মারা যায় মাইকেল। মৃত্যুর আগে ছেলে জ্যাকব এবং আনুচিংকে সেই লোকটির খোঁজ দিয়ে যায়। আনুচিংরা লোকটিকে ধরেছিল দিন তিনেক আগে। দলের এক নারী সদস্যের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদ পেতে সেই বুড়োকে তারা পাকড়াও করে। সঙ্গে সঙ্গেই মেরে ফেলার কথা ছিল, কিন্তু বাদ সাধে জ্যাকব। সে খবর পাঠায়, তিনজন সাংবাদিক আসছেন ঢাকা থেকে। তাদের সামনেই শাস্তি কার্যকর করা হোক। যাতে অন্তত বাইরের কেউ চাক্ষুষ জানতে পারে, পাহাড়ে আসলে কী হচ্ছে। কেনইবা আনুচিংদের হাতে অস্ত্র উঠে এসেছে। কেনইবা তাদেরকে সন্ত্রাসী কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে আসল ঘটনা আড়াল করা হচ্ছে!

নিতান্তই সহজ-সরল চিন্তা। আমরা সাংবাদিক বটে, কিন্তু ক্রাইমের সঙ্গে সংযোগ নেই। আর যদি ক্রাইম রিপোর্টারও হতাম, তাহলেও যে আনুচিংদের গল্প লিখতে পারতাম- তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। আনুচিংরাও সেটা খুব ভালোভাবেই জানে। তবে আমরা স্পোর্টস রিপোর্টার শুনে সে বেশ হতাশ হয়েছে। নিশ্চিত হতে আইডি কার্ডও দেখেছে। বাকিটা ছেড়ে দিয়েছে আমাদের ওপর। আনুচিংয়ের চোখেমুখে হতাশা। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে তার মুখে এসে পড়া সূর্যের আলোয় হতাশাগুলো আরও মূর্ত হয়ে উঠছে। একজন যোদ্ধাকে এমন হতাশায় নিমজ্জিত হতে দেখে বললাম- ‘আপনার গল্প আমি লিখব, সেটা পত্রিকায় হোক কিংবা বইয়ের পাতায়। আপনি চাইলে বিশ্বাস করতেও পারেন আবার নাও করতে পারেন, তবে আমি লিখব।’

আনুচিং তার গম্ভীরতা নিয়েই বলল, ‘এতটাও আশা করছি না। যদি সত্যিই লিখেন, তবে সেটাকে উপহার হিসেবে ধরে নেব। মাঝে মধ্যে উপহার পাওয়াটা মন্দ নয়।’

আমি হেসে বললাম, ‘তাহলে আরেকটা প্রশ্ন করি?’

আনুচিং জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। আমি বলে চললাম, ‘ধরে নিন আমরা ক্রাইম রিপোর্টার। তবু কেন মনে হলো, আমরা আপনার কাজটা করে দেব?’

এবার মিষ্টি হাসি হেসে আনুচিং জবাব দিল, ‘সোশ্যাল মিডিয়া ঘেটে জ্যাকব দাদা আপনাদের সম্পর্কে জেনেছে। পরিকল্পনাটা মূলত ওরই। আপনারা পাহাড় ভালোবাসেন, পাহাড়ীদের নিয়ে লেখালেখি করেন। তাই আপনাদের ওপর সে আস্থা রেখেছে। আপনারা কোন বিষয়ের সাংবাদিক, সেটাকে সে গুরুত্ব দেয়নি।’

জ্যাকব মনে হলো একটু লজ্জা পেয়েছে। দুপুরের খাবার আয়োজনের কথা বলে সে উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার আগে বলে গেল, নিরাপত্তাজনিত কারণে সন্ধ্যার আগে আমরা এখান থেকে বেরোতে পারব না। তাই বাকি দিনটা অলস কাটানো ছাড়া উপায় নেই। আনুচিংকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘লাশটি কোথায়?’ সে জবাব দেয়, ‘নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে’।

তাকে আবার বলি, ‘লাশটি ওদের হাতে পড়লে আপনারা ধরা পড়বেন তো!’ 

আনুচিং হো হো করে হাসতে হাসতে বলে, ‘সেটাই তো চাই। ওরা দেখুক, আমরা কতটা নিষ্ঠুর হতে পারি। ওরা ভয় পাক আমাদের।’

আমরা একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। মনে নতুন আশংকার জন্ম হলো। কেবল দুপুর হচ্ছে। আমাদের এখন থেকে ছাড়া পেতে আরও অনেক দেরি। এর মাঝেই যদি সৈন্যরা খবর পেয়ে হামলা করে বসে, আমর তো মহাবিপদে পড়ে যাব! সবচেয়ে বড় বিপদ হবে রানাকে নিয়ে। এই ছেলেটা আমাদের দলের কেউ না। ওর কিছু হয়ে গেলে ওর পরিবারকে আমরা কী জবাব দেব! নিজেদের নির্বুদ্ধিতার জন্য রাগ হচ্ছিল। স্রেফ আবেগের বশে কেন রানাকে আনতে গেলাম!  সাঈদ বেশ গদগদ হয়ে আনুচিংকে অনুরোধ করতে থাকে, আমাদের চোখ বেঁধে হলেও এখনই যেতে দেওয়া হোক। 

আনুচিং প্রাণখোলা হাসি হেসে বলে, ‘আপনি না পাহাড়ে থেকে যেতে চেয়েছিলেন? এই সামান্য ঘটনায় ভয় পেয়ে গেলেন! বলেছিলাম না, পাহাড় নিয়ে রোমান্টিসিজম এক-দুইদিন থাকে। তারপর লেজ গুটাতে হয়। ‘

সাঈদ কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে রনি ভাই প্রস্তাব দিল, আমাদের আটকে রেখে রানাকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে। আনুচিং কঠিন ভাষায় বলল, ‘সেটাও সম্ভব না। আপনাদের একসঙ্গেই যেতে হবে। তার আগে কোনো বিপদ হলে আমরা আপনাদের বাঁচাব। কথা দিলাম।’ কথাটা বলেই আনুচিং উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল। আমরা চেয়ে রইলাম তার চলে যাওয়া পথের দিকে।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ে বাড়ছে গরম। রোদের মাঝেই একদল যোদ্ধা শারীরিক কসরৎ করছে। তাদের প্রশিক্ষক অংম্রাচিং। আমরা গাছের ছায়ায় থাকা পাথরে বসে তাদের প্রশিক্ষণ দেখে সময় কাটাচ্ছি। রনি ভাইয়ের আগ্রহে অংম্রাচিং তার হুঁকোটা আমাদের দিয়েছে। সেটায় টান দিয়েই রনি ভাই কাশতে লাগল। আমার অবস্থাও তাই। সাঈদ এসবে নেই। তবে রানা বেশ আয়েশ করেই হুঁকো টানতে লাগল। এই বয়সেই ও সব ধরনের পাকামো শিখে গেছে। ওর পরিবেশ, প্রতিবেশ আর শিক্ষা ওকে এমন করে তৈরি করছে। দায়টা আসলে কার? হতদরিদ্র রানার? নাকি রাষ্ট্রের? আসলে রাষ্ট্রই বৈষম্য তৈরি করে রেখেছে সর্বত্র। তুমি গরীব, তাই কম শিক্ষা পাবে। তুমি সংখ্যালঘু, তাই নাগরিক সুবিধা কম ভোগ করবে।

দুপুরের খাবারের ডাক এলো। ভাতের সঙ্গে ছিল ডাল, ঝাল মরিচ দিয়ে আলুভর্তা আর ডিমের ঝোল। আনুচিং, অংম্রাচিং আর জ্যাকবও  আমাদের সঙ্গে বসে পড়ল। কয়েকজন বাইরে পাহারা দিচ্ছে। খেতে বসলেও আনুচিংরা বিশেষ কায়দায় বাম হাতে অস্ত্র ধরে রেখেছে। দেখে মনে হচ্ছে, কেউ সামনে এলে তাকে গুলি করতে মুহূর্তও লাগবে না। অজানা আশংকায় ক্ষুধা তৃষ্ণা সব উবে গেছে। কোনোমতে মুখে চালান করে দিচ্ছি খাবারগুলো। আনুচিংরা সাবলীলভাবেই খাচ্ছে। ওরা এমন জীবনে অভ্যস্ত। বিপদকে সঙ্গী করেই ওদের চলতে হয়। তাই দুশ্চিন্তার লেশমাত্র নেই। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা তো প্রত্যেহ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে চলেন। নিজেদের ব্যক্তি জীবনটা কীভাবে দেখেন? পরিবার, সংসার…. স্বজন….’

আমাকে থামিয়ে দিয়ে আনুচিং বলল, ‘সাদা চুলের বুড়ো বিপ্লবী নই যে সারাজীবন আইবুড়ো থেকে যাব। আমাদের পরিবার আছে, প্রিয়জন আছে, শখ-আহ্লাদ আছে। আমাদের গ্রামে পূর্ণিমা রাতে গানের আসর বসে। কেউ বিয়ে করতে চাইলে ঘটা করে বিয়ে দেই। আমরা যেমন জানি, তেমন স্বজনরাও জানে যে কোনো সময় যে কেউ খোয়া যেতে পারে। কিন্তু কিছু করার নেই। এটাই আমাদের জীবন। এখানে সবাই স্বেচ্ছায় এসেছে। কাউকে জোর করে আনা হয়নি। কেউ চাইলে চলেও যেতে পারে। তাকে আমরা আটকাই না।’

আবার প্রশ্ন করলাম, ‘যদি এখান থেকে ফিরে গিয়ে কেউ আপনাদের ধরিয়ে দেয়?’ আনুচিং মুখ শক্ত করে বলল, ‘এমন আশংকা যে নেই তা নয়। আপনারাও তো ফিরে আমাদের ধরিয়ে দিতে পারেন। তবে এজন্য যে সাজা হবে, তার সামান্য নমুনা গত রাতে আপনারা দেখেছেন।’

বললাম, ‘সেটা বুঝতে পেরেছি। ওই বুড়োকে যদি আপনারা তুলে আনতে পারেন, যে কাউকেই পারেন।’

আনুচিং আমার দিকে সোজা তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল, তাকে খোঁচা মেরে কথা বলছি কিনা। সে কিছু বলার আগেই সেদ্ধ ডিমে একটা কামড় বসিয়ে সাঈদ বলল, ‘বুঝলাম যে আপনাদের সাংগঠনিক ভিত্তি খুবই মজবুত। ব্যক্তিজীবনে কড়াকড়ি নেই। তো আপনাদের এই সংগ্রামের ভবিষ্যৎ কী?’ 

আনুচিং এবার ম্লান হেসে বলল, ‘সেটা তো আমরাও জানি না। ভবিষ্যতই বলে দেবে, ভবিষ্যত কী। তবে মানুষ হিসেবে যখন জন্মেছি, তখন জীবনটা অর্থপূর্ণ করতে চাই। তাহলে মৃত্যুটাও অর্থপূর্ণ হবে। কুকুর-বিড়ালের জীবন যাপনের চেয়ে যোদ্ধার অনিশ্চিত জীবন আমার কাছে শ্রেয়। জানি না এ যুদ্ধের শেষ কোথায়। তবে একদিন তো শেষ হবেই। আমাদের দ্রোহ ছড়িয়ে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কোনো একদিন মানুষ বুঝবে, ক্ষমতা, হিংসা, ঘৃণা আর অস্ত্র দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি আনা যায় না। সেদিনই শান্ত হবে পৃথিবী।’

আনুচিংয়ের কথা শেষ হতেই অশান্ত হয়ে উঠল পাহাড়। বাইরে থেকে ছুটে এলো গুলির শব্দ। একজন এসে আনুচিংকে তাদের ভাষায় কিছু বলে গেল। ভাষা বুঝতে না পারলেও এটা নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, আমাদের এখন প্রাণ সংশয়। খুব  সম্ভবত আনুচিংয়ের দলের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। খাওয়া ফেলে ওরা সবাই উঠে দাঁড়াল। আমরাও হাত ধুয়ে ফেললাম। আনুচিং আমদের চারজনের দায়িত্ব দিল জ্যাকবকে। সে যেন আমাদের নিরাপদে পৌঁছে দেয়। বেরিয়ে যেতে যেতে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বেস্ট অব লাক’। ওকে হাত নেড়ে বিদায় জানালাম। অস্ত্র হাতে বেরিয়ে পড়ল আনুচিং বাহিনী। আনুচিংয়ের সঙ্গে সেটাই আমাদের শেষ দেখা। বাইর থেকে প্রবল গোলাগুলির শব্দ আসছে। বের হওয়ার আগে আমাদের উদ্দেশ্যে ছোট্ট  একটা বক্তৃতা দিল জ্যাকব। তার বক্তব্যটা এরকম- 

‘আমি সবার আগে থাকব। আমার আগে কেউ যাবেন না। এখান থেকে বেরিয়ে আমরা সোজা হেঁটে নদীর তীরে পৌঁছব। এর আগে আমি যদি গুলি খাই, যদি যেতে না পারি, আপনারা যেভাবেই হোক সোজা এগোবেন। তাহলেই নদীর ধারে পৌঁছে যাবেন। তারপর নদীর তীর ধরে বামদিক দিয়ে হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন রেমাক্রি। সেখানে আমাদের নৌকা আছে। মাঝি আপনাদের রাতেই থানচি পৌঁছে দেবে। সে আপনাদের থাকার ব্যবস্থাও করবে। পরদিন সকালে আপনারা ঢাকায় চলে যাবেন। আপনাদের জন্য বান্দরবান পর্যন্ত চাঁদের গাড়ির ব্যবস্থা করা আছে।’

কথা শেষ করে জ্যাকব রানার হাতে একটা পুটলি ধরিয়ে দিল, যাতে আছে আমাদের মুঠোফোন, ঘড়ি, টর্চ ইত্যাদি। এরপর ঘরের পেছনের দিকে একটি দরজা খুলে উঁকি দিয়ে জ্যাকব আমাদের ইঙ্গিত করল বেরিয়ে পড়ার।  দুরু দুরু বক্ষে তাকে অনুসরণ করলাম। গোলাগুলির শব্দে জ্যাকব বুঝে গেছে আমাদের কোনদিক দিয়ে বের হওয়া নিরাপদ হবে। রানাকে আমাদের মাঝখানে রেখেছি। ওকে নিয়েই যত দুশ্চিন্তা। নিজেদের প্রাণের ভয় তো আছেই। জ্যকব অতি সতর্কতার সঙ্গে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। কখনো থামতে বলছে, আবার কখনো তাড়াতাড়ি। আমরা পাহাড় থেকে নামছি। রাতে বোঝা না গেলেও এখন স্পষ্ট একটা পায়ে চলার পথ দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের ওপর থেকে আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। বুকটা হু হু করে উঠছে। না জানি কার গায়ে গুলি লাগল! মাত্র একদিনের পরিচয়ে সশস্ত্র মানুষগুলোকে এখন খুব আপন মনে হচ্ছে। আমাদের সঙ্গে যে ভয়ংকর ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং ঘটে চলছে, তাতে এমন অনুভূতি হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমাদের ভেতরের মানুষটা ওদের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠেছে, যা সত্যিকারের অনুভূতি। ওরা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়ছে। সঠিক বিচার না পেয়ে হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। অত্যাচারীদের শাস্তি দিচ্ছে নিজেরাই। মনে পড়ছে আপনজনদের কথা। ঢাকার বাসার বারান্দায় নিত্য খাবার খেতে আসা চড়ুই পাখিগুলোর কথা মনে পড়ছে। জানি না, আমরা রেমাক্রি পৌঁছতে পারব কিনা। 

ভাবনায় ছেদ পড়ল প্রচণ্ড বিস্ফোরণে। আমাদের ঠিক সামনেই পাহাড়ের নিচে একটি বোমা এসে পড়ল! আমরা থেমে গেলাম।  বুক ঢিপঢিপ করছে। জ্যকব চাপা স্বরে বলল, ‘জঙ্গলে ঢুকে শুয়ে পড়ুন। আমি না বললে বের হবেন না।’ 

আমরা সেটাই করলাম। পাহাড়ী ঝোপের মাঝে ঢুকে শুয়ে পড়লাম। নাকে আসছে বারুদের গন্ধ। সামনের জায়গাটা ধোঁয়ায় ভরে গেছে। গায়ের ওপর পিঁপড়া উঠে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। আরও কত ধরণের কীটের দেখা যে পাচ্ছি তা বলাই বাহুল্য। জ্যাকব আমাদের সামনের একটা ঝোপে নিচু হয়ে বসে আছে। সাঈদ বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছে। রানার কোনো ভাবান্তর নেই। সে চুপচাপ শুয়ে আছে।

রনি ভাই আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘যদি বেঁচে ফিরতে পারেন, একটা গল্প লিখবেন এই ট্যুর নিয়ে।’ ওই পরিস্থিতিতেও আমার হাসি পেল। বললাম, ‘গল্প লিখলে সবটা ধরবে না, উপন্যাস লিখতে হবে’। রনি ভাইও মজা করে বলছিল, ‘সাঈদের গরুর গল্পটা যেন থাকে’। 

আসলে গত রাত থেকে আমাদের সঙ্গে যা যা হচ্ছে, তা দেখে নার্ভ শক্ত হয়ে গেছে। এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও তাই ঠাট্টা করতে পারছি। এছাড়া যেহেতু অন্য কোনো পথ আপাতত খোলা নেই, তাই দুশ্চিন্তা নিরর্থক।

প্রায় আধঘণ্টা পর জ্যকব উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে ইঙ্গিত করল। আমরা গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর জ্যাকবকে অনুসরণ করে আবারও পাহাড় থেকে নামতে লাগলাম। রানা পাহাড়ে ওঠা নামা করে অভ্যস্ত। সে আমাদের দারুণ সহায়তা করছে খাড়া পাহাড় বেয়ে নামতে। এই বয়সেই ওর গায়ে ভীষণ জোর। আমরা মাঝেমধ্যেই ওর হাত ধরে নিচে নামছি। কেউ হড়কে গেলে রানা এগিয়ে আসছে। 

থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে গোলাগুলির শব্দ । এই যুদ্ধে আমাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই, কোনো ভূমিকা কিংবা সংযোগ নেই। আমরা কেবল নীরব দর্শক, সেটাও বাধ্য হয়ে। একপর্যায়ে পাহাড়ের ঢালে নেমে আসতে সক্ষম হলাম সবাই। এখন একটু জংলি পথ হেঁটে পৌঁছতে হবে নদীর তীরে। জ্যকব আমাদের যেদিক দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কোনো পায়ে চলার পথ নেই। স্রেফ জঙ্গল। পায়ে চলার পথে সৈন্যরা আসতে পারে অনুমান করেই জ্যাকব এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঝোপঝাড় ভাঙতে ভাঙতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। শরীরের বহু স্থানে কেটে যাচ্ছে, পা কেটে রক্ত বেরোচ্ছে। নানা ধরনের পোকা মাকড়ের কামড় হজম করছি। কিন্তু কিছুই করার নেই। প্রাণের ভয় বড় ভয়। আমাদের এগোতেই হবে।

জ্যাকবের অনুমান যে এভাবে ফলে যাবে তা কে জানত? দ্রুতই কানে এলো বুট জুতার থপ থপ শব্দ। আমরা সেই পায়ে চলার পথ থেকে একটু দূরে জঙ্গলের ভেতর আছি। জ্যাকব বসে পড়ার ইঙ্গিত করল। প্রায় নিঃশব্দে আমরা বসে পড়লাম। একবার মনে হলো, আক্রমণকারীদের কাছে  নিজেদের পরিচয় দিয়ে আমরা বেঁচে যেতে পারি! পরেক্ষণেই মনে হলো, নিজেদের পরিচয় দেওয়ার সুযোগটা পাব তো? সম্ভবত না। তাছাড়া জ্যাকবকে বিপদে ফেলতেও  বিবেকে বাঁধছে। বুটের শব্দ এগিয়ে আছে। আমরা প্রায় শ্বাস বন্ধ করে বসে আছি। এসময় আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল একঝাঁক গুলি! তারপর আরও কয়েকটা। ওরা মনে হয় ফাঁকা গুলি করতে করতে এগোচ্ছে। আমাদের বেঁচে থাকা এখন স্রেফ ভাগ্যের হাতে। সামনেই গাছের ডালে একটা সাপ ঝুলছে। এই প্রাণীটাকে আমি ভীষণ ভয় পাই। নিজেকে বোঝাতে লাগলাম, কিছু করার নেই। কিন্তু সাপের ওপর থেকে নজর সরছিল না। গা গুলিয়ে উঠছিল। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ওরা ঠিক কোনদিক গেল, জ্যাকব ঠিক ধরতে পারছে না। তাই আমরাও আগের অবস্থাতেই আছি। মুখে কোনো কথা নেই। সাপটাকেও দেখতে পাচ্ছি না। চলে গেলে ভালো, গায়ের ওপর উঠলেই বিপদ। 

অনেকক্ষণ এভাবেই পড়ে রইলাম জঙ্গলে। একপর্যায়ে জ্যাকব বলল, নিচু হয়ে সামনে এগোতে হবে। আমরা ধীরে ধীরে নিচু হয়ে তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। এভাবে চলায় অনেক সময় লাগছে। একটু পরেই হয়তো সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে। অন্ধকারে পথ চলা আরও কঠিন হয়ে উঠবে। নদীর ধারে আসতে আসতে সন্ধ্যা নেমে এলো। তাড়াহুড়ায় জলের বোতল আনা হয়নি। প্রচণ্ড পিপাসা পেয়েছে। দুরু দুরু বুকে দীর্ঘ এই যাত্রার ক্লান্তিতে আমরা মাটিতে বসে পড়লাম। কিন্তু জ্যাকব সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। সে তাড়া দিয়ে আমাদের তুলল। বাধ্য হয়েই ক্লান্তিকে উপেক্ষা করে আমরা নদীর তীরে পৌঁছে গেলাম। জ্যাকব পথ দেখিয়ে বলল, ‘এ পথে সোজা হাঁটলে আমরা রেমাক্রি পৌঁছে যাব’। বলেই সে এগোতে লাগল। আমরা তার পিছু পিছু। নদীর ধারটা সমতল হলেও খানাখন্দে ভরা। আমাদের লুকানোর তেমন কোনো জায়গা নেই। দুই পাশে বড় বড় পাহাড়। ওপর থেকে কেউ নজর করলেই আমাদের দেখে ফেলবে। ওরা কোন পথে এসেছে আমরা জানি না। জ্যাকবের অনুমান ঠিক হলে তারা অন্য পথে এসে আক্রমণ করেছে। তবে একটি প্রশিক্ষিত বাহিনী অনেক কিছুই করতে পারে, যা জ্যাকবরা পারবে না। আনুচিংয়ের কথা মনে পড়ছে। ও কি এখনো বেঁচে আছে? অস্ত্র হাতে চালিয়ে যাচ্ছে লড়াই? জ্যাকব বলল, তাদের আস্তানার পাশের এই জায়গাটা খুব দ্রুত পেরোতে হবে। আমরা খানাখন্দের মধ্য দিয়ে প্রায় দৌড়ে চলছি। জ্যাকবের হাতে ধরা রিভলবার। সে ইতোমধ্যেই রনি ভাইয়ের হতে টর্চ ধরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সরাসরি আলো ফেলা নিষেধ। বিশেষ কায়দায় টর্চের সন্মুখভাগে হাত রেখে ক্ষীণ আলোয় পথ চলছি আমরা।  এমন সময় হুট করেই যমদূতের মতো সামনে এসে দাঁড়াল দুই ইউনিফর্মধারী! 

আমরা থমকে দাঁড়ালাম। জ্যাকব এক মুহূর্ত দেরি না করে গুলি চালিয়ে দিল তাদের ওপর। জ্যাকবের গুলিতে আত্মরক্ষার পর্যাপ্ত সরঞ্জাম নিয়ে আসা যমদূতদের কিছু হয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছিল না। তবে দুজনেই মাটিতে পড়ে গেল। জ্যাকবের গুলি শেষ! সে আমাদেরকে দৌড়ানোর নির্দেশ দিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রাণভয়ে আমরা ছুটছি। অনেকটা দৌড়ানোর পর কানে এলো গুলির শব্দ! জানি না কী ঘটল জ্যাকবের ভাগ্যে! এক জায়গায় একটু হাঁফ ছাড়ার জন্য দাঁড়ালাম। আমরা কোথায় আছি, রেমাক্রি কতদূর কিছুই জানি না। শুধু জানি, সোজা পথে এগোতে হবে। ইউনিফর্মধারীরা যদি আমাদের খোঁজে আসে, তাহলে ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। জ্যাকবের মুখটা মনে পড়ছে। অত্যন্ত শান্ত ও স্বল্পভাষী লোকটা আদতে কী ভয়ংকর যোদ্ধা! রানা তাড়া দিয়ে বলল, ‘চলেন চলেন। দৌড়ান। নাহলে গুলি খাবেন।’ আমাদের ছোটার শক্তি শেষ হয়ে গেছে। তবু প্রাণভয়ে ফের ছুটতে শুরু করলাম। আসার সময় আনুমানিক ঘণ্টা দেড়েক ট্রেকিংয়ের পর আমরা বন্দি হয়েছিলাম। পথ যদি একই থাকে সে হিসেবে রেমক্রি পৌঁছতে আর বেশিক্ষণ লাগার কথা নয়। অনুমান সত্যি প্রমাণিত হলো। দূরে দেখা যাচ্ছিল ইলেক্ট্রিক বাল্বের আলো। সাঈদ হাঁফাতে হাঁফাতে বলল ‘আলহামদুলিল্লাহ’। 

রেমাক্রিতে এসে সন্তর্পণে নদীর তীরে গেলাম। সারি সারি নৌকা বাঁধা আছে সেখানে। আমাদের নৌকার মাঝিকেও পেয়ে গেলাম। সে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করল, ‘জ্যাকব কোথায়’? এক কথায় জবাব দিলাম, ‘জানিনা’। যেহেতু সবই পূর্ব পরিকল্পিত, তাই মাঝিও আর কোনো প্রশ্ন করল না। নৌকা চলতে শুরু করল। ১০ মিনিট পর বাঘের মুখ নামের সেই জায়গায় পৌঁছে গেলাম। সেই আদিবাসী সুন্দরীর দোকানে আমাদের ব্যাগপত্র রাখা আছে। সেগুলো নিয়ে মেয়েটিকে ছোট্ট একটা ধন্যবাদ দিয়ে দ্রুত আমরা নৌকায় ফিরলাম। সুন্দরী বেশ অবাক হয়েই তাকিয়ে রইল। মুখে লেগে আছে সেই ভুবনভোলানো হাসি। সে হয়তো আশা করেছিল আমরা কিছু সময় কাটাব। চা-টা খাব। কিন্তু আমাদের কারোরই সেই মনের অবস্থা ছিল না। রানারও না। নৌকায় উঠে পড়লাম। পেছনে পড়ে রইল আনুচিং-জ্যাকবদের ভালোবাসার পাহাড়।

ঢাকা শহরের রৌদ্রজ্জ্বল এক সকালে ভাড়া বাড়ির ছয়তলার বারান্দায় বসে আছি। তাকিয়ে আছি টবে লাগানো গাছগুলোর দিকে। কদিন জল না পেয়ে ওগুলোর অবস্থা মৃতপ্রায়। ঢাকায় ফিরে লম্বা ঘুম দেওয়ার পরও শরীরের ক্লান্তি যায়নি। মনের ঝড় তো খুব সহজে থামার কথা নয়। পাশে রাখা মুঠোফোনটা বেজে উঠল। চার্জ দেওয়ার পর সেটি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। রিসিভ করতেই বুঝলাম রানার ফোন। সে নিরাপদে থানচি থেকে আলীকদম পৌঁছে গিয়েছে। আমরা ফিরেছি বান্দরবান হয়ে। তবে নীলগিরি পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা চাঁদের গাড়ির রোমাঞ্চ অনুভব করার মানসিক অবস্থা কারওই ছিল না। রানা আমাদের খুব মিস করছে। ওর নিজের কোনো ফোন নেই। তবে দ্রুতই সে ফোন কিনবে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে। ওর কণ্ঠ কাঁপছিল। থানচি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় আমাদের জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিল ছেলেটা। মাত্র দুই দিনের পরিচয়ে আমাদের কতটা আপন করে নিয়েছিল সে! কথা শেষ করে ভাবছিলাম, এই মানুষই মানুষকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে, আবার এই মানুষই হয়ে ওঠে হিংস্র। মানুষে মানুষে সৃষ্টি করে বৈষম্যের, শত্রুতার। অন্যায়ভাবে অন্যের সবকিছু কেড়ে নেয়, এমনকী জীবনও। কলবেল বেজে উঠল। হকার দরজার নিচ দিয়ে পত্রিকা দিয়ে গেছে। সেটি নিয়ে ফের বারান্দায় গিয়ে বসলাম। প্রথম পাতায় তিন কলাম জায়গায় বক্স করা একটা সংবাদের শিরোনাম চোখ আটকে গেল- ‘পাহাড়ে সৈন্যদের গুলিতে ছয় সন্ত্রাসী নিহত’। পত্রিকা হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। সকালের পরিস্কার আকাশ যেন কালো মেঘে ঢেকে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠল আনুচিং, জ্যাকব, অংম্রাচিংদের মুখ। খবরের ভেতরে গিয়ে নিহতদের নামগুলো দেখার সাহস আর হলো না। পাহাড়ের কান্না চোখের জল হয়ে টপ টপ করে ঝরে পড়তে লাগল পত্রিকার পাতায়।

সত্যজিৎ কাঞ্জিলাল, ঢাকা

২৪-০৩-২০২৪

 

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত